আপনি যখন ইন্টারনেটে কিছু খোঁজেন, আপনি কি মনে করেন আপনি একান্তে আছেন? হয়তো ভাবেন যে কেবল আপনিই জানেন, কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ধরুন, আপনি একটি নতুন ল্যাপটপ কেনার জন্য বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘুরছেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আপনার ফেসবুক, ইউটিউব, কিংবা অন্য যেকোনো অ্যাপে ল্যাপটপের বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে! কীভাবে? কারণ, আপনার ব্রাউজিং প্যাটার্ন ট্র্যাক করা হচ্ছে। কুকির যুগ শেষ হচ্ছে, কিন্তু গুগল এখন আরও উন্নত ট্র্যাকিং প্রযুক্তি – “ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্টিং” – চালু করেছে।
গুগল তার নতুন বিজ্ঞাপন নীতির মাধ্যমে ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্টিং অনুমোদন দিয়েছে, যা আগে “ভুল” বলে আখ্যায়িত করেছিল। ২০১৯ সালে গুগল বলেছিল যে ফিঙ্গারপ্রিন্টিং ব্যবহারকারীদের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে তাদের তথ্য সংগ্রহ করে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে গুগল ঘোষণা দেয় যে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বিজ্ঞাপনদাতারা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে। গোপনীয়তা রক্ষার পক্ষে থাকা ব্যক্তিরা এটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ফিঙ্গারপ্রিন্টিং কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে?
ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্টিং হলো এমন একটি ট্র্যাকিং প্রযুক্তি, যা ব্যবহারকারীর ডিভাইস, ব্রাউজার, অপারেটিং সিস্টেম, স্ক্রিন রেজোলিউশন, আইপি অ্যাড্রেস, ফন্ট সেটিংস ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবহারকারীদের একটি অনন্য ডিজিটাল পরিচয় তৈরি করে। এর ফলে ব্যবহারকারী কোনো ওয়েবসাইট থেকে কুকি মুছলেও তাদের গতিবিধি ট্র্যাক করা সম্ভব হয়।
গুগলের নীতির পরিবর্তন ও প্রতিক্রিয়া
২০১৯ বনাম ২০২৫
২০১৯ সালে গুগল বলেছিল যে “ফিঙ্গারপ্রিন্টিং ব্যবহারকারীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করে এবং এটি ভুল”। কিন্তু এখন গুগল নিজেই এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, যা গোপনীয়তা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর কাছে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
Mozilla-এর প্রতিক্রিয়া
মোজিলার মার্টিন থমসন গুগলের এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন,
“গুগল নিজেকে এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের মানুষের কার্যক্রম ট্র্যাক করার অনুমতি দিয়েছে, যেখানে ব্যবহারকারীদের কোনো বাস্তব নিয়ন্ত্রণ নেই।”

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের তদন্ত
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের তথ্য সংরক্ষণ সংস্থাগুলো গুগলের এই নতুন নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। ইউকে ইনফরমেশন কমিশনার অফিস (ICO) এটিকে “ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তার প্রতি দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ” বলে অভিহিত করেছে।
গোপনীয়তা সংক্রান্ত সংস্থা Electronic Frontier Foundation (EFF) জানিয়েছে যে এই নতুন নীতি ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলবে এবং ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তার উপর নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে দেবে।
গুগলের যুক্তি কী?
গুগল দাবি করেছে যে তারা তৃতীয় পক্ষের কুকি ব্লক করার পরিবর্তে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চায়, যা বিজ্ঞাপনদাতাদের আরও নির্ভুল টার্গেটিং করতে সাহায্য করবে। কিন্তু গোপনীয়তা বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ব্যবহারকারীদের উপর আরও বেশি নজরদারি করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
ব্যবহারকারীদের জন্য কী সমস্যা তৈরি হবে?
- অপ্ট-আউট করার উপায় নেই: কুকি ব্লক করা সম্ভব হলেও, ফিঙ্গারপ্রিন্টিং এড়ানো অত্যন্ত কঠিন।
- নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন টার্গেটিং: বিজ্ঞাপনদাতারা ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে আরও বিশদ তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে।
- গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন: ব্যক্তি-স্বাধীনতার ওপর আঘাত হানতে পারে এবং ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
আমরা কী করতে পারি?
যেহেতু গুগল তার নীতি পরিবর্তন করেছে, তাই ব্যবহারকারীদের এখন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত:
✅ Firefox বা Brave ব্রাউজার ব্যবহার করুন – এই ব্রাউজারগুলো ফিঙ্গারপ্রিন্টিং প্রতিরোধ করতে পারে।
✅ VPN এবং Tor ব্রাউজার ব্যবহার করুন – আইপি ও লোকেশন গোপন রাখতে সহায়ক।
✅ Privacy-focused এক্সটেনশন ব্যবহার করুন – যেমন NoScript, uBlock Origin ইত্যাদি।
✅ DNS-ভিত্তিক গোপনীয়তা রক্ষা করুন – NextDNS বা Cloudflare 1.1.1.1 ব্যবহার করুন।
✅ Privacy-respecting সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করুন – যেমন DuckDuckGo, StartPage।
✅ Big Tech কোম্পানিগুলোর সিদ্ধান্তের বিষয়ে সোচ্চার হোন – গোপনীয়তা সংরক্ষণ আইন শক্তিশালী করার জন্য জনগণের দাবি তোলা জরুরি।
উপসংহার
গুগলের নতুন সিদ্ধান্ত ব্যবহারকারীদের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা রক্ষার পক্ষে বড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা অনলাইনে তাদের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে চান, তাদের অবশ্যই আরও সচেতন হতে হবে এবং প্রযুক্তিগত বিকল্পগুলোর দিকে নজর দিতে হবে।
আপনার কী মতামত? আপনি কি মনে করেন, গুগল ব্যবহারকারীদের স্বাধীনতাকে সম্মান করছে?
আপনার মতামত কমেন্টে জানান!
Leave a comment