জীববৈচিত্র্যের বর্তমান অবস্থাঃ
বাংলাদেশ পরিবেশ বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি দেশ। দেশটিতে পাঁচটি প্রধান বাস্তুতন্ত্র রয়েছে – উপকূলীয় ও সামুদ্রিক, মিঠা পানির, স্থলভাগ বনাঞ্চল, পাহাড়ি এবং কৃষি-নির্ভর (homestead) বাস্তুতন্ত্র। এই সকল বাস্তুতন্ত্রে বিপুল উদ্ভিদ ও প্রাণীমণ্ডল বিরাজমান। উদাহরণস্বরূপ, মাত্র ১৪৭,৫৭০ বর্গকিমি এলাকাজুড়ে বাংলাদেশে আনুমানিক ৩৪ প্রজাতির উভচর, ১০৯ সরীসৃপ, ৩০১ আভ্যন্তরীণ পাখি, ১৭৬ অভিবাসী পাখি, ১২০ স্থলভাগ স্তন্যপায়ী এবং ৩ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রজাতি রয়েছে। বাংলাদেশের মোট বনভূমির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গিয়ে দেশীয় এলাকা মাত্র সাড়ে সাত থেকে আট শতাংশে নেমে এসেছে। সামুদ্রিক পরিবেশের দিকে নজর দিলে দেখা যায় বাংলাদেশের ৭১০ কিমি উপকূলরেখা ও ১১৮,৮১৩ বর্গকিমি অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রায় ৭৪০টি সামুদ্রিক প্রজাতি বাস করে। সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, যা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারসহ বহু বিপন্ন প্রজাতির অভয়স্থল। অপরদিকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ একমাত্র প্রবালদ্বীপ হওয়ায় তার প্রবাল বনও জাতীয় (এবং সম্প্রতি মেরিন প্রোটেক্টেড) সংরক্ষণের অধীনে রয়েছে। এছাড়া হাকালুকি ও তাংগুয়ার হাওর জাতীয় জলাভূমি হিসেবে সংরক্ষিত আছে, যেখানে প্রচুর অভিবাসী ও স্থানীয় পাখি ও মাছের আবাস।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে উদ্যোগঃ
সরকার বিপন্ন বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বননীতি-১৯৯৪ অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে বনভূমির ১০% সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল। ২০০০ সালে জীববৈচিত্র্য আইন প্রণয়ন করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের আইনি ভিত্তিও তৈরি হয়েছে। হাওর, পাহাড়ি বন ও উপকূলীয় অঞ্চলে জাতীয় উদ্যান ও অভয়াশ্রম ঘোষণার পাশাপাশি টাংগুয়ার হাওরকে রামসার সাইট ঘোষণা করা হয়েছে এবং হাকালুকি, হাইল, সেতাপাহাড় সহ গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমিতে ঝাঁকবিহীন শিকার নিষিদ্ধ করেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ইতোমধ্যেই ৯টি এলাকা ‘পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এলাকা (ECA)’ হিসাবে ঘোষণা করেছে, যা ঐ এলাকাগুলোর বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সহায়ক। পাশাপাশি হিলশা মাছ সংরক্ষণের জন্য পাঁচটি হিলশা অভয়ারণ্য গঠন এবং বছরে ৮ মাস জাটকা (নূরজাত) ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা, ২২ দিন গর্ভাশয়ী হিলশা আহরণের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বন বিভাগ বিপন্ন উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্য দেশীয় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চালাচ্ছে। বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা-গোষ্ঠীগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। উদাহরণস্বরূপ, UNDP বাংলাদেশ উপকূলীয় সম্প্রদায়কে সমন্বিতভাবে ক্ষমতায়ন ও নীতি প্রণয়নে সহায়তার জন্য ‘জাতীয় নীল অর্থনীতি কর্মপরিকল্পনা’ প্রণয়ন এবং ‘নীল বন্ড’ অর্থায়ন ব্যবস্থা নিয়ে জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে IUCN বাংলাদেশ প্রথম জাতীয় উদ্ভিদ লাল তালিকা প্রকাশ করেছে; এতে দেখা গেছে গত শতাব্দীতে সাতটি উদ্ভিদপ্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে এবং আরও পাঁচটি বিলুপ্তি বিপদাগ্রস্ত।
জলবায়ু পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জঃ
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের বাস্তুতন্ত্রকে মারাত্মক প্রভাবিত করছে। বিশেষ করে সমুদ্রের তীব্র সংকোচন ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উপকূলীয় বনাঞ্চল সংকুচিত হচ্ছে; গবেষণায় দেখা গেছে ১৯৬৪ সাল থেকে সুন্দরবনের প্রায় ২১০ বর্গকিমি ভূমি সমুদ্র তীরে বিলীন হয়েছে। ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ১৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। দুর্যোগের প্রাকৃতিক বাঁধ মর্যাদারূপে কাজ করা সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভগুলোও অপ্রতুল অর্থ ও জনবলের কারণে দূষণ ও অবৈজ্ঞানিক কাটাছেঁড়া সহায়তায় দুর্বল হয়ে পড়ছে। সমুদ্রের গরম পানিতে প্রবালপ্রজাতির অস্বাভাবিক ক্ষতি হচ্ছে; উদাহরণস্বরূপ, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রবালাঞ্চলে ২০১৮-২০২১ বছরগুলিতে প্রবাল bleaching ঘটনাক্রমে প্রবালের আবরণ ১.৩২ বর্গকিমি থেকে ০.৩৯ বর্গকিমি কমে গেছে। জলের উষ্ণতায় সামুদ্রিক মাছের বসবাস এবং বংশবৃদ্ধিও প্রভাবিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং বন উজাড়সহ অগত্যা মানবসৃষ্ট জীববৈচিত্র্য হ্রাস ইত্যাদি বিষয় বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের কারণ।
নীল অর্থনীতিঃ ধারণা ও প্রাসঙ্গিকতা-
নীল অর্থনীতি বলতে বোঝায় সমুদ্র ও উপকূলীয় সম্পদ ব্যবহার করে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ করা। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত হওয়ায় এ ধারণা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় সম্ভাবনা রয়েছে। ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নীল অর্থনীতি ধারণাটি সমৃদ্ধ উপকূলীয় দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন দিগন্ত হিসেবে উন্মোচিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে নীল অর্থনীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন খাত যেমন মাছ চাষ, সামুদ্রিক পর্যটন, নবায়নযোগ্য শক্তি ও জাহাজ নির্মাণে বিনিয়োগ বাড়ানোও প্রস্তাবিত হয়েছে। UNDP-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ নীল অর্থনৈতিক উন্নয়নে উদ্ভাবনী সমুদ্রজ ফসল, মহাসড়ক-বান্ধব সমুদ্রতট সাফাই উদ্যোগ এবং নীতিমালা প্রণয়নে কাজ করছে।
সামুদ্রিক সম্পদ ও টেকসই উন্নয়নঃ
সামুদ্রিক সম্পদ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। দেশটির মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ১৫% আসে সমুদ্র থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৪.৮ মিলিয়ন টন মাছ ধরা হয়েছে, যার মধ্যে ০.৭ মিলিয়ন টন সামুদ্রিক মাছ। তবে অতিরিক্ত অর্থনীতি ভিত্তিক শিকার সামুদ্রিক প্রজাতি কমিয়ে দিয়েছে (১৯৭১ সালে এখানে ৪৭৫টি সমুদ্রীয় মাছের প্রজাতি ছিল, এখন ৩৯৪টিতে নেমে এসেছে)। সরকার এ বর্জন প্রতিরোধে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মাছ ধরা নৌকার কোনও নতুন লাইসেন্স ২০১৫ সাল থেকে ইস্যু করে না এবং সেট-ব্যাগনেট ও পুশনেটের মতো ধ্বংসাত্মক জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। ২০০০ সালে বঙ্গোপসাগরে ৬৯৮ বর্গ কি.মি. এলাকা মেরিন রিজার্ভ ঘোষিত হয়, ২০১৪ সালে ‘সোওয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ এলাকায় ১৭৩৮ বর্গকিমি এমপিএ ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৯ সালে নিঝুম দ্বীপ ও হাটিয়ায় প্রায় ৩১৮৮ বর্গকিমি সমুদ্র এলাকা এমপিএ করা হয়। ২০২৪ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও আশেপাশের ১৭৪৩ বর্গকিমি জলমহলকে মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের সামুদ্রিক নীতির অংশ হিসেবে (২০১৪ ও ২০১৬ সালে) গর্ভাশয়ী হিলশা মাছের জন্য মাছ শিকারের আট-মাস বাধা এবং ২২ দিনের হিলশা নিষেধাজ্ঞা চালু হয়েছে। নবায়নযোগ্য শক্তির খাতে বায়ু ও পারমাণবিক উৎসটিও গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে; উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে ৫০০ মেগাওয়াট সামুদ্রিক বায়ু প্রকল্পের নকশা অনুমোদন পায়এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সমুদ্র ও স্থল উভয় হাওয়ায় ৫ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে।
নীতিমালা ও ভবিষ্যত দিকনির্দেশনাঃ
সরকার নীল অর্থনীতি ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণে কৌশলগত নীতিমালা গ্রহণে অগ্রসর। জাতীয় পরিকল্পনায় নীল অর্থনীতিকে প্রবৃদ্ধির উৎস হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সমুদ্রসম্পদভিত্তিক শিল্প-খাত, পুনঃনবায়নযোগ্য শক্তি, গবেষণা উন্নয়ন ও শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ ১২টি কার্যক্রম তালিকাভুক্ত রয়েছে। গবেষণায় বলা হচ্ছে বাংলাদেশকে নীল অর্থনীতিতে এগিয়ে নিতে “বহুমাত্রিক জাতীয় নীতি, জাতীয় সামুদ্রিক কৌশল এবং সামুদ্রিক স্থানিক পরিকল্পনা” প্রণয়নের প্রয়োজন। পোলিসি স্তরে উদাহরণস্বরূপ, পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক সাম্প্রতিক স্ট মার্টিন দ্বীপসহ সমুদ্র এলাকার প্রোটেকশন ঘোষণা এবং বাংলাদেশ ফরেস্ট ট্রান্সপারেন্সির মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ২০২৫ সালের UN মহাসমুদ্র সম্মেলনে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, যেখানে সমুদ্র-ভিত্তিক টেকসই উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
উপসংহারঃ
বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ এবং সমুদ্রসম্পদের টেকসই ব্যবহার একক কৌশল নয়, আন্তঃসংগঠিত উদ্যোগ ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার দাবি রাখে। জলবায়ু পরিবর্তনসহ অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি সকল অংশীজনের সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন। নীল অর্থনীতি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের মধ্যে সঙ্গতিপূর্ণ সমন্বয় গড়ে তোলা গেলে বাংলাদেশের বাস্তুতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন সুদৃঢ় হবে।
মোঃফাহাদ হুসাইন
শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ
শহীদ বুলবুল সরকারি কলেজ, পাবনা।(অধিভূক্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।)
Leave a comment