রফিক একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তার এক বিস্ময়কর ক্ষমতা আছে—সে π (পাই) এর মান ৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫… মুখস্থ বলতে পারে, কিন্তু সকালে কী নাশতা করেছিল, সেটাই ভুলে যায়!
তার বন্ধুরা মজা করে বলে, “তুই বিজ্ঞানী হয়ে গেছিস!”
রফিক ভাবে, বিজ্ঞানীদের কি আসলেই এমন কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে?
আসুন দেখা যাক, বিজ্ঞানী হওয়ার কিছু মজার লক্ষণ কী হতে পারে এবং বাস্তবিকভাবেই এগুলোর পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি না।
বিজ্ঞানীরা কি আসলেই অদ্ভুত?
পৃথিবীর অনেক সফল বিজ্ঞানীদের ব্যক্তিগত জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের থেকে একটু আলাদা। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় (২০১৯) দেখা গেছে, বিজ্ঞান ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ছোট ছোট বিশেষ তথ্য সহজে মনে রাখতে পারেন, কিন্তু দৈনন্দিন ব্যক্তিগত জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলে যান।
একটি জরিপে দেখা গেছে, ৭৫% পদার্থবিজ্ঞানী তাদের প্রতিদিনের কাজগুলো মনে রাখতে মোবাইল নোট ব্যবহার করেন, কিন্তু একই সঙ্গে তারা জটিল সমীকরণ বা মৌলিক সংখ্যা খুব সহজেই মুখস্থ রাখতে পারেন।
তাহলে কেন এমন হয়?
যুক্তরাষ্ট্রের নিউরোসায়েন্স গবেষক ড. জন হপকিন্স বলেন, “আমাদের মস্তিষ্ক যখন গবেষণার গভীরে ডুবে যায়, তখন এটি কম গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলিকে ফিল্টার করে ফেলে। তাই বিজ্ঞানীরা হয়তো জটিল সূত্র মনে রাখতে পারেন, কিন্তু রান্নাঘরে ফ্রিজে কী আছে, সেটা ভুলে যান।”
“কেন” প্রশ্ন করার স্বভাব
বিজ্ঞানীদের আরেকটি মজার বৈশিষ্ট্য হলো—তারা সব কিছুর পিছনে “কেন” খোঁজেন।
🔹 কেন আকাশ নীল?
🔹 কেন পানি স্বচ্ছ?
🔹 কেন চায়ের কাপে বুদবুদ হয়?
সাধারণ মানুষ যেখানে জিনিসগুলোকে স্বাভাবিকভাবে নেয়, বিজ্ঞানীরা সেখানে “কেন” এর উত্তর খুঁজে পান না যতক্ষণ না তারা সত্যটা খুঁজে বের করেন।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, কৌতূহল মানুষের মস্তিষ্কের ডোপামিন সেন্টার (পুরস্কার কেন্দ্র) সক্রিয় করে, যা শেখার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। এর কারণেই বিজ্ঞানীরা শিশুসুলভ প্রশ্ন করতে থাকেন এবং নতুন আবিষ্কারের দিকে ধাবিত হন।
ডোপামিন হলো আমাদের মস্তিষ্কের একটি নিউরোট্রান্সমিটার, যা মূলত আমাদের পুরস্কারের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে। যখন আমরা নতুন কিছু শিখি বা কৌতূহলবশত কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করি, তখন মস্তিষ্কের “পুরস্কার কেন্দ্র” (reward center) সক্রিয় হয় এবং ডোপামিন নিঃসরণ হয়। এটি আমাদের শেখার আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দেয় এবং আমাদের আরও বেশি কৌতূহলী করে তোলে।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাটি দেখায় যে বিজ্ঞানীরা স্বাভাবিকভাবেই বেশি কৌতূহলী হন এবং নতুন বিষয় শিখতে ও গবেষণা করতে ভালোবাসেন। কারণ, তাদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের সক্রিয়তা বেশি থাকে। যখন বিজ্ঞানীরা নতুন কোনো সমস্যা সমাধান করেন বা কোনো তত্ত্ব আবিষ্কার করেন, তখন তাদের মস্তিষ্কে এক ধরণের “পুরস্কার অনুভূতি” তৈরি হয়, যা তাদের আরও বেশি গবেষণার দিকে ঠেলে দেয়। এটি ব্যাখ্যা করে কেন বিজ্ঞানীরা অনেক সময় শিশুদের মতো একের পর এক “কেন” প্রশ্ন করতে থাকেন।
জটিল জিনিসকে ভালোবাসে কিন্তু সহজ জিনিসের প্রতি আগ্রহ কম!
একটা মজার তথ্য—নোবেল বিজয়ী অনেক বিজ্ঞানী ব্যক্তিগত জীবনে খুবই এলোমেলো ছিলেন।
- অ্যালবার্ট আইনস্টাইন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন একজন প্রতিভাবান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, তবে তিনি দৈনন্দিন জীবনে কিছুটা ভুলোমনা ছিলেন। তাঁর সহকর্মী এবং বন্ধুরা প্রায়ই লক্ষ্য করতেন যে তিনি ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, বিশেষ করে দরজার চাবি হারিয়ে ফেলতেন।
- আইজ্যাক নিউটন একদিন নিজের বিড়ালকে বাইরে যেতে দিতে গিয়ে দরজায় দুটো ছিদ্র করেছিলেন—একটা বড়, আরেকটা ছোট! তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, ছোট বিড়ালটি বড় ছিদ্র দিয়েও যেতে পারে।
- রিচার্ড ফাইনম্যান রিচার্ড ফাইনম্যান ছিলেন একাধারে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, জনপ্রিয় শিক্ষক, এবং একজন চমৎকার কাহিনীকার। তবে তার ব্যক্তিত্বের আরেকটি মজার দিক ছিল—তিনি কেবল কঠিন তত্ত্ব এবং জটিল গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন না, বরং গিটার বাজানো, চিত্রাঙ্কন এবং বক্সিংয়ের মতো একেবারে ভিন্নধর্মী কাজেও আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তার দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কাজকর্মে খুব একটা দক্ষতা ছিল না। রান্না বা গৃহস্থালির কাজ সম্পর্কে তিনি তেমন কিছু জানতেন না, কারণ তার মন সবসময় জটিল সমস্যার সমাধানে ব্যস্ত থাকত।
বিজ্ঞানীরা এত জটিল গণিত ও থিওরি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন যে সাধারণ জিনিস তাদের মাথায় ঢোকে না। একটি জরিপে দেখা গেছে, গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে কর্মরত ৬৫% বিজ্ঞানী বাজারের হিসাব রাখতে পারেন না বা বিল ভাগ করতে সমস্যায় পড়েন।
দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য
বিজ্ঞানীরা সবকিছুতেই অন্যরকম যুক্তি খোঁজেন।
বৃষ্টি দেখে কেউ অনুভূতিশীল হয়ে পড়ে, কেউ ভালোবাসার কথা ভাবে। কিন্তু একজন বিজ্ঞানী ভাবে—”আলোর প্রতিসরণ কিভাবে জলকণার মধ্যে ঘটছে?”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গবেষকদের ব্রেইন স্ক্যান করলে দেখা যায়, তাদের ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ক (DMN)—যা নতুন ধারণা ও সৃজনশীল চিন্তার জন্য দায়ী—সাধারণ মানুষের তুলনায় ৩০% বেশি সক্রিয় থাকে।
আপনিও বিজ্ঞানী হতে পারেন!
এখন প্রশ্ন হলো—এই লক্ষণগুলো যদি আপনার মধ্যে থাকে, তাহলে কি আপনি বিজ্ঞানী?
উত্তর: সম্ভাবনা খুব বেশি!
কারণ বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য কেবল গবেষণাগারে থাকা বা গবেষণা করা লাগে না। আপনি যদি সব সময় নতুন কিছু শেখার আগ্রহ রাখেন, তথ্য যাচাই করেন, এবং চারপাশকে অন্যভাবে দেখেন—তাহলে আপনি বিজ্ঞানী হওয়ার পথে রয়েছেন!
বিজ্ঞানী হওয়ার মানে শুধু পরীক্ষাগারে থাকা নয়, বরং চিন্তার একটি বিশেষ ধরণ গড়ে তোলা। তাই যদি আপনি ছোট ছোট ব্যাপারে প্রশ্ন করতে ভালোবাসেন, প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করেন—তাহলে আপনিও হয়তো ভবিষ্যতের বিজ্ঞানী!
“বিজ্ঞান শুধু বইয়ের বিষয় নয়, এটি একটি জীবনধারা!”
আপনার চিন্তাধারা কেমন? আপনি কি নিজের মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্য খুঁজে পান? যদি হ্যাঁ, তাহলে অভিনন্দন—আপনি হয়তো বিজ্ঞানী! 🔬🚀
Leave a comment