গবেষণায় হাতে খড়ি

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার সময় আমাদের ফেলোদের সাধারণ সমস্যা ও কার্যকর সমাধান!

Share
Share

প্রফেসর- ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন

ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

বিদেশী ছাত্ররা যখন আমেরিকায় পড়াশুনার জন্য আসে, তখন তারা নানা ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়। বিশেষ করে, ভাষাগত, শিক্ষার পদ্ধতি, ব্যক্তিগত অভ্যাস, এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে তারা কিছু নির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। নিম্নে উল্লিখিত সমস্যাগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. যোগাযোগের দুর্বলতা:

TOEFL পরীক্ষায় ভালো স্কোর থাকা সত্ত্বেও বিদেশী ছাত্ররা প্রায়ই আমেরিকান ইংরেজির সাথে খাপ খাওয়াতে সমস্যায় পড়ে। আমেরিকান উচ্চারণ, শব্দের ব্যবহার এবং বাচনভঙ্গি আন্তর্জাতিক ছাত্রদের কাছে নতুন ও জটিল মনে হতে পারে। প্রতিদিনের জীবনে, বিশেষত ক্লাসে বা সামাজিক যোগাযোগে, ছাত্রদের এই ভিন্নতা বুঝতে এবং তার সাথে অভ্যস্ত হতে কিছুটা সময় লাগে। এছাড়া কথোপকথনের সময় শোনা এবং বোঝার ক্ষেত্রে দুর্বলতা থেকে যায়, যা বিশেষ করে ক্লাসের আলোচনায় ও প্রফেসরের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অসুবিধা সৃষ্টি করে।

২. পড়াশোনার পদ্ধতির সাথে খাপ খাওয়ানো:

আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার ধরণ অনেকটাই ভিন্ন হতে পারে। এখানে পুরো সেমিস্টারব্যাপী বিভিন্ন ধরণের অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজ, পরীক্ষা, রিভিউ লেখা এবং প্রেজেন্টেশনের কাজ থাকে। এই ধরণের ধাপে ধাপে মূল্যায়ন পদ্ধতি অনেক বিদেশী ছাত্রের জন্য নতুন। তারা সাধারণত সেমিস্টারের শেষে বড় পরীক্ষায় অভ্যস্ত থাকে, ফলে এই নিয়মিত কাজের চাপের সাথে খাপ খাওয়ানো কঠিন হতে পারে। সময়মত অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়া এবং অধ্যয়ন পরিকল্পনা বজায় রাখা তাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

৩. টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করায় অভ্যস্ত না থাকা:

বহু বিদেশী ছাত্রকে তাদের পড়াশুনার পাশাপাশি টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট (TA) হিসেবে কাজ করতে হয়। এই কাজ অনেকের কাছে নতুন এবং চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। বিশেষ করে যারা আগে কখনও শিক্ষকতা বা সহকারী হিসাবে কাজ করেননি, তাদের জন্য ক্লাস পরিচালনা, শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা এবং পরীক্ষা মূল্যায়ন করা কষ্টকর হয়। পাশাপাশি, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বাধা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এই ভূমিকা পালনকে আরও কঠিন করে তোলে।

৪. সাপ্তাহিক পরিকল্পনা ও রুটিন মাফিক কাজে অনভ্যস্ততা:

অনেক ছাত্র নিজের পড়াশোনা এবং দৈনন্দিন কাজের মধ্যে সঠিক সমন্বয় করতে পারে না। আমেরিকান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে ছাত্রদের নিজস্ব সাপ্তাহিক পরিকল্পনা এবং রুটিন তৈরি করার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য জোর দেওয়া হয়। তবে, অনেক বিদেশী ছাত্র তাদের সময় পরিচালনা এবং কাজের রুটিন ঠিকমতো সাজাতে পারে না, যার ফলে কাজের চাপ বেড়ে যায় এবং তারা অসুবিধার সম্মুখীন হয়।

৫. নিজ দেশীয় খাবারের সল্পতা ও রান্নাবান্না ম্যানেজ করা:

বিদেশী ছাত্ররা প্রায়ই তাদের দেশীয় খাবারের অভাবে ভোগে। স্থানীয় খাবার অনেক সময় তাদের স্বাদের সাথে মিল না থাকায় তারা নিজেরাই রান্না করার প্রয়োজন বোধ করে। কিন্তু অনেক ছাত্র রান্না করতে অভ্যস্ত না থাকার কারণে প্রতিদিনের খাবারের ব্যবস্থাপনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই কারণে তারা অনেক সময় মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, যা তাদের পড়াশোনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

৬. পাবলিক ট্রান্সপোর্ট না থাকা:

আমেরিকার অনেক শহরে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সুবিধা সীমিত। ফলে ছাত্রদের নিজস্ব যানবাহন ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়, যা তাদের জন্য নতুন এবং ব্যয়বহুল হতে পারে। যাদের গাড়ি নেই, তারা সাধারণত ক্যাম্পাসের ভিতরে এবং বাইরে যাতায়াত করতে সমস্যায় পড়ে, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটায়।

৭. ফ্রি-রাইটিং বা প্যারাফ্রেজিং স্কিল না থাকা:

বিদেশী ছাত্রদের অনেকেই ইংরেজি ভাষায় ফ্রি-রাইটিং বা প্যারাফ্রেজ করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা অনুভব করেন। তাদের নিজস্ব শব্দ ব্যবহার করে আইডিয়া প্রকাশ করতে সমস্যা হয়। এই সমস্যা বিশেষত লেখালেখির কাজে, যেমন রিসার্চ পেপার, অ্যাসাইনমেন্ট বা প্রেজেন্টেশন প্রস্তুতে বেশ জটিলতা সৃষ্টি করে।

৮. গবেষণায় ট্রাবলশুটিং এবং নতুন আইডিয়া প্রস্তাব করতে না পারা:

গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক ছাত্র নতুন ধারণা বা সমস্যার সমাধান করতে সংকোচ বোধ করেন। তারা প্রায়ই তাদের সুপারভাইজারের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, যার ফলে গবেষণায় স্বাধীন চিন্তা ও সৃজনশীলতার অভাব ঘটে। ছাত্রদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা গড়ে তোলার অভ্যাস থাকলে তারা গবেষণার ক্ষেত্রে ভালো করতে পারবে।

সমাধানসমূহ:

১. কমিউনিকেশন দক্ষতা বাড়ানো:

বিদেশী ছাত্রদের ইংরেজি যোগাযোগ দক্ষতা উন্নত করার জন্য প্রতিদিনের কথোপকথনে অনুশীলন করা প্রয়োজন। তারা স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যমে আমেরিকান ইংরেজির উচ্চারণ এবং ভিন্নতায় অভ্যস্ত হতে পারে। ভাষাগত উন্নতির জন্য টিভি, রেডিও, বা পডকাস্ট থেকে শুনে শোনা ও অনুশীলন করা ভালো পদ্ধতি হতে পারে।

২. পড়াশোনার পরিকল্পনা করা:

ছাত্রদের জন্য সঠিক সময় ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। সাপ্তাহিক রুটিন এবং পড়াশোনার জন্য পরিকল্পনা করা তাদের নিয়মিত কাজ এবং অ্যাসাইনমেন্টের চাপ কমাতে সাহায্য করবে। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং প্রতিদিনের কাজগুলোকে ছোট ছোট ধাপে ভাগ করে করা উত্তম পদ্ধতি।

৩. টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে দক্ষতা অর্জন:

ছাত্ররা টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টের ভূমিকা পালনে ভালো ফলাফল করতে পারে যদি তারা সময়মত কাজের জন্য প্রস্তুত থাকে এবং পড়ানোর কৌশল সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে। সিনিয়র টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টদের থেকে পরামর্শ নেওয়া এবং ছোট গ্রুপের ক্লাসে প্রথমে শুরু করা সহায়ক হতে পারে।

৪. ব্যক্তিগত রুটিন এবং কাজের ধরণ পরিবর্তন করা:

সাপ্তাহিক কাজ এবং অ্যাসাইনমেন্ট ম্যানেজ করতে ছাত্রদের ব্যক্তিগত রুটিন তৈরি করা উচিত। তাদের সপ্তাহের শুরুতেই কাজের তালিকা তৈরি করা এবং সময়মত কাজ শেষ করার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। পরিকল্পনা ও রুটিন অনুসারে কাজ করার মাধ্যমে সময়মত পড়াশোনা ও অন্যান্য দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে।

৫. খাবার ব্যবস্থাপনা:

নিজ দেশের খাবার না পেলে ছাত্ররা স্থানীয় বাজার থেকে খাবার কিনে রান্না করতে শিখতে পারে। রান্নার সহজ পদ্ধতি শিখে তাদের দৈনন্দিন খাদ্য ব্যবস্থাপনা করা সহজ হবে। এছাড়াও, স্থানীয় খাবারের সাথে পরিচিত হতে এবং স্থানীয় রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে নতুন স্বাদের সাথে অভ্যস্ত হওয়া যেতে পারে।

৬. পরিবহন সমস্যার সমাধান:

যেসব অঞ্চলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই, সেখানে ছাত্রদের জন্য বাইসাইকেল, স্কুটার বা রাইড-শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। গাড়ি কেনার সামর্থ্য থাকলে তারা ব্যবহার করা গাড়ি কিনতে পারে বা গাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করতে পারে। ক্যাম্পাসের কাছে বাসা ভাড়া নেয়ার চেষ্টা করাও হতে পারে একটি সমাধান।

৭. ফ্রি-রাইটিং এবং প্যারাফ্রেজিং দক্ষতা বাড়ানো:

ছাত্রদের নিয়মিত ফ্রি-রাইটিং এবং প্যারাফ্রেজিং অনুশীলন করতে হবে। প্রতিদিন কিছু সময় ধরে নিজেদের চিন্তাভাবনা লিখে অনুশীলন করা এবং যে কোনো লেখা নিজের ভাষায় পুনরায় লিখে অনুশীলন করতে হবে। এছাড়া, একাডেমিক লেখা ও রিসার্চ পেপার লিখতে দক্ষতা অর্জনের জন্য উপদেশ নেওয়া এবং বিভিন্ন স্টাইলের লেখার চর্চা করা জরুরি।

৮. গবেষণার জন্য সৃজনশীল চিন্তা ও ট্রাবলশুটিং দক্ষতা অর্জন:

ছাত্রদের গবেষণায় সৃজনশীল চিন্তা ও আইডিয়া প্রস্তাব করার জন্য স্বাধীনভাবে কাজ করার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। তারা নতুন আইডিয়া প্রস্তাব করার জন্য বিভিন্ন সমস্যা বিশ্লেষণ করে সমাধানের চেষ্টা করতে পারে। পাশাপাশি, সুপারভাইজারের উপদেশ নিয়ে নিজের মতো চিন্তা করার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে গবেষণায় তাদের স্বকীয়তা থাকে।

এই ধরণের সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের ধৈর্য্য ও পরিশ্রমের সাথে মানিয়ে চলা এবং সাহায্য নেওয়ার ব্যাপারে সজাগ থাকা উচিত।

বিদ্র: ফেসবুক থেকে সংগ্রহীত———-https://www.facebook.com/share/p/15W4Po5sGk/

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
গবেষণায় হাতে খড়ি

সিজিপিএ ৩.০, কি ভাবছেন? বিদেশে স্কলারশিপ? অবশ্যই হবে- একটু বাড়তি পরিশ্রম দরকার!

প্রফেসর- ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আপনার সিজিপিএ ৩.০,...

গবেষণায় হাতে খড়ি

বিশ্ববিদ্যালয়ে মেন্টরিং সিস্টেম: শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের সেরা উপায়, একদম বিনামূল্যে!

প্রফেসর- ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন...

গবেষণায় হাতে খড়ি

মেয়েদের বিদেশে স্কলারশিপ নিয়ে এমএস বা পিএইচডি করার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য সঠিক প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা!

প্রফেসর- ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের...

গবেষণায় হাতে খড়ি

গবেষণার বিষয়ে কিছুই জানি না, কিভাবে শুরু করবো, কার কাছে যাবো, কিভাবে স্কলারশিপ পাবো?

প্রফেসর- ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের গবেষণার...

গবেষণায় হাতে খড়ি

গবেষণার প্রস্তুতি ছাড়া বিদেশে উচ্চশিক্ষায় নয়!

প্রফেসর- ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণা না শিখে...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.