২৩ বছর আগে পিএইচডি গবেষণার জন্য বিদেশি অধ্যাপকদের কাছে ডাকযোগে চিঠি পাঠিয়ে উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুণতে হতো ড. নওশাদ হককে। আর এখন বাংলাদেশের তরুণেরা ইমেইল ও অনলাইনের মাধ্যমে মুহূর্তেই বিশ্বের অসংখ্য জ্ঞানসংস্থান ও ব্যক্তিবর্গের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে। প্রযুক্তির এই অগ্রগতি ও সুযোগের সদ্ব্যবহারে বিশ্বাসী ড. নওশাদ হক মনে করেন, আজকের শিক্ষার্থীদের জন্য বৈশ্বিক গবেষণার দরজা অনেক বেশি উন্মুক্ত – দরকার শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিএসআইআরও)-এর প্রিন্সিপাল সায়েন্টিস্ট ড. নওশাদ হক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক আলোচনায় তাঁর অভিজ্ঞতা, গবেষণা দর্শন ও উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার পথ নিয়ে কথা বলেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এই ছাত্র আজ আন্তর্জাতিক গবেষণা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত – তবু তাঁর হৃদয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও তরুণদের ভবিষ্যৎ ভাবনা সর্বদা জায়গা করে আছে। পেশাগত জীবনে নিজেকে তিনি পরিচয় দেন একজন “সায়েন্টিস্ট ফর ডেভেলপমেন্ট”, অর্থাৎ যার গবেষণা উন্নয়নের সেবায় নিবেদিত। তাঁর বিশ্বাস, জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে দেশের কিংবা বিশ্বের যেকোনো উপকারে আসতে পারাই একজন গবেষকের সবচেয়ে বড় সফলতা।
বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের কাছে ড. হকের বার্তা স্পষ্ট: গবেষণাকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চাইলে বড় স্বপ্ন দেখো, কঠোর পরিশ্রম আর গভীর কমিটমেন্টকে সঙ্গী করো। নিজে কীভাবে একজন সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে বৈশ্বিক বিজ্ঞানী হয়ে উঠেছেন এবং এই পথে চলতে গিয়ে কী শিখেছেন – সেই গল্প ও পরামর্শই তিনি শেয়ার করেছেন। নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের ভাষাগত দক্ষতা উন্নয়ন, গবেষণার জন্য তহবিল পাওয়া থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত মোটিভেশন – নানা প্রসঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ উঠে এসেছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক ড. নওশাদ হকের নজরে একজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার পথে করণীয়গুলো।
বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া: শিক্ষাযাত্রার প্রথম অধ্যায়
ড. নওশাদ হকের বেড়ে ওঠা ও প্রাথমিক শিক্ষা বাংলাদেশেই। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বনবিদ্যা (ফরেস্ট্রি) বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং পড়াশোনা শেষ করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে এরপর পাড়ি জমান বিদেশে – যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েলস থেকে মাস্টার্স এবং অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অফ সিডনি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন (তিনি ২০০২ সালে তাঁর পিএইচডি শেষ করেছেন)। গবেষণার প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণ তাকে একের পর এক নতুন পরিবেশে কাজের সুযোগ করে দেয়। পিএইচডির পর তিনি তিন বছর নিউজিল্যান্ডের ফরেস্ট্রি রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গবেষণা কর্মে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০০৫ সালে ড. হক অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে সিএসআইআরও-তে যোগ দেন এবং সেদিন থেকে বর্তমান পর্যন্ত সেখানেই বসবাস ও কাজ করছেন।
অস্ট্রেলিয়ায় তিনি ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত গবেষক হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। বর্তমানে ড. নওশাদ হক সিএসআইআরও-তে একটি গবেষণা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যেখানে জ্বালানি, খনন (মাইনিং) ও পরিবেশ সংক্রান্ত অ্যাপ্লাইড রিসার্চ বা প্রয়োগমূলক গবেষণার বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালিত হয়। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি বহু আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও সহকর্মী গবেষককে মেন্টর করেছেন, সহ-তত্ত্বাবধায়ক কিংবা সহ-সুপারভাইজার হিসেবে পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করিয়েছেন এবং বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যবস্থা করেছেন। দেশের বাইরে থেকেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের উপকারে আসতে তিনি সবসময় প্রস্তুত। ড. হক বলেন, “বাংলাদেশ আমাদের হৃদয়ে সবসময় থাকে। আমরা যারা বাইরের দেশে আছি, আমাদের সামান্য পরামর্শ বা জ্ঞান যদি কারও কাজে লাগে, তাতেই আমরা আনন্দিত হবো।” এই সংকল্প থেকেই তিনি সময় পেলেই বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের জন্য নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে দেন, তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দেন এবং নেটওয়ার্ক তৈরি করে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন।
ড. নওশাদ হক বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। মেলবোর্নের আরএমআইটি ইউনিভার্সিটি ও মনাশ ইউনিভার্সিটির গবেষণা কর্মকাণ্ডের সাথে তিনি সম্পৃক্ত, সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটির অ্যাডজাঙ্কট প্রফেসর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এই নেটওয়ার্ক তৈরির পেছনে আছে তাঁর বহুমুখী অভিজ্ঞতা ও আগ্রহের ক্ষেত্রগুলো। নিজেকে তিনি সর্বপ্রথম একজন গবেষক হিসেবেই দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সেই সাথে সামাজিক দায়বদ্ধতাও অনুভব করেন গভীরভাবে: গবেষণার মাধ্যমে উন্নয়নশীল বিশ্বে ইতিবাচক পরিবর্তন আনাই তাঁর লক্ষ্য। এ কারণেই তিনি নিজেকে “উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞানী” বলে থাকেন। সত্যিকার উদ্ভাবন তখনই অর্থবহ হবে, যখন তা সমাজ বা পরিবেশের কোনো উপকারে আসবে – এই বিশ্বাস তাঁর কর্মপ্রেরণার মূলে কাজ করে।
নবায়নযোগ্য শক্তি ও সবুজ প্রযুক্তিতে গবেষণা
ড. নওশাদ হকের গবেষণা ক্ষেত্র অত্যন্ত বিস্তৃত, তবে মূল প্রতিপাদ্য হলো পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও শিল্পপ্রযুক্তি উন্নয়ন, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামানো। হাইড্রোজেন জ্বালানি প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য শক্তির সংরক্ষণ, ইলেকট্রনিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার এবং সবুজ শিল্পায়ন (গ্রিন স্টিল ইত্যাদি) – এসব আধুনিক বিষয়ে তিনি বহুকাল ধরে কাজ করছেন। অস্ট্রেলিয়ায় থাকাকালীন প্রায় এক দশক তিনি হাইড্রোজেন শক্তিবিষয়ক নানা প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। তিনি স্মরণ করেন, সেই সময়টাতে হাইড্রোজেন নিয়ে গবেষণা ছিল অত্যন্ত আকর্ষনীয়: প্রচুর অর্থায়ন এবং সুযোগ-সুবিধা ছিল বলে তাঁদের দল একের পর এক উদ্ভাবনী কাজ করতে পেরেছিল। আজও বিশ্বজুড়ে হাইড্রোজেন অর্থনীতির সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে গবেষণা চলছে এবং ড. হক বিশ্বাস করেন এই ধারা ভবিষ্যতেও জোরদার হবে।
কেন হাইড্রোজেন? ড. হকের ব্যাখ্যা অনুসারে নবায়নযোগ্য শক্তির (যেমন সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ) বড় সমস্যা হলো, এটি ক্রমাগত উত্পাদন হয় না – যেমন রাতের বেলা সৌরবিদ্যুৎ মিলবে না, বাতাস না থাকলে পवनবিদ্যুৎ থেমে যাবে। তাই উৎপাদিত বিদ্যুতের সঞ্চয় বড় চ্যালেঞ্জ। বিদ্যুৎকে দীর্ঘমেয়াদে জমিয়ে রাখার একটি উপায় হলো তাকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তর করা। পানি (H₂O) থেকে ইলেকট্রোলিসিস পদ্ধতিতে বিদ্যুতের মাধ্যমে যদি হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করা যায়, তবে সেই সবুজ হাইড্রোজেন পরে আবার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। সহজভাবে বললে, সূর্যের আলো বা বাতাস থেকে পাওয়া অতিরিক্ত বিদ্যুৎ হাইড্রোজেনে রূপান্তর করে রাখা যায়, পরে প্রয়োজনমতো সেই হাইড্রোজেন পোড়ালে পুনরায় বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে – সাথে নিঃসরণ হবে শুধুই পানি, কোনোরূপ কার্বন ডাই অক্সাইড নয়। জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে এই পদ্ধতি পরিবেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হতে পারে। হাইড্রোজেন-চালিত গাড়ি, ট্রাক, বাস, এমনকি ট্রেন-ট্রামও চালানোর প্রযুক্তি ইতিমধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছে। ব্যাটারি চালিত যানবাহনের তুলনায় হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল যানবাহনে জ্বালানি ভর্তি করা যায় দ্রুত (পেট্রোল পাম্পের মতো হাইড্রোজেন স্টেশন থেকে), আর একমাত্র উপজাত হিসেবে তৈরি হয় পানি – যা একেবারেই দূষণমুক্ত। ড. হক মনে করেন গ্রিন হাইড্রোজেন একদিন বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের সমাধান দিতে পারে, যদিও এখনও এর খরচ অনেক বেশি এবং বাণিজ্যিকভাবে প্রসার সীমিত। তিনি বলেন, প্রযুক্তির খরচ কমাতে ও দক্ষতা বাড়াতে বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার বিজ্ঞানী কাজ করছেন এবং সরকার ও শিল্পখাত এতে বিপুল বিনিয়োগ করছে। ধনী দেশগুলোতেও হাইড্রোজেন এখনো মূলধারার জ্বালানি নয়, তবে ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে।
হাইড্রোজেন ছাড়াও ড. হকের গবেষণার আরেকটি আগ্রহের বিষয় হলো ইলেকট্রনিক বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ও পুনর্ব্যবহার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট টেনে তিনি উল্লেখ করেন, দেশে প্রায় ১৯ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী আছেন, এবং কয়েক বছরের মধ্যেই বহুসংখ্যক ফোন ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার অযোগ্য হয়ে ই-বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। এই ই-বর্জ্যে থাকা মূল্যবান ধাতু ও উপকরণ পুনরুদ্ধার করলে একদিকে পরিবেশদূষণ কমানো যাবে, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হওয়া যাবে। ড. হক স্বপ্ন দেখেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশেই একটি আধুনিক ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠবে যেখানে বিপুল বর্জ্যের মাঝে লুকিয়ে থাকা মূল্যবান ধাতু বের করে কাজে লাগানো হবে, সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। তিনি নিজে অস্ট্রেলিয়ায় এমন একটি প্লান্ট দেখেছেন যেখানে পুরনো কম্পিউটার, মোবাইল প্রভৃতি ভেঙে ধাতু নিষ্কাশন করা হয়। গবেষক হিসেবে তিনি বাংলাদেশের অংশীদারদের সঙ্গে মিলে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তিগত দিক উন্নয়নে কাজ করছেন, যাতে দেশে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়।
গ্রিন স্টিল বা সবুজ ইস্পাত উন্নয়নও ড. হকের গবেষণা কর্মের আরেকটি দিক। বিশ্বের উন্নয়নে ইস্পাত শিল্প অপরিহার্য হলেও প্রচলিত স্টিল কারখানাগুলো বিশাল মাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে ফেলে। একটি বড় স্টিল মিল দেখতে জটিল হলেও মূল চ্যালেঞ্জ একটিই – কীভাবে ইস্পাত উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় জ্বালানি খরচ ও কার্বন নিঃসরণ কমানো যায়। উন্নত বিশ্বে গ্রিন স্টিল নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে যাতে কয়লার পরিবর্তে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার, পুনঃব্যবহারযোগ্য উপকরণ সংযোজন ইত্যাদির মাধ্যমে ইস্পাত শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করা যায়। ড. হকও এ নিয়ে প্রকল্পে অংশ নিয়েছেন এবং বিভিন্ন দেশের স্টিল ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করে জ্ঞান অর্জন করেছেন। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, রিসাইক্লিং ও কার্যকর প্রসেস ডিজাইনের সমন্বয়ে ইস্পাত শিল্পের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো সম্ভব – এবং এ লক্ষ্য অর্জনে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন।
গবেষণার প্রভাব ও পরিবেশগত মূল্যায়ন প্রসঙ্গে ড. হক জোর দিয়ে বলেন, কেবল গবেষণাপত্র প্রকাশ করাই যথেষ্ট নয় – আসল কথা হলো বাস্তব পৃথিবীতে সেই গবেষণার সুফল কতটা পৌঁছাল। কোনো গবেষণা অর্থনৈতিক লাভ বা পরিবেশগত উন্নয়নের মাধ্যমে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে কি না, সেটিই রিসার্চ ইম্প্যাক্ট মূল্যায়নের মূল মানদণ্ড। পরিবেশের ক্ষেত্রে সুফল পরিমাপ করতে ড. হক সব গবেষককে লাইফ সাইকেল অ্যাসেসমেন্ট (LCA) শিখতে উৎসাহিত করেন। সহজ করে বলতে গেলে, একটি প্রযুক্তি বা পণ্যের জীবনচক্রে জ্বালানি ব্যবহার, কার্বন নিঃসরণ, পানির ব্যবহার ও বর্জ্যের পরিমাণ – এই চারটি সূচক কম রাখতে পারলেই তাকে পরিবেশবান্ধব বলা যাবে। তিনি তরুণদের মনে করিয়ে দেন, যে কোনো প্রকল্পের পরিকল্পনায় এই চারটি দিক (Energy, Carbon, Water, Waste) মাথায় রেখে যদি কাজ করা হয়, তাহলে সমাজে ও পরিবেশে টেকসই প্রভাব রাখা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের শক্তির ভবিষ্যৎ ও গবেষণার সক্ষমতা
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও গবেষণা নিয়ে ড. নওশাদ হকের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবভিত্তিক এবং দূরদর্শী। বাংলাদেশের প্রধান বাধা হলো জ্বালানির সীমিত উৎস ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা। তিনি ব্যাখ্যা করেন, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর নিজস্ব জ্বালানির উৎস প্রচুর (কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, সৌর, বায়ু – সবই মজুদ আছে), কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে নিজস্ব জ্বালানি সম্পদের ঘাটতি প্রবল। বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের এখনো বড় অংশ নিতে হয় বিদেশি জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে। উন্নয়নের জন্য ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, তাই ভবিষ্যতের দিকে নজর রেখে এখনই বিকল্প পথ খুঁজতে হবে।
ড. হক মনে করেন, বাংলাদেশের জন্য একক কোনো জ্বালানি সমাধান নেই – মিশ্র পদ্ধতিই পথ প্রদর্শক। অর্থাৎ একই সাথে বিভিন্ন উৎস থেকে শক্তি নিতে হবে এবং ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে হবে। আমাদের দেশে বড় আকারের বায়ুবিদ্যুৎ হয়তো ভূ-গাঠনিক কারণে বাস্তবসম্মত নয়, সৌরবিদ্যুতের জন্য পর্যাপ্ত খোলা জমিও সীমিত; কিন্তু সৃজনশীল উপায়ে যেটুকু সুযোগ আছে, তা পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগাতে হবে। ড. হক প্রস্তাব করেন, বাংলাদেশের বিশাল টেক্সটাইল কারখানাগুলোর ছাদ, সরকারি-বেসরকারি ভবনের অব্যবহৃত ওপরে অংশে সোলার প্যানেল বসানো যেতে পারে। ছোট ছোট বিকেন্দ্রীকৃত সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পও সামগ্রিক উৎপাদনে ভালো যোগান দিতে পারে। একই সাথে জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি, বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদন ইত্যাদিও বিবেচনায় রাখা উচিত। তিনি বলেন, বাস্তবতা হলো রাতারাতি জীবাশ্ম জ্বালানি ত্যাগ করা যাবে না, তবে এখন থেকেই পর্যায়ক্রমে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে পারলে দীর্ঘমেয়াদে লাভ হবে।
হাইড্রোজেন প্রযুক্তির সম্ভাবনা সম্পর্কেও ড. হক আশাবাদী, তবে এটি একদিনে বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা যাবে না বলে সতর্কও করেছেন। উন্নত দেশগুলোতেও সবেমাত্র হাইড্রোজেন অর্থনীতি গড়ে উঠছে; প্রযুক্তি পরিপক্ব ও সুলভ হতে আরও সময় লাগবে। তাই বাংলাদেশের উচিত বৈশ্বিক প্রবণতার দিকে চোখ রাখা এবং এ বিষয়ে নিজস্ব দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে – যখন বিশ্বে হাইড্রোজেন প্রযুক্তি পুরোপুরি কার্যকর হয়ে যাবে, তখন আমরা যেন দ্রুত তা গ্রহণ করতে পারি। এখন থেকেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষকেরা এই খাত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করুক, লোকজনকে জানাক এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ছোটখাটো পরীক্ষামূলক প্রকল্প করুক। সামনে সুযোগ এলে তখন আর পিছিয়ে থাকতে হবে না।”
বাংলাদেশের উন্নয়নে গবেষণা কীভাবে অবদান রাখতে পারে – এ নিয়ে ড. হকের মতামত অত্যন্ত শক্তিশালী। তিনি মনে করেন, দেশের প্রেক্ষাপটে প্রায় প্রতিটি সমস্যাই একটি সম্ভাব্য গবেষণার বিষয়বস্তু, শুধু সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, “যদি কোনো শিক্ষার্থী বাংলাদেশে গবেষণার বিষয় খুঁজে না পায়, তবে তার উচিত গবেষণা ছেড়ে দৌড়ে পালানো! কারণ আমাদের দেশে সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জের অভাব নেই – যানজট, দূষণ, জ্বালানি, কৃষি, স্বাস্থ্য প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ করার মতো শত শত বিষয় রয়েছে। যে কোনো একটি বেছে নিয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে সমাজের উপকারও হবে, নিজেও একজন দক্ষ গবেষক হয়ে উঠতে পারবে।”
গবেষণা-উন্নয়নে বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ড. হক তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে বলেন: যথাক্রমে পরিকাঠামো, মানবসম্পদ এবং অর্থায়ন। উন্নত গবেষণার জন্য অত্যাধুনিক পরীক্ষাগার, যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তিগত সুবিধা দরকার, যা গড়ে তুলতে বিনিয়োগ আবশ্যক। একইসাথে এসব সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের দক্ষতাও বাড়াতে হবে – উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একটি যোগ্য গবেষক সমাজ গড়ে তোলা অপরিহার্য। তৃতীয়ত, গবেষণা চলমান রাখতে যথেষ্ট তহবিল ও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হবে, যাতে গবেষকরা নিরুদ্বেগে কাজ করতে পারেন। এই তিনটির সমন্বয় হলে গবেষণার পরিমাণ ও গুণগত মান দুইই বাড়বে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশই লাভবান হবে।
নিজে বিদেশে থেকেও বাংলাদেশে গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলেছেন ড. হক। তিনি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ গবেষণা পরিচালনা করেন, বাংলাদেশের মেধাবীদের জন্য ওপেনিং খুঁজে বের করেন। বহু মেধাবী তরুণ বিজ্ঞানীকে তিনি স্কলারশিপের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য দেশে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ করে দিয়েছেন। কেউ কেউ তাঁর ল্যাবরেটরিতেই কাজ করছেন কয়েক বছর ধরে, আবার অনেকে বিদেশে কাজ শিখে দেশে ফিরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুফলপ্রাপ্ত জ্ঞান প্রয়োগ করছেন। দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশের সহযোগী গবেষণাগারের সাথেও তিনি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী-গবেষকদের সংযুক্ত করেছেন, যাতে তারা বৈশ্বিক জ্ঞানভান্ডার ব্যবহার করে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারে। এভাবে পরোক্ষভাবে হলেও বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ড. হকের কার্যক্রম একটি ইতিবাচক অবদান রাখছে। তিনি অবশ্য বিনয়ের সাথে বলেন, এটি দলগত প্রচেষ্টার ফল – অনেক ভালো মানুষের সমন্বয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আদান-প্রদান হচ্ছে। তবু উদ্যোগী একদল প্রবাসী গবেষকের চেষ্টায় বাংলাদেশের তরুণরা যদি উন্নত পরিকাঠামো ও দক্ষতার স্বাদ পায়, সেটি দেশের জন্য বড় প্রাপ্তি।
বিদেশে উচ্চশিক্ষা: বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কলারশিপ
বিদেশে পড়তে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কিংবা পর্যাপ্ত তথ্য না জানার কারণে অনেকেই বিভ্রান্তিতে ভোগেন। ড. নওশাদ হক উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশগমন – বিশেষত অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা – বিষয়ে খোলামেলা ও বাস্তবমুখী পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, সঠিক যোগ্যতা ও প্রস্তুতি থাকলে অস্ট্রেলিয়াসহ যেকোনো উন্নত দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়া কঠিন নয়, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নজর দিতে হবে।
প্রথমেই তিনি স্পষ্ট করে দেন, স্নাতক পর্যায়ে (অন্ডারগ্র্যাজুয়েট) ফুল-ফান্ডেড স্কলারশিপ পাওয়া প্রায় অসম্ভব – বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার প্রেক্ষাপটে। খুব সীমিত কিছু সরকারি বৃত্তি (যেমন অস্ট্রেলিয়ান সরকারে পূর্বের কয়েকটি স্কিম) থাকলেও সেগুলো নির্দিষ্ট কোটাভিত্তিক এবং প্রতিযোগিতা তীব্র। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো টিউশন ফি আংশিক মওকুফের সুযোগ দেয়, কিন্তু সম্পূর্ণ অর্থায়নে বিএসসি বা অনার্স করতে যাওয়ার নজির কম। তাই যারা অন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে বিদেশ যেতে চান, তাদের হয় স্বনির্ভর (self-finance) হয়ে বা পার্টিয়াল ফান্ডিং জোগাড় করে পড়ার মানসিক প্রস্তুতি রাখা উচিত। ইউরোপের কিছু দেশে টিউশন ফি তুলনামূলক কম – সেসব জায়গায় ব্যাচেলর করতে পারলে সেটিও একরকম স্কলারশিপ পাওয়ার সামিল। ড. হক বলেন, “আমি জানি না এমন কোনো দেশ আছে কিনা যারা ব্যাচেলর পুরো ফান্ডিং দেয়; সেক্ষেত্রে যেখানে ফি কম এমন দেশ ট্রাই করতে হবে।”
অন্যদিকে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) ও পিএইচডি পর্যায়ে পর্যাপ্ত স্কলারশিপ রয়েছে, বিশেষত গবেষণাভিত্তিক প্রোগ্রামে। অস্ট্রেলিয়াতে মূলত পিএইচডি এবং কিছু ক্ষেত্রে রিসার্চ মাস্টার্সের জন্যই ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ বেশি দেওয়া হয়। তাই কেউ যদি সরাসরি পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদন করতে পারে, সেটিই হবে শ্রেয়তর পথ। ড. হকের পরামর্শ, “ফান্ডিং চাওয়ার ক্ষেত্রে সরাসরি পিএইচডির চেষ্টা করো। মাস্টার্স কোর্সওয়ার্কের জন্য খুব বেশি বৃত্তি নেই।” মাস্টার্স করতে হলেও চেষ্টা করা উচিত গবেষণাসংশ্লিষ্ট কোর্স (যেমন মাস্টার্স বাই রিসার্চ), যাতে ভবিষ্যতে পিএইচডির সোপান হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। অবশ্য যারা সম্পূর্ণ স্বজ্ঞানে নিজের খরচে মাস্টার্স করতে বিদেশ যেতে চান, তাদের জন্য আলাদা গল্প – সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়েরRequirements পূরণ করলেই হয়ে যাবে। স্ব-অর্থায়নে মাস্টার্স করতে চাইলে ভিসার জন্য কমপক্ষে এক বছরের টিউশন ফি এবং এক বছরের জীবিকার খরচ দেখাতে হবে – ড. হক এই বাস্তবতাও তুলে ধরেছেন। এছাড়া ভিসা কর্মকর্তা আপনার অভিপ্রায় যাচাই করতে পারে: সত্যিই কি পড়তে যাচ্ছেন, নাকি ভিন্ন উদ্দেশ্যে – এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা ও সত্যতা প্রমাণ করতে হবে।
অস্ট্রেলিয়ায় বা যে দেশে যাবেন, সেখানে কোথায় পড়বেন তা নির্বাচন করাও গুরুত্বপূর্ণ। ড. হকের মতে, অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ই শিক্ষার মানের দিক থেকে বিশ্বমানের, তাই কোনোটিকে খুব পিছিয়ে রাখা যায় না। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় গ্রুপ অফ এইট (অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জোট) এর অন্তর্ভুক্ত এবং র্যাংকিংয়ে সামান্য এগিয়ে, তবে সামগ্রিক মানের বিচারে বড় পার্থক্য নেই। কাজেই কেউ অস্ট্রেলিয়ায় আসতে চাইলে প্রথমেই নির্দিষ্ট কোন রাজ্যে/শহরে যেতে চায়, তা ঠিক করা উচিত। বড় শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর (মেলবোর্ন, সিডনি, ব্রিসবেন ইত্যাদি) টিউশন ফি তুলনামূলক বেশি, তবে সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজের সুযোগও বেশি মেলে। বিপরীতে দূরবর্তী বা আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফি কম, অনেক সময় স্কলারশিপের সুযোগও বেশি থাকে, কিন্তু ওইসব স্থানে খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ সীমিত হতে পারে। ড. হক উদাহরণ দিয়ে বলেন, নর্দার্ন টেরিটরির চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি একটি আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান – সেখানে ফি কম, স্কলারশিপ মিলতে পারে; কিন্তু মেলবোর্ন বা সিডনির মতো শহুরে পরিবেশ ও চাকরির বাজার সেখানে নেই। আবার আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা কয়েকবছর পড়াশোনা করলে অতিরিক্ত পয়েন্টের কারণে পরবর্তীতে স্থায়ী আবাসনের সুযোগ সহজ হতে পারে। কাজেই শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ অগ্রাধিকার অনুযায়ী এই ভারসাম্যটি বিবেচনা করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেকে বিশ্ব র্যাংকিং নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। ড. হকের অভিমত হলো, র্যাংকিং অতটাও বড় বিষয় নয় যতক্ষণ না আপনার নির্দিষ্ট গবেষণাক্ষেত্রে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো সুবিধা বা বিশেষজ্ঞ আছে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের গণ্ডি পেরোলেই যেকোনো ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটা ক্যারিয়ারের জন্য ইতিবাচক ধাপ (stepping stone) হিসেবে কাজ করবে। পরে চাইলেই সেখান থেকে আরেক ধাপে উন্নতি করা যায়।” অনেক দেশেই একজন শিক্ষার্থী ধাপে ধাপে এগোয় – যেমন ইরানের অনেক শিক্ষার্থী প্রথমে মালয়েশিয়ায় মাস্টার্স করে, সেখান থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকায় পিএইচডি করতে যায়। বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও কেউ সরাসরি টপ র্যাংকের দেশে সুযোগ না পেলে এই পর্যায়ক্রমিক কৌশল নিতে পারে। তবে ড. হক জোর দিয়ে বলেন যে, শেষ পর্যন্ত আপনাকে নিজের লক্ষ্যটা বড় রাখতে হবে – কোথায় গবেষণার মান ভালো শেখা যায় এবং আপনার আগ্রহের সঙ্গে মিল রয়েছে, সেটিই মূল বিবেচ্য।
উচ্চশিক্ষার স্কলারশিপ পেতে কী কী দরকার? ড. হক তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে তিনটি প্রধান যোগ্যতার কথা উল্লেখ করেছেন, যেগুলোর ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক স্কলারশিপ কমিটিগুলো আবেদনকারীদের বিচার করে থাকে:
- অ্যাকাডেমিক ফলাফল: আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল ভাল হওয়া চাই। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কমপক্ষে ক্লাসের শীর্ষ ২০-৩০ শতাংশের মধ্যে থাকা ফল (সিজিপিএ) স্কলারশিপের জন্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো। মেধাতালিকার শীর্ষ ১০%-এ থাকলে আরো ভালো।
- ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা: বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য IELTS/TOEFL যেমন আবশ্যক, তেমনি ভাল স্কোর থাকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ড. হক জানালেন, ভালো আইইএলটিএস স্কোর অনেক সময় একটু দুর্বল একাডেমিক ফলকেও পুষিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি, সেটা তত দেখা হয় না, কিন্তু আপনার ইংরেজির দখল কেমন – সেটি দেখেই অনেক সময় সিদ্ধান্ত হয়। তাই ইংরেজিতে দক্ষতা প্রমাণের পরীক্ষায় ভালো স্কোর করার প্রতি জোর দিতে হবে।
- গবেষণা সক্ষমতার প্রমাণ: বিশেষ করে পিএইচডি করতে চাইলে আপনাকে দেখাতে হবে যে আপনি গবেষণা-পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন। এর সেরা প্রমাণ হলো একটি-দুটি গবেষণা প্রকাশনা (পেপার) থাকা। ড. হক স্বীকার করেন যে স্নাতক পর্যায়ে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনা বের করা চ্যালেঞ্জিং, তবে চেষ্টা করলে ছোটখাটো স্টাডি বা রিভিউ পেপার প্রকাশ করা অসম্ভব নয়। তিনি পরামর্শ দেন, “নামের জন্য নাম লেখানো প্রকাশনা নয়; বরং প্রথম লেখক হিসেবে নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে মৌলিক কাজ করো। ধাপে ধাপে নিজের গবেষণার পোর্টফোলিও তৈরি করো।” হাতে প্রকাশনা না থাকলেও অন্তত থিসিস বা প্রজেক্টের মাধ্যমে গবেষণার অভিজ্ঞতা অর্জন অবশ্যই কাজে লাগবে।
উপরের যোগ্যতাগুলো পূরণ করতে পারলে স্কলারশিপ পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। ড. হক আরও বলেন, ভর্তি ও বৃত্তির জন্য আকর্ষণীয় করে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। তোমার “কেন উচ্চশিক্ষা করতে চাও” – এই গল্পটা পরিষ্কার এবং বিশ্বাসযোগ্য হওয়া উচিত। কোন দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কোন প্রফেসরের সাথে কাজ করতে চাও, সেই পছন্দের পিছনে তোমার যুক্তিগুলো ভাবতে হবে। আবেদনপত্রে বা সুপারভাইজরকে ইমেইলে নিজের লক্ষ্য, আগ্রহ ও শক্তির দিকগুলো নির্দিষ্ট করে তুলে ধরতে হবে। তিনি বলেন, গবেষণায় আন্তরিকভাবে আগ্রহ (passion) আছে এমন ছাত্র-ছাত্রী খুঁজেই অধ্যাপকরা স্কলারশিপ দিতে চান। “তোমাকে প্রমাণ করতে হবে যে তুমি সত্যিই গবেষণা করতে চাও, কেবল বিদেশে যাওয়ার বাহানা নয়,” ড. হকের সতর্কবাণী, “যদি বুঝতে পারি কেউ শুধুই বাইরে আসার জন্য পিএইচডি করতে চাইছে, তাহলে সুপারভাইজার বা ফান্ডিং কর্তৃপক্ষ আগ্রহী হবে না।” অতএব নিজের উৎসাহ-উদ্দীপনা, জিজ্ঞাসু মানসিকতা ও পরিশ্রম করার মানসিক প্রস্তুতি ভালোভাবে প্রকাশ করা জরুরি।
সুপারভাইজার নির্বাচনের প্রসঙ্গে ড. হক পরামর্শ দেন, সম্ভাব্য সুপারভাইজারের গবেষণার ধারা ও সাম্প্রতিক প্রকাশনাগুলো আগে থেকে ভালোভাবে জেনে নিয়ে তবেই যোগাযোগ করতে। তাঁর ভাষায়, “দেখো সাম্প্রতিক কি কাজ প্রকাশ হচ্ছে তোমার ডিসিপ্লিনে। যে দিকে ফান্ডিং বেশি, যেসব থিম এখন হট – সেদিকে নজর দাও।” এতে একদিকে নিজেই বুঝতে পারবে বৈশ্বিক গবেষণার প্রবণতা কী, অন্যদিকে অধ্যাপককে ইমেইল করার সময় বলতে পারবে কীভাবে তাঁর চলমান কাজের সাথে তোমার আগ্রহ মেলে। ইমেইলে নিজের যোগ্যতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সংক্ষেপে লেখার সময় ইংরেজির দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আবেদনকারীর IELTS/TOEFL স্কোর সুপারভাইজার দেখেন – অনেক সময় আগে থেকে পরীক্ষা দিয়ে স্কোর জানা থাকলে সেটি উল্লেখ করা ভালো। ড. হক স্পষ্ট করে বলেন, “IELTS ছাড়া কেউ যদি ইমেইল করে, খুব সম্ভবত সেটা সুপারভাইজারের নজরেই পড়বে না।” অতএব ইংরেজির প্রস্তুতি টেস্টের আগেই সেরে রাখা এবং ভাল স্কোরসহ যোগাযোগ শুরু করা বুদ্ধিমানের কাজ।
ড. হক শিক্ষার্থীদের একটি বাস্তববাদী মানসিকতা পোষণের আহ্বান জানান: প্রথম কয়েকবারেই সাফল্য নাও আসতে পারে, কিন্তু হতোদ্যম হওয়া চলবে না। বেশ কিছু সুপারভাইজারকে ইমেইল করতে হতে পারে, ২-৩টি আবেদন বাতিলও হতে পারে – এতে দমে না গিয়ে ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, আজকাল পিএইচডি স্কলারশিপের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে, তবে আবেদনকারীও অনেক বেশি এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা তীব্র। এর মধ্যে বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরাও ভালো করছে; সুযোগও পাচ্ছে। তাই নিজের উপর আস্থা রেখে চেষ্টা চালিয়ে গেলে একসময় ভালো ফল আসবেই। সবচেয়ে বড় কথা, যা করো মন থেকে করতে হবে – তাহলেই তুমি নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে।
গবেষকের মানসিকতা ও প্রস্তুতি: ভাষা, দক্ষতা ও পরিশ্রম
গবেষণার পথ সহজ নয়, কিন্তু সঠিক মানসিকতা ও দক্ষতা অর্জন করলে সেই পথ সুগম হয়। ড. নওশাদ হক তরুণদের মধ্যে বিশেষ কয়েকটি দক্ষতা ও অভ্যাস গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথমেই আসে ভাষাগত সক্ষমতা ও যোগাযোগের দক্ষতা – বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা আধুনিক উচ্চশিক্ষার জন্য অপরিহার্য। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন যে ইংরেজির পিছনে সময় ও শ্রম দেওয়া একদম শুরু থেকেই শুরু করা দরকার। উচ্চবিদ্যালয়ের এক ছাত্র প্রশ্ন করেছিল, এখন থেকে কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করা উচিত – জবাবে ড. হকের পরামর্শ ছিল, “প্রতিদিন ইংরেজিতে কিছু না কিছু করবে। দশটা নতুন শব্দ শিখবে, ইংরেজি খবর শুনবে, পড়বে। যা করো প্রতিদিন করো, ধৈর্য ধরে করো।” তিনি নিজের উদাহরণ দিয়ে বললেন যে গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করার কারণে তাঁরও ইংরেজি দখল খুব দুর্বল ছিল, উচ্চারণে এখনো দেশি টান রয়ে গেছে; কিন্তু চেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিদিনের নিয়মিত অনুশীলনই একমাত্র উপায় যার মাধ্যমে ধীরে ধীরে ভাষায় পোক্ত হওয়া যায়।
ইংরেজিতে দক্ষ হতে ড. হক কিছু ব্যবহারিক পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, যে দেশে পড়তে যেতে চাও সে দেশের সংবাদমাধ্যম অনুসরণ করো – ধরো অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে ABC News নিয়মিত শুনতে পারো, ব্রিটিশ উচ্চারণের জন্য BBC, আমেরিকার জন্য CNN বা অনলাইন অন্য পডকাস্ট। এতে শ্রবণ দক্ষতা বাড়বে, নানা অ্যাকসেন্ট কানে পরিচিত হবে। পড়ার অভ্যাস বাড়াতে তিনি বিভিন্ন দেশের ইংরেজি পত্রিকা পড়ার পরামর্শ দেন: চায়না ডেইলি, হিন্দুস্তান টাইমস, ডন (পাকিস্তান), কোরিয়া টাইমস, জাপান টাইমস, নিউইয়র্ক টাইমস সহ বিশ্বের প্রধান প্রধান পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ চোখ রাখা যেতে পারে। এই বহুমুখী পাঠ আপনার জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করবে, দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করবে। সবচেয়ে বড় কথা, নিজেকে প্রতিদিন একটু একটু করে চ্যালেঞ্জ করতে হবে ইংরেজিতে – হোক তা শোনা, বলা, পড়া বা লেখা। দিনের শুরুতে ১০ মিনিটও যদি ইংরেজির চর্চা করা যায়, সময়ের সাথে সাথে তা বিশাল পার্থক্য গড়ে দেবে। এ অভ্যাসটিকে কঠোর শৃঙ্খলার সাথে মেনে চলতে হবে যেন এটি আপনার রুটিনের অংশ হয়ে যায়।
উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতির জন্য একাডেমিক লেখার দক্ষতাও (academic writing) গুরুত্বপূর্ণ । ড. হক লক্ষ্য করেছেন, আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই ভালোভাবে রিপোর্ট লেখতে বা প্রেজেন্টেশন দিতে জানে না, কারণ সেই অনুশীলন তারা করে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই সুযোগ পেলেই বড় আকারের রিপোর্ট তৈরির অভ্যাস করতে বলেন তিনি। ফাইনাল ইয়ার থিসিস, প্রজেক্ট রিপোর্ট বা কোনো প্রতিযোগিতা – যা কিছু লেখার সুযোগ আসে, সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে পরিশীলিত লেখার কাজ হিসেবে নাও। যদি বাধ্যতামূলক বড় প্রজেক্ট না থাকে, নিজের উদ্যোগে এমন কিছু করো যাতে লিখতে হয়, বিশ্লেষণ করতে হয়। ড. হক বলেন, “লেখার মাধ্যমে তুমি অনেক শিখবে, এবং ভবিষ্যতে কেউ জিজ্ঞেস করলে দেখাতে পারবে যে এই কাজটি আমি করেছি।” একটি ভালো লেখা কেবল গ্রেড পাওয়ার জন্য নয়, তোমার যোগাযোগ দক্ষতা ও বিশ্লেষণক্ষমতা প্রমাণের দলিল হিসেবেও কাজ করে, যা ইন্টারভিউতে বা পরবর্তী পড়াশোনায় কাজে লাগবে।
সফট স্কিল বা নরম দক্ষতা তৈরির বিষয়টিও ড. হক বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করা এবং নিজের কাজ একা একা করে যাওয়ার বাইরে, বাস্তব দুনিয়ায় টিকে থাকতে দরকার দলগত কাজের সক্ষমতা, যোগাযোগ ও নেতৃত্বের গুণাবলি। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি দলবদ্ধভাবে কাজ করার অভ্যাসের ঘাটতি দেখেছেন। অথচ বাইরে পড়াশোনা বা গবেষণায় বারবার টিমওয়ার্কের প্রয়োজন পড়ে। তাই তরুণ বয়স থেকেই যতটা পারা যায় বিভিন্ন দলে কাজ করার সুযোগ নাও – হোক তা কোন প্রজেক্ট দল, বিতর্ক ক্লাব, বিজ্ঞান ক্লাব বা স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম। দলগত কাজ, সহযোগিতার মনোভাব, আত্মবিশ্বাস এবং নেতৃত্বদানের অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হবে। ড. হক বলেন, ভর্তির সময় বা চাকরির ইন্টারভিউতে এ ধরনের সফট স্কিল যাচাই করা হয়। প্রার্থীকে জিজ্ঞেস করা হতে পারে, “কোন পরিস্থিতিতে তোমাকে নেতৃত্ব নিতে হয়েছে এবং কী সিদ্ধান্ত নিয়েছ?” – এরকম প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারলে বোঝা যায় নেতৃত্বগুণ অনুপস্থিত। তাই যত আগে এসব অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়, তত মঙ্গল। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের তিনি একই পরামর্শ দেন: পাঠ্যপুস্তকের পড়ার বাইরে সহ-পাঠ্য কার্যক্রমে অংশ নাও, দলবদ্ধ প্রকল্প করো, কোথাও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করো। এসব অভিজ্ঞতা তোমার ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতার পরিধি বাড়াবে।
গবেষণা বা প্রকৌশলবিদ্যায় ভবিষ্যৎ গড়তে চাইলে কারিগরি দক্ষতা বিশেষত বিভিন্ন সফটওয়্যার ও সরঞ্জাম চালনার দিকেও মনোযোগী হতে হবে। ড. হক বলেন, আজকাল প্রায় প্রতিটি বিষয়ের সাথেই বিশেষ কিছু কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয় – যেমন রসায়ন প্রকৌশলে Aspen, হাইড্রোলজিতে HEC-RAS/HEC-HMS, ডেটা অ্যানালিসিসে Python/Matlab ইত্যাদি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্লাসে সবকিছু শিখিয়ে দেওয়া হয় না, অনেককিছু নিজে নিজে শিখতে হয়। যে ফিল্ডেই থাকো, চেষ্টা করো অন্তত একটি গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যারে নিজেকে দক্ষ (proficient) করে তুলতে। অনলাইনে এখন অসংখ্য কোর্স, টিউটোরিয়াল ফ্রি পাওয়া যায় – সেগুলো অনুসরণ করে নিজের উদ্যোগে প্র্যাকটিস করো। উদাহরণস্বরূপ, যদি তুমি কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ো, Aspen Plus বা অনুরূপ প্রসেস সিমুলেশন টুল নিজে নিজে ইন্সটল করে ছোটখাটো মডেল বানানো শিখে ফেলো। যন্ত্রকৌশলে থাকলে AutoCAD/SolidWorks আয়ত্তে আনো। ড. হক বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ হাতে ধরে শেখাবে না – নিজেকে নিজে শেখার মানসিকতা থাকতে হবে।” একটি প্রোজেক্টে ঐ সফটওয়্যার ব্যবহার করে কিছু করেছ এমন প্রমাণপত্র (যেমন রিপোর্ট বা প্রেজেন্টেশন) থাকলে তোমার সিভি বহুগুণে শক্তিশালী হবে। বিদেশে নিয়োগকর্তা বা অধ্যাপকরা সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, অমুক সফটওয়্যারে অভিজ্ঞতা আছে কিনা। তখন তুমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারবে যে, হ্যাঁ – আমি এই এই কাজ করেছি ওর মধ্যে। এই এক দক্ষতাই তোমার স্কলারশিপ ও চাকরির সম্ভাবনা অনেক বাড়িয়ে দেবে।
অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে আসা আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের জন্য সিএসআইআরও প্রতি বছর একটি Vacation Scholarship প্রোগ্রাম চালায়, যেখানে সেকেন্ড ইয়ার থেকে শুরু করে ফাইনাল ইয়ার পর্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীরা ৮-১২ সপ্তাহের জন্য গবেষণা ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ পায়। ড. হক আগে প্রতি বছরই তাঁর বিভাগে কয়েকজন করে ছাত্র নিতেন এই ইন্টার্ন হিসেবে; এখন কাজের চাপ বাড়ায় কম নিয়েও এখনো সুযোগ দেন। যারা ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তারা এই ধরণের ইন্টার্নশিপ সুযোগগুলো অবশ্যই কাজে লাগাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। আগ্রহীরা গুগল করে দেখে নিতে পারে সিএসআইআরও বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকেশন স্কলারশিপে কী কী প্রকল্প প্রতি বছর দেওয়া হয়। তিনি বলেন, যেসব বছরে জ্বালানি বা টেকসই প্রযুক্তি ফোকাস হয়, দেখা যাবে এ সংক্রান্ত অনেক প্রজেক্ট দেওয়া হচ্ছে; আবার আইটি বা অন্য বিষয় ফোকাস হলে অন্য প্রকল্প থাকে। সেখান থেকে নিজের পছন্দমতো বিষয় বেছে নিয়ে আগেভাগে পড়াশোনা করে নিজেকে প্রস্তুত রাখলে আবেদন করে সহজেই জায়গা করে নেওয়া যায়। এমন ইন্টার্নশিপ বা গবেষণার অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে ফুল স্কলারশিপ পাওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক কাজে লাগে।
শেষে ড. নওশাদ হক তরুণদের জন্য কিছু সতর্কবার্তাও উচ্চারণ করেন। আজকাল উচ্চশিক্ষা ও ইমিগ্রেশন নিয়ে ইন্টারনেটে অনেক তথাকথিত পরামর্শক ও এজেন্ট দেখা যায়, যারা নানা ধরনের লোভনীয় অফার দেয় কিংবা টাকার বিনিময়ে পরামর্শ দেয়।
তিনি বলেন, “যদি কেউ নিঃস্বার্থভাবে পরামর্শ দেয় তো ভালো, কিন্তু যারা টাকার জন্য করে তাদের বেশিরভাগই ভুয়া বা বানোয়াট তথ্য দেয়।” ভিসা প্রসেসিং, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন ইত্যাদি ব্যাপারে বর্তমানে সব তথ্য অনলাইনে উন্মুক্ত – ইমিগ্রেশন দপ্তরের ওয়েবসাইট ও ইউনিভার্সিটির নিজস্ব নির্দেশিকা মন দিয়ে পড়লে নিজেই আবেদন ও প্রস্তুতির সবকিছু করা সম্ভব। অন্যের মুখের কথায় চলার চেয়ে নিজে যাচাই করে নেওয়া অনেক নিরাপদ।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, যে শিক্ষার্থী নিজে পড়ে, রিসার্চ করে, বুঝে বিদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেয় – সে এখানে টিকে যাবে। কিন্তু যে না বুঝে কেবল অন্যের প্রলোভনে পড়ে আসে, তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। কাজেই নিজের দিকনির্দেশনা নিজেই ঠিক করো, তথ্যসূত্র ঠিকঠাক যাচাই করো।
নতুন প্রজন্মের জন্য বার্তা: স্বপ্ন, পরিশ্রম ও সাফল্য
ড. নওশাদ হকের জীবনকথা এবং পরামর্শগুলো এক সুতায় গাঁথা – তা হলো কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও সঠিক দিকনির্দেশনাই স্বপ্ন পূরণের চাবিকাঠি। চট্টগ্রামের এক সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে তিনি আজ অস্ট্রেলিয়ার বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ বিজ্ঞানী; এই যাত্রাপথে নানা চ্যালেঞ্জ এসেছে, কিন্তু শেখার আগ্রহ হারাননি কখনও। দেশের বাইরে গিয়েও নিজের শিকড় ও পরিচয় ভুলে যাননি – বরং দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেছেন প্রতিনিয়ত। দেশের উজ্জ্বল তরুণদের তিনি বিশ্বমানের গবেষণায় দেখতে চান এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে তাঁদের সহযোগিতা করে যেতে চান।
তরুণদের জন্য তাঁর মূল বার্তা হলো: আত্মবিশ্বাস হারিয়ো না, নিয়মিত পরিশ্রম করো এবং লক্ষ্য থেকে নজর সরিয়ো না। বড় সাফল্য একদিনে আসে না, কিন্তু প্রতিদিনের ছোট ছোট অগ্রগতি একত্র হয়ে একদিন বড় সফলতা এনে দেয়। তিনি বলেন, জ্ঞান বা মেধা যতই থাকুক, পরিশ্রমের বিকল্প নেই – “Genius without hard work is a tragedy,” উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। অনেক সময় গড়পড়তা ছাত্রছাত্রীরাই দেখা যায় বেশি উন্নতি করছে, কারণ তারা পরিশ্রম ও নিবেদন বেশি দেয়। অন্যদিকে অত্যন্ত মেধাবী কেউ যদি চেষ্টা না করে, তাহলে তার প্রতিভাই বৃথা যায়। তাই নিজের স্বপ্নপূরণে কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে এবং কোনোক্রমেই হাল ছাড়লে চলবে না।
সাংবাদিকতা কিংবা বিজ্ঞান – যেকোনো পেশাতেই সাফল্যের জন্য কম-বেশি একই গুণাবলি দরকার হয়। ড. নওশাদ হক বাংলাদেশের উদীয়মান মেধাবীদের মধ্যে সেই দৃঢ়তা, ধৈর্য ও সততার চর্চা দেখতে চান। তিনি আশাবাদী যে সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে এবং নিজেরাও যত্নবান হলে বাংলাদেশের তরুণরাই একদিন দেশের জ্বালানি সংকট সমাধান করবে, দেশেই নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির উদ্ভাবন করবে, আন্তর্জাতিক গবেষণায় নেতৃত্ব দেবে। আলোচনার শেষে ড. হক অংশগ্রহণকারী সকলকে শুভকামনা জানিয়ে বলেন, “ধৈর্য ধরে চেষ্টা করে যাও, ফোকাস নিয়ে কাজ করো – একদিন না একদিন সফলতা আসবেই।” সেই সাফল্যের গল্পগুলো হয়তো আগামী দিনে আরও বহু নতুন স্বপ্নবাজকে বিজ্ঞান ও উচ্চশিক্ষার পথে অনুপ্রাণিত করবে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে পড়ুক বাংলাদেশের মেধার আলোকচ্ছটা – এই প্রত্যাশাই করি।
ড. নওশাদ হক এর সাক্ষাৎকারের ভিডিওটি ইউটিউবে নিম্নের লিংক এ দেখুন:
অনুষ্ঠানটিতে উপস্থাপক ছিলেন বিজ্ঞানী অর্গ এর ভলেন্টিয়ার তাহসিন আহমেদ সুপ্তি। অনুষ্ঠানটি ১০ ডিসেম্বর ২০২৫ এ অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। সার্বিকভাবে অনুষ্ঠানটি সমন্বয় করার জন্য বিজ্ঞানী অর্গ এর পক্ষ থেকে মহিউদ্দিন এবং তাহসিনুর রাইয়ান কে বিশেষভাবে ধন্যবাদ।

Leave a comment