বিজ্ঞান বিষয়ক খবরমহাকাশ

চাঁদের বুকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র: বিজ্ঞানের নামে শক্তির খেলা?

Share
Share

নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ | [email protected]

চাঁদের মাটিতে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র—শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনে হতে পারে কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, অথবা হয়তো কোনো দুঃসাহসী ভবিষ্যদ্বাণী। কিন্তু না, এটি এখন আর কেবল কল্পনার জগতে সীমাবদ্ধ নেই। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা এক নতুন নির্দেশনা জারি করেছে, যেখানে বলা হয়েছে—চাঁদের বুকে একটি পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং ২০২৯ সালের মধ্যেই সেটিকে চাঁদে পাঠানোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে।

এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক প্রয়োজন যতটা, তার চেয়ে বেশি রয়েছে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। চীন ও রাশিয়ার একটি যৌথ প্রকল্পের কথা শোনা যাচ্ছে, যেখানে তারা চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি একটি পারমাণবিক-চালিত ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। এই অঞ্চলটিতে সূর্যের আলো খুব কম পৌঁছায়, ফলে এখানে রয়েছে স্থায়ী ছায়া, আর সেই ছায়ার গভীরে রয়েছে বহুমূল্য পানি বরফের মজুত। এই বরফ ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানে পানি ও অক্সিজেনের উৎস হতে পারে, এমনকি রকেট জ্বালানিও উৎপন্ন করা যেতে পারে। তাই এই অঞ্চলকে ঘিরে চলছে এক ধরনের ‘লুনার রেস’—একটি নীরব, কিন্তু তীব্র প্রতিযোগিতা।

নাসার তত্ত্বাবধায়ক অ্যাডমিনিস্ট্রেটর শন ডাফি—যিনি এক সময় ফক্স নিউজে উপস্থাপক ছিলেন এবং এখন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন দপ্তরের প্রধান—এই প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার নির্দেশনায় বলা হয়েছে, চাঁদে পাঠানো হবে এমন একটি পারমাণবিক চুল্লি, যা অন্তত ১০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। তুলনামূলকভাবে, ২০২২ সালে নাসা যে তিনটি কোম্পানিকে ৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি দিয়েছিল, তাদের পরিকল্পিত চুল্লিগুলো ছিল মাত্র ৪০ কিলোওয়াট ক্ষমতার।

চাঁদের রাত চলে প্রায় দুই সপ্তাহ, আর সে সময় তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাংকের বহু নিচে। সৌর শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে সেই সময় টিকে থাকা কঠিন। সে জন্যই পারমাণবিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই চুল্লি কাদের সেবা দেবে? কারণ নাসার আর্টেমিস প্রকল্পের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। ২০২৭ সালে আর্টেমিস থ্রি মিশনে চাঁদে মানুষের পা রাখার পরিকল্পনা থাকলেও, স্পেসএক্সের স্টারশিপ ভিত্তিক ল্যান্ডার এখনো নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সময়মতো উৎক্ষেপণ না হলে, পুরো প্রকল্পই অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে।

তবে শুধু প্রযুক্তি বা আবহাওয়া নয়, আইনগত দিক দিয়েও এই উদ্যোগ বিতর্কিত। ১৯৬৭ সালের জাতিসংঘের ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’ অনুযায়ী, কোনো দেশ বা ব্যক্তি মহাকাশের কোনো অংশের মালিক হতে পারবে না। কিন্তু সেই চুক্তিতে বলা আছে—যে কেউ আগে সেখানে বসতি গড়ে তুললে, অন্যদের সেটির প্রতি ‘যথাযথ সম্মান’ দেখাতে হবে। এই শর্তকে কাজে লাগিয়ে অনেকে বলছেন, পারমাণবিক চুল্লি বসানোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র কার্যত একটি ‘keep-out zone’ তৈরি করতে চাইছে, যেখানে অন্যদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা যাবে।

নাসার এই পারমাণবিক উদ্যোগ তাই অনেকের কাছেই এক পাথরে দুই পাখি মারার পরিকল্পনা মনে হচ্ছে—একদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, অন্যদিকে কৌশলগত দখলদারি। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো, এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার সঙ্গে হোয়াইট হাউসের বিজ্ঞানবিরোধী নীতির একটি দ্বন্দ্ব রয়েছে। যেমন, ২০২৬ সালের বাজেটে নাসার বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রমে বড় ধরনের কাটছাঁটের প্রস্তাব এসেছে। এমনকি পারমাণবিক রকেট প্রযুক্তি নিয়ে প্রতিরক্ষা বিভাগ ও নাসার যৌথ গবেষণার অর্থও পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

এর পাশাপাশি, যেসব রোবোটিক মিশনে বড় চুল্লির দরকার নেই—যেমন সৌরজগতের দূরবর্তী গ্রহগুলিতে পাঠানো ছোট যান—সেসবের জন্য ব্যবহৃত রেডিওআইসোটোপ শক্তি উৎস ব্যবস্থাও বন্ধ করার উদ্যোগ চলছে। অথচ এগুলো হলো এমন প্রযুক্তি যা অনেক বছর ধরে বিশ্বকে নতুন গ্রহ ও চাঁদ সম্পর্কে অমূল্য তথ্য দিয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে নাসার নতুন পারমাণবিক উদ্যোগ যেন এক ধরনের রাজনৈতিক বার্তা। এটি একদিকে চীন-রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতিক্রিয়া, আবার অন্যদিকে ভবিষ্যৎ প্রশাসনদের জন্য এক রকম ‘fait accompli’—যেন বলা হচ্ছে, “আমরা শুরু করে ফেলেছি, এখন আর পেছাতে পারবে না।”

তবে বিজ্ঞানীরাও দ্বিধায় আছেন। এমন বড় চুল্লি বসিয়ে কী চালানো হবে? যদি আর্টেমিস থ্রি পিছিয়ে যায়, যদি চাঁদের পৃষ্ঠে মানুষ না যায়, তবে এই বিদ্যুৎ যাবে কোথায়? না কি কেবল ‘প্রতীকী’ভাবে ক্ষমতা দেখানোই এর আসল লক্ষ্য?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো অজানা। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার—মহাকাশ এখন আর নিছক অনুসন্ধান ও আবিষ্কারের জায়গা নয়। এটি হয়ে উঠছে এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে প্রযুক্তির আবরণে ঢেকে আছে শক্তির লড়াই। বিজ্ঞান ও রাজনীতির এই দ্বৈরথ আমাদের ভাবিয়ে তোলে: আমরা কি সত্যিই মহাকাশে জানার জন্য যাচ্ছি, নাকি আধিপত্য স্থাপনের জন্য?

চাঁদের নির্জনতায় একটি পারমাণবিক চুল্লি শুধু বিদ্যুৎ নয়, বহন করবে মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রতিযোগিতা, আর ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিচ্ছবি। এই পদক্ষেপ বিজ্ঞানের জয় না কি কেবল এক নতুন যুগের ভূ-রাজনীতির সূচনা—এই প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে। তবে এখনই আমাদের সতর্ক হয়ে ভাবতে হবে, বিজ্ঞানকে কীভাবে আমরা মানবতার কল্যাণে কাজে লাগাবো, আর কোথায় আমরা সেটিকে রাজনীতির হাতিয়ার করে তুলবো।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
পরিবেশ ও পৃথিবীবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

মরুভূমির পাথরে উটের গল্প: ইসলামী ঐতিহ্যের আলোয় এক প্রত্নআবিষ্কার

প্রাচীন সভ্যতার সাথে ইসলামী ঐতিহ্যের সংযোগ স্থাপনকারী আরবের ১২,০০০ বছরের পুরনো উটের...

বিজ্ঞানীদের জীবনীমহাকাশ

চাঁদের পথে নারীর পদচিহ্ন: কেনেডি স্পেস সেন্টারের প্রথম নারী প্রকৌশলী ও মহাকাশে নারীর অগ্রযাত্রা

অ্যাপোলো ১১-এর সময় কেনেডি স্পেস সেন্টারে নাসার প্রথম মহিলা প্রকৌশলী জোঅ্যান মরগানের...

পদার্থবিদ্যাবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বলের রহস্য উদঘাটনের নতুন যুগ

বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী পারমাণবিক বলের দীর্ঘস্থায়ী রহস্য উন্মোচন করেছেন, কীভাবে কোয়ার্ক এবং গ্লুয়ন...

বিজ্ঞান বিষয়ক খবরমহাকাশ

ভিনগ্রহের সূর্যজগতের জন্ম প্রত্যক্ষ করলেন জ্যোতির্বিদরা: আমাদের সৌরজগতের অতীত বোঝার এক নতুন জানালা খুলে গেল

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ১৪০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত তরুণ নক্ষত্র HOPS-315 এর চারপাশে একটি নতুন...

পরিবেশ ও পৃথিবীবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

সুন্দরবনের ভৌগোলিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপট।

সুন্দরবনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বেঁচে থাকার...

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org