গবেষকদের যন্ত্রপাতি

কাজী মোতাহার হোসেন: পরিসংখ্যানের অগ্রদূত, বহুমুখী প্রতিভার উজ্জ্বল নক্ষত্র

Share
Share

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁদের অবদান একক কোনো পরিচয়ে বাঁধা যায় না। বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংগঠন কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন—প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁদের ছাপ এত গভীর যে, একটিকে আরেকটির থেকে আলাদা করে দেখা যায় না। কাজী মোতাহার হোসেন এমনই এক বিরল প্রতিভা, যিনি একাধারে ছিলেন পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানলেখক, ভাষাসৈনিক, সংগঠক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলার বৌদ্ধিক জাগরণের যাঁরা ভিত রচনা করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন তিনি।

১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই খুলনার বাগেরহাটে জন্মগ্রহণ করেন কাজী মোতাহার হোসেন। শৈশব কেটেছে নদী-নালা আর সবুজে ঘেরা গ্রামীণ পরিবেশে। তাঁর পিতা কাজী ফজলুর রহমান ছিলেন সংস্কৃতিমনা মানুষ; মাতা সুনিপুণ গৃহিণী, যিনি ছোটবেলা থেকেই ছেলেকে জ্ঞানচর্চার প্রতি অনুরাগী করে তোলেন। প্রাথমিক শিক্ষার পর তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন এবং সেখানেই কিশোর বয়সে গণিতের প্রতি গভীর অনুরাগ জন্ম নেয়।

প্রথাগত মাদ্রাসা শিক্ষার গণ্ডি ছাড়িয়ে মোতাহার হোসেন পা বাড়ান উচ্চশিক্ষার জগতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে অনার্স ও পরে পরিসংখ্যানে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। সে সময়ে পরিসংখ্যান একটি নবীন শাখা; কিন্তু তাঁর মেধা ও নিষ্ঠা এই বিষয়ে বাংলায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ১৯২১ সালে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে তিনি পরিসংখ্যানকে স্বতন্ত্র একাডেমিক শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। বলা হয়, ঢাকায় পরিসংখ্যান বিভাগের যে ভিত্তি তিনি স্থাপন করেছিলেন, তা পরবর্তী কয়েক দশকের গবেষণা ও শিক্ষার মূলভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

তবে তাঁর কাজ শুধু সংখ্যার অঙ্কনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। সাহিত্যচর্চায়ও তিনি সমান স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। সমকালীন সমাজ-রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান নিয়ে তিনি লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আর স্বচ্ছ ভাষাশৈলীতে রচিত তাঁর রচনাগুলো বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। সমসাময়িক সমাজে কুসংস্কার আর অযৌক্তিকতার বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন নির্ভীকভাবে।

কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রজন্মের শিক্ষক যাঁরা পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে সরাসরি বা নেপথ্যে ভূমিকা রাখেন। ছাত্র-শিক্ষক সমাজে তিনি ছিলেন আলোকবর্তিকা; তাঁর তত্ত্বাবধানেই গড়ে ওঠে অনেক প্রজন্মের গণিতবিদ ও গবেষক। একই সঙ্গে তিনি বাঙালি মুসলিম সমাজের বৌদ্ধিক চর্চাকে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

শুধু বিজ্ঞান ও সাহিত্য নয়, সংগঠক হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামপুরা বৈজ্ঞানিক সমিতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজভাবে পৌঁছে দিতে তিনি নিয়মিত লিখেছেন সংবাদপত্রে, বক্তৃতা দিয়েছেন বিভিন্ন সমাবেশে। তাঁর এই প্রচেষ্টার ফলেই বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ভাষা ক্রমে পরিশীলিত হয় এবং এক প্রজন্মের তরুণ-তরুণীর কাছে বিজ্ঞান হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় এক জগৎ।

১৯৮১ সালের ৯ অক্টোবর কাজী মোতাহার হোসেন পরলোকগমন করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি লেখনী ও গবেষণায় সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার ইতিহাসে তাঁর অবদান এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে। তিনি প্রমাণ করে গেছেন—একজন বিজ্ঞানী কেবল গবেষণাগারেই সীমাবদ্ধ নন; সমাজের সংস্কার ভাঙা, যুক্তির আলো ছড়ানো এবং সংস্কৃতির ধারক হওয়াও তাঁর কর্তব্য।

আজও যখন আমরা বাংলায় বিজ্ঞানলেখা কিংবা পরিসংখ্যান শিক্ষার কথা বলি, কাজী মোতাহার হোসেনের নাম উচ্চারণ না করে পারি না। তিনি যেন এক সেতুবন্ধন—যেখানে সংখ্যা, সাহিত্য ও সমাজবোধ এক হয়ে গড়ে তুলেছিল এক বিস্ময়কর সুর। বাংলাদেশের বৌদ্ধিক ইতিহাসে তাই তাঁর নাম থাকবে চিরকাল, এক বহুমাত্রিক আলোকবর্তিকা হিসেবে।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org