একদিন দুপুরে আমার ইন্টারমেডিয়েট লাইফে এমসি কলেজের হোস্টেলে বসে ক্লাসের স্টাডি করছিলাম। হঠাৎই মন খারাপ হতে লাগলো- কোনো কারণ ছাড়াই। এমন না যে কিছু খারাপ হয়েছে, কিন্তু কিছু একটা যেন ঠিক নেই। তারপর মনে পড়লো কিছুদিন ধরে হজমের সমস্যাও হচ্ছে।
এই ছোট্ট ঘটনাটিই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো এক বিস্ময়কর ধারণার সঙ্গে- Gut-Brain Axis, অর্থাৎ অন্ত্র ও মস্তিষ্কের মধ্যে গভীর স্নায়বৈজ্ঞানিক সংযোগ। আধুনিক গবেষণায় বলা হচ্ছে, মানুষের অন্ত্রে থাকা লক্ষ কোটি ব্যাকটেরিয়া শুধু হজমই নয়, আমাদের আবেগ, সিদ্ধান্ত, এমনকি বিষণ্ণতার মতো মানসিক অবস্থাও প্রভাবিত করে!
রিসার্চ পেপার পর্যালোচনা: “The Psychobiotic Revolution” ও Cryan-এর কাজ
২০১১ সালে বিশিষ্ট গবেষক John F. Cryan এবং তার টিম “The Psychobiotic Revolution” প্রবন্ধে দেখান, অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া, বিশেষ করে ‘Lactobacillus’ ও ‘Bifidobacterium’ মানুষের মুড রেগুলেশন, স্ট্রেস রেসপন্স, এবং স্মৃতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তারা উল্লেখ করেন, অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা তৈরি neurotransmitters যেমন serotonin, GABA, ও dopamine সরাসরি মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায়।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো: আমাদের শরীরে উৎপন্ন serotonin-এর ৯০% তৈরি হয় অন্ত্রে। Cryan বলেন, “The gut talks to the brain more than the brain talks to the gut.” এই সিগনালগুলো vagus nerve ব্যবহার করে মস্তিষ্কে পৌঁছায়, যেটা একপ্রকার নিউরোনাল হাইওয়ের মতো কাজ করে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দীর্ঘদিন irritable bowel syndrome (IBS) বা গ্যাস্ট্রো সমস্যায় ভুগছেন, তাদের মধ্যে anxiety ও depression-এর প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এটি প্রমাণ করে, শুধু মানসিক অবস্থা নয়, আমাদের মস্তিষ্কের decision-making, risk-taking behavior এমনকি social interaction-ও অন্ত্রের উপর নির্ভর করতে পারে।
আরও গভীরে: ইনফ্লেমেশন ও ইমিউন রেসপন্সের ভূমিকা
গাট-ব্রেইন অ্যাক্সিস কেবল মাত্র স্নায়ু সংকেতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এখানে ইমিউন সিস্টেম এবং ইনফ্লেমেশনও বড় ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, intestinal permeability বাড়লে (যাকে বলা হয় “leaky gut”) তখন অস্বাভাবিকভাবে কিছু বিষাক্ত অণু রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে।
এই অণুগুলো মস্তিষ্কে পৌঁছে neuroinflammation ঘটায় যা বিষণ্ণতা, অটিজম, এমনকি Alzheimer’s রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যেমন ২০২০ সালে Nature Neuroscience-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, lipopolysaccharides (LPS) নামক অণু, যা কিছু হানিকর ব্যাকটেরিয়া উৎপন্ন করে, তা মস্তিষ্কে প্রবেশ করে microglial cells-কে সক্রিয় করে তোলে। এর ফলে মস্তিষ্কে দীর্ঘমেয়াদী ইনফ্লেমেশন শুরু হয়, যার প্রভাব পড়ে মুড, চিন্তাশক্তি ও আচরণে।
হরমোন ও অন্ত্র: আরও বিস্ময়
অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া শুধু নিউরোট্রান্সমিটার নয়, বিভিন্ন হরমোন নিঃসরণেও ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, গাট মাইক্রোবায়োম cortisol (স্ট্রেস হরমোন), ghrelin (ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী), এমনকি oxytocin-এর (সামাজিক সম্পর্ক গঠনের হরমোন) উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই হজমের ভারসাম্যহীনতা শুধু মুড নয়, আমাদের অভ্যাস, খিদে, এমনকি প্রেম-ভালবাসার অনুভূতিও প্রভাবিত করতে পারে।
কী বোঝা যাচ্ছে?
মানবদেহে “দ্বিতীয় মস্তিষ্ক” হিসেবে পরিচিত gut microbiome শুধু একটি হজমের কারখানা নয়। এটি আমাদের অনুভূতি ও আচরণের অন্যতম পরিচালক। ভবিষ্যতে বিষণ্ণতা বা মানসিক অসুস্থতা চিকিৎসায় শুধু ওষুধ নয়, probiotic-ভিত্তিক থেরাপি হতে পারে একটি বিপ্লবী সমাধান।
এমনকি এখন গবেষকরা psychobiotics নামক একটি নতুন শ্রেণির probiotic নিয়ে কাজ করছেন, যেগুলোর লক্ষ্য থাকবে নির্দিষ্ট মানসিক লক্ষণ উপশম করা। ২০২২ সালের Cell Reports-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, কিছু ব্যাকটেরিয়া এমন ধরনের গন্ধ উৎপন্ন করে যেগুলো সরাসরি limbic system (আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রক মস্তিষ্ক অঞ্চল)-কে উদ্দীপ্ত করতে পারে।
নতুন আলোচনার দিক: Personalized Microbiome Therapy
নতুন গবেষণায় বলা হচ্ছে, প্রত্যেক মানুষের গাট-মাইক্রোবায়োম আলাদা। তাই ভবিষ্যতের চিকিৎসা হতে পারে ব্যক্তিনির্ভর মাইক্রোবায়োম বিশ্লেষণ ও সেই অনুযায়ী প্রো-বায়োটিক বা প্রি-বায়োটিক থেরাপি। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের Harvard Medical School-এর গবেষণায় দেখা যায়, কিছু নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়ার ঘাটতি থাকলে বিষণ্ণতার ওষুধ কাজ করে না। সেই গবেষণায় সুপারিশ করা হয়, বিষণ্ণতার আগে গাট বিশ্লেষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে পারে।
Mental Clarity বা ‘Brain Fog’- অন্ত্রের গভীর ছায়া
একবার কি কখনো এমন হয়েছে- আপনি চোখ খুলে ক্লাসে আছেন, টিচার পড়াচ্ছেন, কিন্তু আপনার মস্তিষ্ক যেন অন্য কোথাও? না, আপনি ক্লান্ত নন, ঘুমিয়েও নেই। কিন্তু মানসিকভাবে যেন কোনো কুয়াশা ঘিরে আছে। এই রহস্যজনক অনুভবটিকে বলে “Brain Fog” একটি মানসিক অস্পষ্টতা, যা decision making, focus, এবং স্মৃতি-ক্ষমতাকে ধীর করে ফেলে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সমস্যা কি নিছক মস্তিষ্কের ব্যাধি? উত্তর: না। আধুনিক নিউরোগ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বলছে, এর শিকড় অনেক সময়ই লুকিয়ে থাকে আমাদের অন্ত্রের ভেতরে বিশেষ করে গাট মাইক্রোবায়োমের ভারসাম্যহীনতায়।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও মাইক্রোবায়োমের ধ্বংস
আজকের দিনের শিক্ষার্থী বা কর্মজীবী মানুষের ডায়েটে প্রচুর পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত খাবার, ট্রান্স ফ্যাট, উচ্চ সুগার এবং কৃত্রিম প্রিজারভেটিভ থাকে। এইসব উপাদান অন্ত্রে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়াদের ধ্বংস করে, এবং ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বাড়ায়।
গবেষণায় (Frontiers in Neuroscience, 2017) দেখা গেছে, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য যারা নিয়মিত খায়, তাদের গাটে ‘Firmicutes’ ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ কমে যায় যারা মূলত শরীরে inflammation রোধ করে এবং মস্তিষ্কে serotonin উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। এই ডাইসবায়োসিস বা অস্বাভাবিক ব্যাকটেরিয়াল ভারসাম্য মানসিক অস্পষ্টতা তৈরি করে।
‘Leaky Gut’ এবং নিউরোইনফ্লেমেশন: সরু সেতু পেরিয়ে বিষণ্ণতা
যখন অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ারা ভারসাম্য হারায়, তখন intestinal permeability বেড়ে যায়। এ অবস্থাকে বলে “Leaky Gut”, যার ফলে খাদ্য বা ব্যাকটেরিয়ার টক্সিন রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে।
এই টক্সিনগুলো (বিশেষ করে lipopolysaccharides বা LPS) যখন মস্তিষ্কে পৌঁছায়, তখন microglial cells (মস্তিষ্কের ইমিউন কোষ) উত্তেজিত হয়ে পড়ে, এবং neuroinflammation শুরু করে। ঠিক তখনই দেখা দেয় “brain fog”, মনোযোগের দুর্বলতা, decision making-এর সমস্যা ইত্যাদি।
একটি বিখ্যাত গবেষণা (Harvard Medical School, 2020) বলছে, IBS বা GI সমস্যা থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে cognitive performance তুলনামূলকভাবে কম, যার পেছনে অন্যতম কারণ এই chronic low-grade inflammation.
স্মৃতির গায়ে ঝাপসা: গাটের হাতছানি
গাট ব্যাকটেরিয়ারা BDNF (Brain-Derived Neurotrophic Factor) নামক একটি নিউরোট্রফিন হরমোনের উৎপাদনে সাহায্য করে। এই হরমোন মস্তিষ্কে নিউরন তৈরিতে এবং স্মৃতি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু যখন গাট ফ্লোরা দুর্বল হয়, তখন BDNF মাত্রা কমে যায়। এতে দেখা দেয় স্মৃতিভ্রংশের ঝুঁকি, কথাবার্তা মনে না থাকা, কিংবা হঠাৎ করে কোনো সহজ জিনিস ভুলে যাওয়া। এইসব লক্ষণগুলো “brain fog”-এর অংশ।
লক্ষণগুলো কীভাবে বোঝা যায়?
১. হঠাৎ করে ক্লাসে মন না বসা, খুব সহজে distraction
২. একটানা পড়তে না পারা, বারবার reread করা
৩. কোনো কথা মনে পড়তে দেরি হওয়া
৪. কথা বলার সময় শব্দ আটকে যাওয়া
৫. মাথা যেন ভারী লাগা, দৃষ্টিতে কুয়াশার মতো অনুভব
কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এই ‘Brain Fog’?
১. প্ল্যান্ট-বেসড খাদ্যাভ্যাস: প্রচুর ফাইবার এবং প্রোবায়োটিক-সমৃদ্ধ খাবার যেমন দই, ফার্মেন্টেড খাবার অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়া বাড়ায়।
২. অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি খাদ্য: হলুদ, আদা, গ্রিন টি ইত্যাদি অন্ত্র ও মস্তিষ্কে ইনফ্লেমেশন কমায়।
মাইন্ডফুলনেস ও মেডিটেশন: গাট-ব্রেইন অ্যাক্সিসে vagus nerve-এর কার্যক্রম উন্নত করে, ফলে মনোযোগ বাড়ে।
অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়া: এতে উপকারী গাট ফ্লোরা নষ্ট হয় না।
কিছু বার্তা : কুয়াশা সরাতে আলো অন্তরে খুঁজুন
‘Brain Fog’ কোনও অলীক মানসিক সমস্যা নয়, এটি আমাদের অন্ত্র থেকে উঠে আসা এক জৈব রাসায়নিক সংকেতের প্রতিফলন। মস্তিষ্ক আর অন্ত্র যেন একটি দুই-মাথার প্রাণী, যেখানে যেকোনো ছোট পরিবর্তনও প্রতিধ্বনি ফেলে অন্য প্রান্তে। ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থা কিংবা কর্মদক্ষতা বাড়াতে তাই গাট-মাইক্রোবায়োমের যত্ন নেওয়া হবে সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত।
আপনার চিন্তা কী বলে?
মো. ইফতেখার হোসেন
চিকিৎসা শিক্ষার্থী, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ | নিউরোসায়েন্স, অভ্যাস গঠন ও মানুষের মস্তিষ্কের আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে আগ্রহী।
Leave a comment