পদার্থবিদ্যাপরিবেশ ও পৃথিবী

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রের ঘূর্ণন ও আকৃতি বদলের ইঙ্গিত

Share
Share

নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
৪ জুন ২০২৫

একটা সময় ছিল, যখন পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কেন্দ্র যেন এক রহস্যঘেরা গুহা—যেখানে মানুষ কোনোদিন পৌঁছাতে পারবে না, জানতে পারবে না সেখানে কী ঘটে। কিন্তু ২০১০ সালের এক অদৃশ্য পরিবর্তন সেই অন্ধকারে এক ঝলক আলো ফেলে দিল। পৃথিবীর একদম গভীরে, ৫১০০ কিলোমিটার নিচে, সূর্যের তাপমাত্রার প্রায় কাছাকাছি উত্তপ্ত একটি কঠিন ধাতব বল—পৃথিবীর ‘inner core’—তার নিজের মতো করে ঘুরছিল। হঠাৎ একদিন সেই ঘূর্ণনের গতি বদলে গেল।

এই গল্প শুরু হয় সাউথ স্যান্ডউইচ দ্বীপপুঞ্জে, যেখানে নিয়মিত ভূমিকম্প ঘটে। ১৯৯১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই ভূমিকম্পগুলোর তরঙ্গের গতিপথ বিশ্লেষণ করছিলেন চীন ও আমেরিকার একদল বিজ্ঞানী। যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার আইলসন আর কানাডার ইয়েলোনাইফের দুটি সিসমিক স্টেশনে তারা সেই তরঙ্গগুলো খুঁটিয়ে দেখছিলেন। বছরের পর বছর ধরে এই তরঙ্গগুলো একটা নির্দিষ্ট নিয়মে পৃথিবীর কেন্দ্র দিয়ে চলে আসছিল। কিন্তু একদিন তারা লক্ষ্য করলেন—সময়টা যেন একটু হেরফের হয়েছে।

এই ‘হেরফের’-এর পেছনে যে সত্যি ঘটনা লুকিয়ে আছে, তা প্রকাশিত হয় Nature Geoscience পত্রিকায়। গবেষক দলের প্রধান, দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন এমিলিও ভিদালে জানালেন—২০১০ সালের দিকে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কেন্দ্র তার ঘূর্ণনের গতি কমিয়ে দেয়। আগে যেখানে এটি পৃথিবীর বাকি অংশের তুলনায় দ্রুত ঘুরছিল, এখন সেটি তুলনামূলক ধীরে চলছিল। এর সঙ্গে যোগ হয় আরও একটি অদ্ভুত বিষয়—কেন্দ্রের আকৃতি বা গঠনে ঘটেছিল বিকৃতি।

গবেষকরা বলছেন, ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট তরঙ্গ পৃথিবীর ভেতরের বিভিন্ন স্তর দিয়ে যাওয়ার সময় যেভাবে গতি ও দিক পরিবর্তন করে, তা এক্স-রে’র মতো করে আমাদের গ্রহের গভীরের চিত্র তুলে ধরে। এই তরঙ্গ বিশ্লেষণ করেই বোঝা গেছে যে অভ্যন্তরীণ কেন্দ্র শুধু ঘূর্ণন নয়, তার গঠনেও পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। এটি ঠিক যেন একজন মানুষের হৃদস্পন্দনের ওঠানামার মতো—যার ছন্দ বুঝতে পারলে জানা যাবে তার ভিতরের অবস্থাও।

ভিদালে বলেন, “সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা হতে পারে, বাইরের কেন্দ্রের চলাচল অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রকে চালিত করে। সময়ের সাথে সাথে তা কেন্দ্রকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলে। তবে এটি কীভাবে হয়, তা আমরা এখনও জানি না।”

অভ্যন্তরীণ কেন্দ্র তৈরি কঠিন ধাতব লোহা ও নিকেল দিয়ে। সেখানে তাপমাত্রা ৫২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং চাপ এমন যে পৃথিবীর গভীরতম সমুদ্রেও তার তুলনা মেলে না। বিজ্ঞানীরা সেখানে পৌঁছাতে পারেন না, তাই ভূমিকম্পের তরঙ্গই তাদের একমাত্র জানালা।

গবেষণায় আরও একটি জটিল দিক সামনে এসেছে—কিছু ভূমিকম্পের তরঙ্গ সময়ে কোনো হেরফের দেখায়নি। এতে ধারণা করা হয়, হয়তো কোনো সময়ে কেন্দ্র থেমে গিয়েছিল বা উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করেছিল। এই আচরণ কী স্বাভাবিক, না কি কিছু নতুন কিছু ঘটছে—তা এখনো নিশ্চিত নয়।

তবে শুধু ঘূর্ণন নয়, অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রের আকৃতিতেও পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করছেন গবেষকরা। বাইরের কেন্দ্রের গঠন বা ম্যান্টেলের ঘনত্বে পরিবর্তনের ফলে অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রে চাপ ও আকারের বদল ঘটতে পারে। বিজ্ঞানীরা এটিকে ‘viscous deformation’ বলে চিহ্নিত করছেন।

এই সব পরিবর্তন হয়তো সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে না। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, এর ফল পড়তে পারে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রে। স্যাটেলাইট, কম্পাস, এমনকি আন্তঃমহাকাশীয় অভিযানের ওপর এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে পারে।

ভবিষ্যতের গবেষণা হয়তো আমাদের জানাবে কোথায় বাইরের কেন্দ্রের চলাচল সবচেয়ে বেশি, কিংবা কোথায় অভ্যন্তরীণ কেন্দ্র তুলনামূলকভাবে বেশি নমনীয়। এমনকি পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের সাথে চৌম্বক ক্ষেত্রের আকস্মিক ‘জার্ক’ বা দোলাচল—যা বহু বছর পরপর ঘটে—তার সম্পর্কও স্পষ্ট হতে পারে।

পৃথিবীর গভীরের এই অনিশ্চিত নাটক যেন এক জীবন্ত কাহিনি—যেখানে প্রতিটি ভূমিকম্প একটি নতুন অধ্যায়ের শুরু, আর প্রতিটি সিসমিক তরঙ্গ একেকটি বার্তা বহন করে নিয়ে আসে আমাদের কাছে। বিজ্ঞানীরা শুধু সেই বার্তাগুলো পড়ার চেষ্টা করছেন, আর আমরা অপেক্ষা করছি নতুন কোনো অজানা আবিষ্কারের।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
পরিবেশ ও পৃথিবীবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংস্থার রিপোর্ট লুকানো চেষ্টা

২০২৪ সালে, CO₂ এর মাত্রা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল, কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন NOAA...

পদার্থবিদ্যামহাকাশ

অদৃশ্য মহাবিশ্ব: যে ৯৫ শতাংশ এখনো অজানা

বাংলায় অন্ধকার মহাবিশ্বের রহস্য অন্বেষণ করুন — অন্ধকার পদার্থ এবং অন্ধকার শক্তি...

পদার্থবিদ্যামহাকাশ

নিঃশব্দ আগুনের নৃত্য: মহাকাশে এক অচেনা শিখার গল্প

মহাকাশের ওজনহীন পরিবেশে আগুন কীভাবে আচরণ করে তা আবিষ্কার করুন। এই গল্পটি...

পদার্থবিদ্যাবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

বিজ্ঞান ভুল পথে? কোয়ান্টাম বলছে ‘হ্যাঁ’—না কি?

কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা কি আমাদের বিপথে ঠেলে দিচ্ছে? নোবেল বিজয়ী জেরার্ড হুফ্ট কোয়ান্টাম...

পরিবেশ ও পৃথিবীসাধারণ বিজ্ঞান

সমুদ্র বনাম গাছ: অক্সিজেন উৎপাদনে কে এগিয়ে?

পৃথিবীর অক্সিজেনের প্রধান উৎস কেন—গাছ নয়—সমুদ্র। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের ভূমিকা এবং তারা কীভাবে গ্রহে...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.