ইলেক্ট্রনিক্সবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

বাংলাদেশী বিজ্ঞানী আবিষ্কার করলো “সত্যিকারের এলোমেলো সংখ্যা” তৈরির সার্কিট

Share
Share

আমরা যখন মোবাইল ফোনে টাকা পাঠাই, ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করি বা কোনো ওয়েবসাইটে লগইন করি—প্রতিবারই আমাদের তথ্য সুরক্ষিত রাখে কিছু অদৃশ্য সংখ্যা। এই সংখ্যা এলোমেলোভাবে তৈরি হয় বলে কেউ তা অনুমান করতে পারে না। কিন্তু প্রকৃত অর্থে “এলোমেলো” সংখ্যা তৈরি করা প্রযুক্তিগতভাবে খুবই কঠিন কাজ। এটি দৈবচয়ন কিংবা র‍্যানডম সংখ্যা নামেও পরিচিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই এলোমেলো যে সংখ্যাগুলো ব্যবহার করা হয়, তা আসলে কম্পিউটারের বানানো কৃত্রিম এলোমেলো সংখ্যা, যাকে বলা হয় pseudo-random number। এগুলো কখনোই পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত নয়, ফলে নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকেই যায়।

এই জটিল সমস্যার এক অভিনব সমাধান দিয়েছেন বাংলাদেশের গবেষক ড. মাহফুজুল ইসলাম। তিনি বর্তমানে ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স টোকিও (Institute of Science Tokyo) ইলেকট্রনিক সার্কিট গবেষণাগার “ইসলাম ল্যাবরেটরি”-এর সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণায় উদ্ভাবিত হয়েছে এমন একটি সার্কিট, যা প্রকৃতির ভৌত নয়েজ বা তাপীয় অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে সত্যিকারের এলোমেলো সংখ্যা তৈরি করতে পারে—যা ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক সাফল্য।

২০২৫ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত IEEE APCCAS আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উদ্ভাবন গৃহীত হয়েছে। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম—“A Booster-Enhanced Mismatch-Canceling Latch-Based True Random Number Generator for High-Speed Operation.” এটি এক অর্থে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। এছাড়া IEEE NEWCAS কনফারেন্সে গ্রীহিত হয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র যার শিরনাম, X. Huang and M. Islam, “High-speed energy-efficient true random number generator using self-compensating comparator,” in IEEE NEWCAS Conference, Jun. 2025, pp. 1–5.

ড. ইসলাম ব্যাখ্যা করেন, প্রচলিত র‌্যান্ডম নাম্বার সার্কিটগুলো প্রায়ই তাপমাত্রা বা ভোল্টেজের সামান্য পরিবর্তনে ভুল কাজ করে। তাঁর উদ্ভাবিত সার্কিটে ব্যবহার করা হয়েছে এক বিশেষ স্বয়ংক্রিয় ক্ষতিপূরণ প্রযুক্তি (self-compensating analog design), যা এই পরিবর্তনগুলোকে নিজেই সনাক্ত করে এবং সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করে নেয়। ফলে সার্কিটটি কাজ করে নির্ভরযোগ্যভাবে, কোনো জটিল ক্যালিব্রেশনের প্রয়োজন হয় না।

আরেকটি বড় সাফল্য হলো এর গতি ও দক্ষতা। সাধারণ সার্কিটগুলো ধীরগতিতে এলোমেলো সংখ্যা তৈরি করত, কিন্তু এই নতুন নকশায় যুক্ত করা হয়েছে “বুস্ট ফেজ” নামের এক অতিরিক্ত ধাপ, যা সার্কিটের কাজের গতি বাড়িয়েছে প্রায় একশ গুণ। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এটি প্রতি সেকেন্ডে এক গিগাবিট (১ বিলিয়ন বিট) এলোমেলো সংখ্যা তৈরি করতে পারে, অথচ শক্তি খরচ করে মাত্র ০.১৬ পিকোজুল প্রতি বিটে। সার্কিটটির আকারও অবিশ্বাস্যভাবে ক্ষুদ্র—মাত্র ৩৮৪ বর্গমাইক্রোমিটার।

এর অর্থ, ভবিষ্যতের স্মার্টফোন, ব্যাংক কার্ড, ক্লাউড সার্ভার এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চিপের মধ্যেও সহজেই এই সার্কিট সংযোজন করা যাবে, যা নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে একেবারে হার্ডওয়্যার স্তরে।

ড. ইসলাম বলেন, “এটি কেবল একটি সার্কিট নয়; এটি এমন একটি প্রযুক্তি, যা নিরাপত্তার ধারণাকেই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। আমরা প্রকৃতির অপ্রত্যাশিততাকেই কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তার সবচেয়ে দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করছি।

বিশ্বজুড়ে তথ্য নিরাপত্তা ও এনক্রিপশন ব্যবস্থায় TRNG এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশি এক গবেষকের এই উদ্ভাবন তাই শুধু বৈজ্ঞানিক অর্জন নয়, বরং বৈশ্বিক সাইবার নিরাপত্তা জগতে বাংলাদেশের অবস্থানকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

বাংলাদেশের ছেলে ড. মাহফুজুল ইসলাম এর জন্ম মুন্সিগঞ্জে। সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে তিনি ২০০২ সনে জাপান সরকারের মনবুশো বৃত্তি পেয়ে জাপানে যান। এরপর তিনি কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্য প্রকৌশলে ডক্টরেট (Ph.D.) ডিগ্রি অর্জন করেন (২০১৪) এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও স্নাতক সম্পন্ন করেন। তাঁর গবেষণার যাত্রা শুরু হয়েছিল ওইটা ন্যাশনাল কলেজ অব টেকনোলজি থেকে, যেখানে তিনি কম্পিউটার ও নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলে অধ্যয়ন করেন।

বর্তমানে তিনি টোকিও বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বাংলা, ইংরেজি ও জাপানি—এই তিন ভাষাতেই দক্ষ। জাপানে তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিম্নশক্তি ইলেকট্রনিক সার্কিট, কম্পিউটিং-ইন-মেমরি এবং নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর গবেষণা করছেন।

ড. ইসলাম ২০১৩ সালে জাপান সোসাইটি ফর দ্য প্রমোশন অব সায়েন্স (JSPS) ফেলো ছিলেন। তিনি টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন এবং পরে কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। বর্তমানে তিনি টোকিও বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের “ইসলাম ল্যাবরেটরি”-তে সার্কিট ও সিস্টেম ডিজাইন গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

তাঁর গবেষণার মূল লক্ষ্য—কম শক্তি ব্যয়ে, দ্রুত এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক সার্কিট তৈরি করা, যা ভবিষ্যতের এআই ও নিরাপদ যোগাযোগ প্রযুক্তির ভিত্তি গড়ে তুলবে।

তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে IEEE Best Paper Award, Academic Research Award (IEEE CEDA Japan Chapter) এবং ASP-DAC Best Design Award।


সূত্র: IEEE APCCAS 2025 Conference Paper;
টোকিও বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় ইসলাম গবেষণা ল্যাব; ড. মাহফুজুল ইসলামের অফিসিয়াল প্রোফাইল

বিজ্ঞানী অর্গ এ ড. মাহফুজুল ইসলাম এর সাক্ষাৎকার:
https://biggani.org/mahfuzul_islam/

Share
Written by
ড. মশিউর রহমান

ড. মশিউর রহমান বিজ্ঞানী.অর্গ এর cofounder যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৬ সনে। পেশাগত জীবনে কাজ করেছেন প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী ও শিক্ষক হিসাবে আমেরিকা, জাপান, বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরে। বর্তমানে তিনি কাজ করছেন ডিজিটাল হেল্থকেয়ারে যেখানে তার টিম তথ্যকে ব্যবহার করছেন বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবার জন্য। বিস্তারিত এর জন্য দেখুন: DrMashiur.com

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org