সিঙ্গাপুরে রাত ২টা বাজছে, হটাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। নিশ্চয় বাংলাদেশ থেকে, কেননা মাঝরাতে ফোনগুলি বাংলাদেশ থেকেই আসে। এইরকম ফোন আসলে ভয় লাগে, কোন দু:সংবাদ নয় তো! যাক অপরপ্রান্তে মোহসিন এর কন্ঠ শুনে আস্বস্ত হলাম। মোহসিন একজন নবীন গবেষক। সে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে গবেষণা করছে। সে বলল, ‘স্যার, একটা জিনিস নিয়ে ভাবছি, কিন্তু কাউকে বলা যাচ্ছে না!‘ আমি অবাক হলাম না। গবেষণার নেশায় মত্ত তরুণদের এই উন্মাদনা নতুন কিছু নয়। আর আমি সেটির সাথে পরিচিত। গবেষণার জগৎটাই এমন—যেখানে নতুন চিন্তা, উদ্ভাবনী আইডিয়া রাত-বিরেতে মাথায় আসে। কিন্তু সমস্যাটা হল, এই চিন্তা ও উদ্ভাবনের পথে অনেক বাধা, অনেক চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে গবেষণার পরিবেশ এখনো যথেষ্ট চ্যালেঞ্জপূর্ণ, তবুও সম্ভাবনার অভাব নেই। কম সম্পদ, অনিয়মিত আর্থিক সহায়তা এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে তরুণ গবেষকরা প্রায়ই যথাযথ সুযোগ পান না। তবে ইতিবাচক দিক হলো, এখনো অনেকেই আছেন যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কেউ একা, কেউবা দলবদ্ধভাবে গবেষণার মানোন্নয়নে কাজ করছেন। এই নিবন্ধে আমরা গবেষণার বর্তমান চিত্র, চ্যালেঞ্জ ও কিছু বাস্তবসম্মত সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।
গবেষণার বর্তমান চিত্র ও বাধাগুলি
কম আর্থিক বরাদ্দ:
বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) গড়ে ০.৩%-০.৫% এর মতো বিনিয়োগ করা হয় (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন তথ্যানুসারে)। তুলনামূলকভাবে উন্নত দেশগুলোতে এই হার ২%-৩% পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবেই, আর্থিক সহায়তার এ ঘাটতি গবেষণা-উদ্যমী মানুষকে টিকিয়ে রাখা কঠিন করে তোলে।
পরিবেশগত সীমাবদ্ধতা:
কখনো বিদ্যুৎ বিভ্রাট, কখনো দ্রুতগতির ইন্টারনেটের অভাব, আবার কখনো অবকাঠামোর অভাবে অনেক গবেষককে পিছিয়ে যেতে হয়। দেশের অনেক অঞ্চলেই গবেষণার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সাপোর্ট সিস্টেম সহজলভ্য নয়।
মানসিক সহায়তা ও মেন্টরশিপের অভাব:
গবেষণার জন্য শুধু আর্থিক সহায়তা নয়; প্রয়োজন পেশাগত পরামর্শ ও মানসিক উৎসাহ। বাংলাদেশে মেন্টরশিপের সুযোগ সীমিত। তরুণ গবেষকরা একাকী পথ খুঁজতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই হতাশায় ভোগেন।
গবেষক ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে সংযোগের অভাব:
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রবাসে থাকা প্রতিষ্ঠিত গবেষক ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে দরকার গভীর এবং দীর্ঘমেয়াদী সংযোগ। অনেক প্রবাসী গবেষক দেশের জন্য কিছু করতে চান, কিন্তু বাস্তবে দেশি গবেষকদের সাথে শক্তিশালী একটি ‘টিম ওয়ার্ক’ গড়ে উঠছে না।
সম্ভাবনা ও উদ্যম
তবু আমাদের তরুণ সমাজের মাঝে রয়েছে অসাধারণ উদ্যম ও সৃজনশীলতা। অনেকেই নিরলস গবেষণা করে নিজেদের মতো করে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করছেন। প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, মনোবিজ্ঞান বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের প্রকাশনা আন্তর্জাতিক জার্নালে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয়ভাবে অল্পকিছু গবেষণা দল থাকলেও, যথাযথ সহায়তা পেলে এদের সংখ্যা ও সক্ষমতা বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব।
করণীয়: সুপারিশ ও দিকনির্দেশনা
গবেষণার পরিবেশকে এগিয়ে নিতে নানান উদ্যোগ হাতে নেওয়া যেতে পারে। কিছু বাস্তবসম্মত পরামর্শ নিচে তুলে ধরা হলো—
- সংগঠিত দল গঠন করুন
- কাছাকাছি বিষয়ে আগ্রহী সহপাঠী, সহকর্মী বা শিক্ষক মিলে একটি ছোট দল তৈরি করুন।
- ফেসবুক/লিঙ্কডইন বা অন্য কোনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গ্রুপ খুলে সপ্তাহে অন্তত একবার দেখা বা আলোচনা করুন।
- যেকোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের (যেমন: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেডিক্যাল রিসার্চ, সাইকোলজি) ওপর ফোকাস গ্রুপ বানিয়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করুন ও সমাধানের পথ তৈরি করুন।
- নিয়মিত শেয়ারিং সেশন ও ওয়ার্কশপ
- মাসে অন্তত একবার সবার কাজ, চ্যালেঞ্জ এবং আইডিয়া বিনিময়ের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করুন।
- বড় অনুষ্ঠান না করে, ছোট পরিসরে হলেও নিয়মিত আলোচনার সংস্কৃতি তৈরি করুন।
- বিষয়ভিত্তিক ওয়ার্কশপ বা সেমিনারের মাধ্যমে নিজ নিজ গবেষণার এক্সপার্টদের আমন্ত্রণ করুন।
- আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ও ভার্চুয়াল কমিউনিটি
- সমমনা গবেষকদের সন্ধানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ করুন, সামাজিক মাধ্যম বা গবেষণা নেটওয়ার্ক (ResearchGate, Google Scholar প্রভৃতি) ব্যবহার করুন।
- ভার্চুয়াল সভা বা সম্মেলনের মাধ্যমে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিন।
- দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় একসাথে কাজ করার রোডম্যাপ তৈরি করুন।
- পাবলিকেশন নয়, জ্ঞান-সৃষ্টিতে মনোযোগ
- গুণগতমান সম্পন্ন গবেষণা করা বেশি জরুরি, যাতে গভীর সমস্যার মৌলিক সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়।
- হুটহাট করে প্রকাশনা বৃদ্ধির চেয়ে মানসম্মত গবেষণার দিকে মনোযোগ দিন।
- গবেষণায় অর্জিত জ্ঞান শিল্পোদ্যোগ বা বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানেও প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- দেশি-বিদেশি অংশীদারত্ব ও বিনিয়োগ
- প্রবাসী গবেষকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন; তাঁদের বাস্তবতা ও সাহায্যের ধরন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিন।
- আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করতে স্থানীয় শিল্পোদ্যোগ, ব্যাংক কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে আলোচনা করুন।
- সরকারিভাবে রিসার্চ গ্রান্ট ও প্রণোদনার পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যান—যৌথ উদ্যোগে নীতি-নির্ধারকদের সাথে আলাপ করুন।
- মেন্টরশিপ ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা
- অভিজ্ঞ গবেষক বা শিক্ষকরা তরুণদের হাতে-কলমে সাহায্য করতে পারেন।
- ৩-৫ বছরের একটি স্বচ্ছ পরিকল্পনা রাখুন, যেখানে কী কী লক্ষ্য (milestones) অর্জন করবেন তার পরিষ্কার রূপরেখা থাকবে।
- বয়স বা পদবি যারই হোক না কেন, সবার জন্যই পজিটিভ মেন্টরশিপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শেষকথা
দেশে গবেষণা অব্যাহত রাখতে হলে দরকার হবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, দলগত মানসিকতা ও অপরিমেয় উৎসাহ। আমাদের তরুণদের মাঝে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে, যা সঠিক নির্দেশনা পেলে বিশ্বমানের সাফল্য বয়ে আনতে পারে। সামান্য আয়োজন ও সীমিত সম্পদ থেকে যে উদ্ভাবনী কাজ সম্ভব, তার নজির ইতিমধ্যেই রয়েছে। এখন দরকার সেই উদ্যমকে আরও ছড়িয়ে দেওয়া। যারা ইতোমধ্যে নিরলস পরিশ্রমে যুক্ত আছেন, তাঁদের জন্য রইল শ্রদ্ধা ও শুভকামনা। আর নতুন যারা যুক্ত হতে চান, তাঁদের জন্য পরামর্শ—একটা ছোট দল গঠন করুন, নিয়মিত আলোচনা করুন, এবং ধীরে ধীরে একটি স্থায়ী গবেষণা-সম্প্রদায় গড়ে তুলুন। দীর্ঘমেয়াদে এ পথই আমাদেরকে আরও শক্তিশালী, আরো উদ্ভাবনী আর বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।
বিজ্ঞানী অর্গ এই নবীন গবেষকদের সাপোর্ট করার জন্য একটি ভলেন্টিয়ার গ্রুপ পরিচালনা করে। আপনি আগ্রহী হলে আমাদের সাথে যোগ দিন। এই টিমে যোগ দিয়ে গবেষণা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা ও মেন্টরিং এর জন্য বিজ্ঞানীদের সাথে নেটওয়ার্ক করার সুবিধা পাবেন।
বিস্তারিত দেখুন:
https://biggani.org/call-for-volunteers/
Leave a comment