বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিব সম্প্রতি তার প্রথম গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছেন। এটি প্রকাশের জন্য একটি জার্নালে জমাও দিয়েছেন। কিছুদিনের মধ্যে তার ই-মেইলে উত্তর এল—প্রবন্ধটি গ্রহণ করা হয়েছে এবং মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশিত হবে। শর্ত একটাই, প্রকাশনার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি জমা দিতে হবে।
প্রথমবার গবেষণা প্রকাশের আনন্দে রাকিব খুশি হয়ে গেলেও, তার এক সহপাঠী বিষয়টি শুনে সন্দেহ প্রকাশ করল। ভালো মানের গবেষণা জার্নালে যেখানে পর্যালোচনা (peer review) প্রক্রিয়ায় তিন থেকে ছয় মাস সময় লাগে, সেখানে মাত্র দুই সপ্তাহে অনুমোদন পাওয়া কতটা স্বাভাবিক? আরও খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, এই জার্নালটি প্রিডেটরি জার্নাল বা প্রতারণামূলক গবেষণা প্রকাশক, যারা অর্থের বিনিময়ে দ্রুত গবেষণা প্রকাশ করলেও একাডেমিক মানদণ্ড অনুসরণ করে না।
রাকিবের মতো হাজারো তরুণ গবেষক প্রতি বছর এই প্রতারণার শিকার হন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ গবেষণা প্রিডেটরি জার্নালে প্রকাশিত হয় (source: Nature, 2023)। বাংলাদেশেও এই সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ গবেষক তাদের ক্যারিয়ারের কোনো না কোনো পর্যায়ে সন্দেহজনক জার্নালের অফার পান (source: UGC Bangladesh, 2022)।
প্রিডেটরি জার্নাল কী এবং কেন এটি বিপজ্জনক?
প্রিডেটরি জার্নাল হলো এমন কিছু প্রকাশনা যেগুলো সাধারণত গবেষকদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করে দ্রুত গবেষণা প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু যথাযথ পর্যালোচনা (peer review) প্রক্রিয়া অনুসরণ করে না। এসব জার্নালের বেশিরভাগই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা ডাটাবেসে (যেমন Scopus, Web of Science, PubMed) তালিকাভুক্ত নয়।
প্রিডেটরি জার্নালে গবেষণা প্রকাশ করলে গবেষকের ক্যারিয়ার এবং একাডেমিক গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রিডেটরি জার্নালে প্রকাশিত গবেষকদের ৮০ শতাংশ পরবর্তীতে কোনো স্বীকৃত জার্নালে গবেষণা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হন (source: Retraction Watch, 2022)।
প্রিডেটরি জার্নাল চেনার উপায়
একজন গবেষকের জন্য প্রিডেটরি জার্নাল চেনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কিছু মূল বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো—
১. অতিরিক্ত দ্রুত প্রকাশনার প্রতিশ্রুতি: সাধারণত ভালো মানের জার্নালে গবেষণা প্রকাশের জন্য তিন থেকে ছয় মাস বা কখনো কখনো এক বছর পর্যন্ত সময় লাগে। কিন্তু প্রিডেটরি জার্নাল মাত্র দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
২. গবেষণার পর্যালোচনা (Peer Review) না করা: মানসম্মত জার্নালগুলোতে দুই বা ততোধিক স্বাধীন গবেষকের মাধ্যমে গবেষণা পর্যালোচনা করা হয়। কিন্তু প্রিডেটরি জার্নালগুলোতে এই পর্যালোচনা প্রক্রিয়া নেই অথবা কৃত্রিমভাবে দ্রুত করা হয়।
- ISI বা Scopus ইন্ডেক্সিং নেই: বিশ্বমানের গবেষণা প্রকাশনার জন্য Scopus, Web of Science, বা PubMed-এর তালিকাভুক্ত জার্নাল ব্যবহার করা উচিত। সন্দেহ হলে সংশ্লিষ্ট ডাটাবেসে জার্নালের নাম সার্চ করে নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
- Beall’s List বা Cabell’s Blacklist-এ অন্তর্ভুক্ত: প্রিডেটরি জার্নালের একটি তালিকা সংরক্ষণ করেন বিজ্ঞানী জেফরি বেল, যা Beall’s List নামে পরিচিত। এছাড়াও, Cabell’s Blacklist নামক আরেকটি ডাটাবেস রয়েছে যেখানে সন্দেহজনক জার্নালগুলোর তালিকা প্রকাশিত হয়।
- অতি উচ্চ বা সন্দেহজনক প্রকাশনা ফি: ওপেন-অ্যাক্সেস জার্নালগুলোর প্রকাশনা ফি সাধারণত ১,৫০০ থেকে ৩,০০০ মার্কিন ডলার হয়ে থাকে, যা নির্ভর করে জার্নালের গুণগত মানের ওপর। কিন্তু অনেক প্রিডেটরি জার্নাল মাত্র ৩০০ থেকে ৫০০ ডলারে প্রকাশের প্রস্তাব দেয়, যা সন্দেহজনক।
- DOI (Digital Object Identifier) নেই বা ভুয়া DOI ব্যবহার: মানসম্মত গবেষণা DOI ব্যবহার করে, যা গবেষণার স্থায়ী পরিচয় দেয়। অনেক প্রতারণামূলক জার্নালে এটি থাকে না বা থাকলেও তা কার্যকর নয়।
- ভুয়া এডিটোরিয়াল বোর্ড: কিছু জার্নাল তাদের ওয়েবসাইটে খ্যাতনামা গবেষকদের নাম ব্যবহার করে, অথচ তাদের প্রকৃত কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে না। যদি সন্দেহ হয়, তবে সংশ্লিষ্ট গবেষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
প্রিডেটরি জার্নালে গবেষণা প্রকাশ করলে কী ক্ষতি হতে পারে?
একটি ভুল সিদ্ধান্ত গবেষকের সারাজীবনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে—
- প্রিডেটরি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাকে একাডেমিক সম্প্রদায় গ্রহণ করে না।
- ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি, পোস্টডক বা শিক্ষাবৃত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
- Scopus, Web of Science, PubMed-এর তালিকাভুক্ত জার্নালে ভবিষ্যতে গবেষণা প্রকাশের সুযোগ কমে যায়।
- একাডেমিক প্রতিষ্ঠান বা গবেষণা অনুদান (funding) পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
- গবেষণার মান প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং একাডেমিক কমিউনিটি সংশ্লিষ্ট গবেষককে আর গুরুত্ব দেয় না।
উপসংহার
একজন গবেষক হিসেবে গবেষণার যথাযথ মূল্যায়ন ও প্রকাশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। প্রতি বছর ১,৫০,০০০-এর বেশি গবেষণা প্রিডেটরি জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার কারণে বাতিল করা হয় (source: DOAJ, 2023)—এটি শুধু ব্যক্তিগত নয়, বৈজ্ঞানিক সমাজের জন্যও ভয়াবহ ক্ষতিকর।
তাই গবেষকদের উচিত সন্দেহজনক জার্নালে গবেষণা প্রকাশ না করে বিশ্বমানের স্বীকৃত প্রকাশনায় কাজ করা। ভুল সিদ্ধান্ত যেন সারাজীবনের আফসোস হয়ে না দাঁড়ায়।
Leave a comment