নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
মৌমাছিকে ডান-বামে চালানো যাবে রিমোট কন্ট্রোলে? শুনতে কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি মনে হলেও, চীনের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এমন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন যা সত্যিই এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে।
চীনের বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেইজিং ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক ঝাও জিয়েলিয়াং-এর নেতৃত্বে একদল গবেষক সম্প্রতি এমন এক অতি হালকা “ব্রেইন কন্ট্রোল ডিভাইস” তৈরি করেছেন, যা সরাসরি মৌমাছির মস্তিষ্কে সংযুক্ত করা যায় এবং তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা যায় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। এই যন্ত্রটি গবেষণা ও প্রযুক্তির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, কিন্তু একইসঙ্গে জাগিয়ে তুলেছে নানা নৈতিক ও পরিবেশগত প্রশ্ন।
🧠 কীভাবে কাজ করে এই ব্রেইন-কন্ট্রোল যন্ত্র?
এই “ব্রেইন কন্ট্রোলার” বা মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রক যন্ত্রটির ওজন মাত্র ৭৪ মিলিগ্রাম—যা একটি মৌমাছির মধু বহনের ক্ষমতার চেয়েও কম। অর্থাৎ এটি মৌমাছির স্বাভাবিক গতিবিধিকে বিশেষভাবে ব্যাহত করে না। ডিভাইসটি মৌমাছির পিঠে বসানো হয় এবং তিনটি মাইক্রো-সুঁই (micro-needles) সরাসরি মৌমাছির মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে নির্দিষ্ট বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠানো হয়। এই সংকেতগুলো মৌমাছির স্নায়ু ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলে এবং তার ফলেই ডিভাইসটি মৌমাছিকে সামনে, পেছনে, বাম কিংবা ডানে চালাতে পারে প্রায় ৯০% নির্ভুলতার সাথে।
এই গবেষণাপত্রটি ২০২৫ সালের ১১ জুন Chinese Journal of Mechanical Engineering-এ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বিস্তারিতভাবে ডিভাইসটির প্রযুক্তিগত গঠন, কার্যপ্রণালী এবং সম্ভাব্য প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
🔬 প্রযুক্তির কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য
ডিভাইসটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে অতিস্বচ্ছ, নমনীয় এবং পাতলা পলিমার ফিল্ম সার্কিট—যা দেখতে অনেকটা পতঙ্গের ডানার মতো। এতে সংযুক্ত রয়েছে ছোট আকারের ইনফ্রারেড রিসিভার, যার মাধ্যমে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে মৌমাছিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
এই ‘ফ্লেক্সিবল ইলেকট্রনিক্স’ প্রযুক্তি ইতিপূর্বে রোবটিকস ও বায়োইঞ্জিনিয়ারিং-এর কিছু পরীক্ষায় ব্যবহৃত হলেও, মৌমাছির মতো সূক্ষ্ম ও ছোট প্রাণীতে এই প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ এই প্রথম।
🌍 ব্যবহার ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
গবেষকরা এই প্রযুক্তির দুটি সম্ভাব্য ব্যবহারের দিক তুলে ধরেছেন:
- মানবিক প্রয়োগ (Humanitarian Use):
ভূমিকম্প বা ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া মানুষের সন্ধানে এই ধরনের মৌমাছি-সাইবর্গ ব্যবহার করা যেতে পারে। ছোট আকৃতির কারণে এগুলো সংকীর্ণ ও দুর্গম স্থানে পৌঁছতে সক্ষম, যেখানে ড্রোন বা রোবট পৌঁছতে পারে না। - সামরিক ও গোয়েন্দা কার্যক্রম (Military/Espionage Use):
গুপ্তচরবৃত্তি, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান এবং মাদকবিরোধী অভিযানে এসব সাইবর্গ মৌমাছিকে ব্যবহার করা যেতে পারে অতি গোপনে তথ্য সংগ্রহ বা ট্র্যাকিংয়ের কাজে।
⚠️ নৈতিক ও পরিবেশগত উদ্বেগ
তবে এই প্রযুক্তিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু বিতর্ক ও প্রশ্ন। সেগুলোর মধ্যে প্রধান দুটি হলো—
- নৈতিকতা (Ethical Concerns):
প্রাণীর ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা কি আদৌ নৈতিক? মৌমাছির মস্তিষ্কে ইচ্ছাকৃতভাবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ পাঠিয়ে তাকে ‘রোবটের’ মতো ব্যবহার করাটা কিছু বিশেষজ্ঞের কাছে জীববিজ্ঞানের সীমানা অতিক্রম করে যাওয়া এক আচরণ। - পরিবেশগত প্রভাব (Ecological Risks):
মৌমাছি পৃথিবীর পরাগায়ন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই প্রযুক্তি যদি বাণিজ্যিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তবে তা মৌমাছির প্রাকৃতিক আচরণে বিঘ্ন ঘটাতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের খাদ্য শৃঙ্খল ও কৃষিকাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
🔎 পটভূমি: কীভাবে শুরু হলো ‘ইনসেক্ট সাইবর্গ’ গবেষণা?
মৌমাছির ওপর এই নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি একদিনে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে বহু বছরের গবেষণা ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা DARPA-এর “HI-MEMS” (Hybrid Insect Micro-Electro-Mechanical Systems) প্রোগ্রাম।
এই প্রোগ্রামে তারা প্রথম চেষ্টা করে কীটপতঙ্গ যেমন গুবরে পোকা ও তেলাপোকার ওপর মাইক্রো-চিপ বসিয়ে তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে। পরবর্তীতে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপেও এ ধরনের গবেষণা চলতে থাকে। কিছু শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে এমনকি “AI-বট তেলাপোকা কিট” তৈরি করে ছাত্রদের জন্য।
কিন্তু এতোদিন পর্যন্ত মৌমাছির মতো সূক্ষ্ম এবং পরিশীলিত প্রাণীর ওপর এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ এতটা নির্ভুলতা ও হালকা যন্ত্রের মাধ্যমে সম্ভব হয়নি।
🧪 বিজ্ঞান ও সমাজ: বিপ্লব নাকি বিপদ?
এই গবেষণাটি একদিকে যেমন প্রযুক্তির বিকাশের বিস্ময়কর উদাহরণ, অন্যদিকে তা বিজ্ঞান ও সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।
একদিকে মানবজীবন রক্ষায় যেমন এটি এক নতুন পথ দেখাতে পারে, তেমনি ভুল উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলে তা গোপন নজরদারি, প্রাণীর উপর নিষ্ঠুরতা, এবং পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্টের কারণ হতে পারে।
🔮 ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে এই প্রযুক্তির উপর আরও গবেষণা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো—
- ডিভাইসগুলো আরও হালকা হবে
- নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হবে আরও জটিল
- অন্য প্রজাতির পতঙ্গ বা ক্ষুদ্র প্রাণীও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে
- এবং সম্ভবত জৈব-রোবটের নতুন যুগের সূচনা হবে
তবে এই অগ্রগতি যেন মানবিকতা, নৈতিকতা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের সীমানা অতিক্রম না করে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
✍️ উপসংহার
বেইজিং ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির এই গবেষণা আমাদের নতুন এক যুগে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে—যেখানে জীবন্ত প্রাণীকে প্রযুক্তির সাহায্যে ‘চালনা’ করা সম্ভব হচ্ছে। এটি প্রযুক্তিগত সাফল্য হলেও আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রকৃতির নিয়মে হস্তক্ষেপের একটা সীমা থাকা উচিত। বিজ্ঞান যেন কেবলমাত্র উন্নয়নের জন্য নয়, মানবিকতার দিক থেকেও পথপ্রদর্শক হয়—সেই কামনাই রইলো।

Leave a comment