নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
ইমেইল: [email protected]
মানুষ হাসতে পারে, এটি আমাদের সবচেয়ে স্বাভাবিক অথচ সবচেয়ে গভীর এক বৈশিষ্ট্য। আনন্দ, ব্যথা, বিস্ময় কিংবা লজ্জা—নানান আবেগের প্রকাশেই মানুষ হাসে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই হাসি কি কেবল মানুষের জন্যই সংরক্ষিত? অন্য প্রাণীরা কি একেবারেই হাসতে জানে না?
বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, হাসি শুধুমাত্র মানুষের একান্ত ক্ষমতা। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা এই ধারণাকে বদলে দিয়েছে। এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, হাসি কেবল মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, প্রকৃতির আরও অনেক প্রাণীর মধ্যেও হাসির মতো আচরণ বা শব্দ বিদ্যমান।
হাসি আসলে কী?
মানুষের হাসি মূলত একটি জটিল জৈবিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া। যখন আমরা আনন্দিত হই বা কোনো মজার কিছু দেখি, তখন মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেম ও হাইপোথ্যালামাস সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর পর মুখের পেশি, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং গলার স্নায়ু একযোগে কাজ করে ‘হা-হা’ বা ‘হি-হি’ ধরণের ধ্বনি তৈরি করে। একই সঙ্গে এই হাসি সামাজিক সম্পর্কের বন্ধনকেও মজবুত করে। মানুষ হাসির মাধ্যমে বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা ও নিরাপত্তার বার্তা বিনিময় করে।
প্রাণীদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যদিও তাদের হাসি শব্দে নয়, আচরণে প্রকাশ পায়।
প্রাণীর হাসির উদাহরণ
গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ ছাড়া প্রায় ৬০টিরও বেশি প্রাণীর মধ্যে হাসির মতো আচরণ বা শব্দ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হলো বানর ও শিম্পাঞ্জি প্রজাতির প্রাণীরা।
শিম্পাঞ্জি ও গরিলা খেলার সময় বা গায়ে টোকা দিলে মানুষের মতো একধরনের হালকা গলার আওয়াজ করে, যা অনেকটা হাসির মতো শোনায়। ইঁদুরদের নিয়ে করা পরীক্ষায় দেখা গেছে, তাদের গায়ে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিলে তারা উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সির চিরচির শব্দ করে, যা মানুষের হাসির অনুরূপ প্রতিক্রিয়া বলে মনে করা হয়। কুকুর, ডলফিন এবং শেয়ালের মতো প্রাণীরাও সামাজিক খেলায় অংশগ্রহণের সময় বিশেষ ধরণের শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি করে, যা তাদের আনন্দ প্রকাশ করে।
এই ধরনের শব্দকে বিজ্ঞানীরা ‘play vocalization’ নামে অভিহিত করেন, যার অর্থ খেলার সময় আনন্দ প্রকাশের ধ্বনি।
পার্থক্য কোথায়
মানুষের হাসি কেবল মুখভঙ্গি বা শব্দের প্রকাশ নয়, এটি একই সঙ্গে একটি সামাজিক ভাষাও। প্রাণীদের হাসি তুলনামূলকভাবে অশব্দ, সংবেদনশীল এবং আচরণনির্ভর। শিম্পাঞ্জিরা খেলার সময় দাঁত দেখায়, কিন্তু তা মানুষের হাসির মতো নয়, বরং একটি খেলার সংকেত মাত্র।
মানুষের হাসি আরও একটি দিক থেকে অনন্য। এটি কেবল আনন্দ প্রকাশের মাধ্যম নয়, বরং সমাজে যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। উদাহরণস্বরূপ, বিব্রতকর পরিস্থিতিতে হাসি ব্যবহার করে মানুষ অস্বস্তি কমাতে পারে বা অন্যের মনোভাব পরিবর্তন করতে পারে। প্রাণীদের মধ্যে এমন সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উদ্দেশ্য দেখা যায় না।
বিবর্তনের দৃষ্টিতে হাসি
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, হাসি সম্ভবত এক ধরনের বিবর্তিত সামাজিক সংকেত। প্রাচীন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে খেলার সময় সৃষ্ট শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ থেকেই মানুষের হাসির উৎস। গবেষণায় ধারণা করা হয়, হাসি প্রথমে ছিল আক্রমণ নয় বরং বন্ধুত্ব বোঝানোর একটি ইঙ্গিত।
অর্থাৎ, কোনো প্রাণী খেলার সময় দাঁত দেখিয়ে হালকা শব্দ করলে সেটি অন্য প্রাণীর কাছে একটি শান্তিপূর্ণ সংকেত ছিল, যেন বোঝানো হচ্ছে “আমি লড়াই করতে আসিনি, আমি খেলতে এসেছি।” সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আচরণ মানুষের মধ্যে রূপ নেয় জটিল সামাজিক ভাষা ‘হাসি’-তে।
মানুষ ও প্রাণীর হাসির সংযোগ
আজও হাসি মানুষের সবচেয়ে মানবিক প্রকাশগুলোর একটি। তবে প্রাণীদের মধ্যেও আনন্দ, খেলা এবং সামাজিক সম্পর্কের ইঙ্গিত বিদ্যমান, যদিও তাদের প্রকাশভঙ্গি মানুষের মতো নয়।
হাসি তাই কেবল ঠোঁটের কোণে নয়, বরং বিবর্তনের ইতিহাসে এক যৌথ উত্তরাধিকার। মানুষ ও প্রাণী উভয়েই তাদের নিজ নিজ উপায়ে আনন্দ ও বন্ধুত্বের সংকেত দিয়েছে, একে অপরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে।
উপসংহার
মানুষ ছাড়া কোনো প্রাণী হাসে না—এই ধারণাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। অনেক প্রাণী হাসতে পারে, শুধু তাদের হাসি আমাদের মতো শোনায় না। বরং এই হাসি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আনন্দ ও সহানুভূতি কোনো একক প্রজাতির সম্পত্তি নয়, বরং প্রকৃতির সবার মাঝে ভাগ করা এক সুন্দর উত্তরাধিকার।

Leave a comment