বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একদিন চোখে পড়ল—এক দালানকায় গাছ কাত হয়ে পড়ে আছে। প্রথমে মনটা কেমন যেন শূন্য হয়ে গেল। কত পাখির বাসা, কত কাঠবিড়ালির খেলা—সব যেন হঠাৎ থেমে গেছে। কিন্তু মনের ভেতরই আরেকটা প্রশ্ন বাজল, শেষ কি আসলেই শেষ? মার্কিন গবেষক মার্ক হারমন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নেমেছিলেন প্রায় চল্লিশ বছর আগে। চার দশক ধরে তিনি ছয়টি বনাঞ্চলে পাঁচ শতাধিক মৃত গাছের ক্ষয়প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেছেন। ভাবুন তো, আমরা যে সময়ে অন্তত তিনবার ভোট দিয়ে সরকার পাল্টাই, সেই সময়ে তিনি অদৃশ্য এক বিজ্ঞানগল্পের নোট নিচ্ছেন।
হারমন সাহেবের গবেষণা শুনলে আপনার চশমা খুলে ফেলতে ইচ্ছে করবে। কোনো কোনো মৃত গাছ তিন বছরের মধ্যে মাটির সাথে মিশে যায়, আবার কোনোটা সাতশো পঞ্চাশ বছর ধরে ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়—আমাদের সাত পুরুষ পার হলেও সেই গাছের কাঠের গায়ে সময়ের ছাপ পড়তেই চায় না। ২০২০ সালের এক বিশ্লেষণে তিনি দেখিয়েছেন, গাছের ক্ষয়গতির পার্থক্য প্রজাতি আর আবহাওয়া ভেদে দুইশো চুয়াল্লিশ গুণ পর্যন্ত হতে পারে। দুইশো চুয়াল্লিশ গুণ! এ যেন মশার কামড়ের ব্যথা আর মশারির ভেতর ঘুমানোর শান্তির ফারাক।
কিন্তু এই পরিসংখ্যানের পেছনের বিজ্ঞানটা আরও চমকপ্রদ। মৃত গাছের কাঠের ভেতরে সেলুলোজ আর লিগনিন নামের জটিল জৈব অণু থাকে। সেলুলোজ ভাঙতে তুলনামূলক কম সময় লাগে, কিন্তু লিগনিনের রাসায়নিক গঠন এত শক্ত যে তা ভাঙতে নির্দিষ্ট ধরনের ছত্রাক আর ব্যাকটেরিয়ার দরকার হয়। এই জীবাণুরা আবার তাপমাত্রা, আর্দ্রতা আর অক্সিজেনের মাত্রা অনুযায়ী কাজ করে। উত্তর-পশ্চিমের শীতল ও স্যাঁতসেঁতে বনে যেখানে ছত্রাকের বৃদ্ধি ধীর, সেখানে গাছের লিগনিন ভাঙতে শতাব্দী লেগে যায়। অথচ উষ্ণমণ্ডলীয় বনে উষ্ণতা ও আর্দ্রতা বেশি হওয়ায় একই লিগনিন কয়েক বছরের মধ্যে ভেঙে যায়।
এখন ভাবুন, এই ক্ষয়প্রক্রিয়ার গতির ওপর নির্ভর করছে কত বিপুল কার্বন কখন বায়ুমণ্ডলে ফিরবে। জীবিত অবস্থায় গাছ আলোকসংস্লেষণ করে বাতাস থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইড টেনে নিয়ে কাঠের ভেতর কার্বন আটকে রাখে। গাছ মরে গেলে সেই কার্বন আর গাছের ভেতর বন্দি থাকে না, ক্ষয়প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বায়ুতে ফিরে যায়। যদি কোনো বনে ধীরে ক্ষয়প্রবণ প্রজাতির আধিক্য থাকে, সেই বন শতাব্দীর পর শতাব্দী বিপুল পরিমাণ কার্বন আটকে রাখতে পারে। বিপরীতে দ্রুত ক্ষয়প্রবণ গাছের বন খুব অল্প সময়েই সেই কার্বনকে বাতাসে ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ মৃত গাছের এই নীরব ক্ষয়প্রক্রিয়া পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের অঙ্কে বড়সড় ভূমিকা রাখে।
তবে শুধু কাঠের ভেতরেই কার্বনের গল্প শেষ নয়। মৃত গাছের চারপাশের মাটিও এক জটিল পরীক্ষাগার। গাছের পচন থেকে নির্গত দ্রবণীয় জৈব যৌগ মাটির জীবাণুর খাবার হয়ে ওঠে। এই জীবাণুরা নিজেরাও শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে কার্বন ডাই–অক্সাইড ছাড়ে। আবার কিছু ক্ষেত্রে মাটির খনিজের সাথে মিশে কার্বন দীর্ঘদিনের জন্য বন্দি থাকে। অর্থাৎ গাছের মৃত্যু মাটির কার্বন চক্রকে নতুন করে সাজিয়ে দেয়—কখনো কার্বন দ্রুত বাতাসে মিশে যায়, কখনো তা মাটির গভীরে হাজার বছরের জন্য আটকে থাকে।
বিজ্ঞানীরা একসময় ভেবেছিলেন, গাছের মৃত্যু মানেই যেন তৎক্ষণাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। হারমন সেই ভুলকে একেবারে ধুয়ে মুছে দিলেন। তাঁর মতে, পৃথিবীর কোথাও, কোনো কালে, গাছ মরেই সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায়নি। বরং মৃত্যু এক নতুন পর্যায়ের শুরু। এক শরীরের ক্ষয় মানেই অন্য জীবনের জন্ম—নতুন ছত্রাক, নতুন পোকামাকড়, নতুন মাটির রাসায়নিক গঠন।
আজকের জলবায়ু সংকটের যুগে এই গবেষণা আমাদের চোখ খুলে দেয়। যখন পৃথিবীর উষ্ণতা রুখতে কার্বন নির্গমন কমানোর নানা পরিকল্পনা চলছে, তখন বনের মাটিতে লুটিয়ে থাকা একখণ্ড মৃত কাঠও এই লড়াইয়ের গোপন যোদ্ধা। এটি যেন প্রকৃতির গোপন কার্বন–ব্যাংক—কখনো দ্রুত খালি হয়, কখনো বা যুগের পর যুগ পূর্ণ থাকে।
তাহলে বলুন, গাছের মৃত্যু কি সত্যিই মৃত্যু? আমার তো মনে হয়, গাছের মৃত্যু প্রকৃতির লেখা এক লম্বা বৈজ্ঞানিক কাব্যের নতুন অধ্যায়। আমরা যাকে শেষ বলে ভাবি, প্রকৃতি তাকে রূপান্তরের শুরুর বাঁশি ধরিয়ে দেয়। এই নিঃশব্দ রূপান্তর আমাদের শেখায়—মৃত্যু আসলে জীবনেরই এক দীর্ঘ ছায়া, যেখান থেকে ভবিষ্যতের বীজ উঁকি দেয়।
Leave a comment