কৃষিপরিবেশ ও পৃথিবী

জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ

Share
Share

ভূমিকাঃ

জলবায়ু পরিবর্তন বলতে পৃথিবীর দীর্ঘমেয়াদী আবহাওয়ায় গড় তাপমাত্রা, বৃষ্টি ও অন্যান্য মৌসুমী বৈশিষ্ট্যের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে বোঝায়। শিল্প বিপ্লবের পর ধরে গ্রীনহাউজ গ্যাস (যেমন কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন) নিঃসরণের ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান সময়ে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প বিপ্লবের তুলনায় প্রায় ১.২°সে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে চিত্রে দেখানো মতো গ্লোবাল টেম্পারেচার বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে (ছবিতে)। জলবায়ু পরিবর্তন একদিকে বাড়তি বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও গ্রীষ্মকালীন তাপপ্রবাহের ঝুঁকি বাড়ায়, অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে খরা এবং স্যালিনিটি প্রবল করে তোলে।

বিশ্লেষণধর্মী মূল আলোচনাঃ

জলবায়ু পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-

জলবায়ু বলতে কোনো একটি অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার গড়কেই বোঝায়। যখন ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কোন এলাকার গড় তাপমাত্রা বা বৃষ্টিপাতের ধরণ অর্থপূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়, তখন তাকে জলবায়ু পরিবর্তন বলা হয়। বর্তমানে প্রধানত মানুষের সৃষ্ট কল-কারখানা, যানবাহন ও জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত গ্রিনহাউজ গ্যাস জমা হচ্ছে। এই গ্রীনহাউজ গ্যাস সমূহ সূর্যের আলোকে আবদ্ধ করে রেখে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ায় (গ্রীনহাউজ প্রভাব)। এর ফলে উত্তর মেরুর বরফ গলা শুরু হয়েছে এবং সমুদ্রের পানি উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গত ৪৪ বছরে গড় তাপমাত্রা প্রায় ০.৫°সে বেড়েছে, যেখানে পূর্বাঞ্চলে ০.৯°সে পর্যন্ত বৃদ্ধি।

ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল (বাংলাদেশ)-

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থা (মাটা নিম্নতল) ও উপকূলীয় অবস্থানের কারণে দেশটি বিশ্বেই অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকা (খুলনা, বরিশাল, কক্সবাজার, ফেনী, পটুয়াখালি ইত্যাদি) ঘূর্ণিঝড়, স্যাঁতসেঁতে ঝড় ও সমুদ্রস্রোতেরোধে প্রবল ঝুঁকিতে আছে। সাথেই বর্ষার বন্যা প্রবণ নিম্নাঞ্চল (যমুনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা, মেঘনা অববাহিকা) প্রতি বর্ষায় নদী ভাঙন ও প্লাবনে ভুগছে। অর্ধ-শুষ্ক উত্তরাঞ্চল (রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর) বর্ষাকালে বন্যার পাশাপাশি শুষ্ক মৌসুমে খরার কবলে পড়ছে। উপরোক্ত কারণগুলোতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সুন্দরবনসহ উপকূলীয় অঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমের উচ্চভূমি সবথেকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত।

প্রভাব-

কৃষি: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি অন্যতম ভরসা হলেও জলবায়ু পরিবর্তন এ খাতকে ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ফসল তছনছ হলে, বৃষ্টির অনিয়মিত বিতরণ বা লঘুচাপের কারণে বর্ষা বিলম্বিত হলে ফসল শুষ্কাতনে পড়ে যায়। উপকূলীয় এলাকায় স্যালিনিটি বৃদ্ধি ফলে নোনা পানিতে ধান চাষ প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণা অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন শিল্পের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত হারিয়ে যেতে পারে। এভাবেই খাদ্য নিরাপত্তা দুর্বল হচ্ছে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকা বিপন্ন হচ্ছে।

স্বাস্থ্য: জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা সৃষ্টি চরম আবহাওয়া শ্বাসতন্ত্র ও জ্বর-বাশি সহ নানা রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ায়। অতিরিক্ত স্যালিনিটি ও দূষিত পানিতে জলজ রোগ (ডায়রিয়া, কলেরা) ছড়ায়। তীব্র গরমে গরমআবহাওয়া সৃষ্ট রক্তচাপের সমস্যা, হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। উপকূলের বহু পরিবার গত কয়েক বছরে দুর্ভিক্ষ ও পানির স্বল্পতার কারণে কৃমি জনিত রোগ এবং পুষ্টিহীনতা বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রামসহ পূর্বাঞ্চলে চলমান বন্যায় প্রায় ৭.১ মিলিয়ন মানুষ জায়গা হারিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে স্থানান্তরিত হয়েছিল। জলবায়ু-উজ্জ্বল রোগ যেমন ডেঙ্গু, প্ব্রমোনিয়া, টায়ফয়েডের প্রকোপও গরমের কারণে বেড়েছে।

শিক্ষা: প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধাক্কায় দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০২৩ সালে ভারী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অতিবৃষ্টির কারণে বাংলাদেশের ১৫,৯২৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৭২৬টি সরকারি বিদ্যালয় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌপাশে অবকাঠামো ভেঙে যাওয়া, বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা ধ্বসে গেলে ছয় থেকে আট সপ্তাহের জন্য ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ছাত্রছাত্রীরা দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে ফেরেনি; অনেকেই বিদ্যালয় পালিয়ে পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছে। বিদ্যাপীঠের জরিপে দেখা গেছে, এক বন্যার পর দেশের মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ২৯৪ হাজার শিক্ষার্থী স্কুলছেড়ে দিয়েছে (৮২%-এর বেশি মেয়েরা)। এতে জ্ঞানাভাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে এবং শিক্ষার অগ্রগতি থমকে গেছে।

জীববৈচিত্র্য: বাংলাদেশের অনন্য জীববৈচিত্র্যও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কটে পড়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন সামুদ্রিক উত্তেজনা, সমুদ্রস্তর বৃদ্ধি ও ঘূর্ণিঝড়ে হুমকির মুখে। গবেষণায় দেখা গেছে ১৯৬৪ সাল থেকে সুন্দরবনের সমুদ্রজলপ্রবেশের কারণে প্রায় ২১০ বর্গকিলোমিটার বনভূমি বিলুপ্ত হয়েছে। এ অঞ্চলের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, নীল পক্ষীসহ অসংখ্য প্রজাতি বিপন্ন হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতার কারণে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালপ্রাচীর (স্বর্গদ্বীপ) ক্ষয়ে যাচ্ছে। সেখানকার ২৩১টিরও বেশি মাছের প্রজাতি, হাঙর ও ডলফিনসহ বহু সামুদ্রিক জীব দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই সব পরিবর্তন বাংলাদেশের জলজ এবং খেজুর বনের বাস্তুতন্ত্রকে বিপন্ন করছে।

বৈজ্ঞানিক তথ্য ও সাম্প্রতিক গবেষণা ফলাফল-

বাংলাদেশে জলবায়ুর সাম্প্রতিক গবেষণা দেখিয়েছে, বর্ষার অনিশ্চয়তা ও মৌসুমি চরমতার কারণে কৃষি-উৎপাদন ডাবল ঝুঁকিতে পড়ছে। চরম বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হওয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে ফসল না হওয়ার ঘটনা বারবার ঘটছে। তাপমাত্রাও দ্রুত বাড়ছে; ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের গড় বার্ষিক তাপমাত্রা কমপক্ষে ১.০–১.৫°সে বৃদ্ধি পাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০৫০ সালে ০.৩০ মি এবং ২১০০ সালে ০.৭৪ মি পর্যন্ত বাড়বে বলে পূর্বাভাসিত। এই কারণে প্রায় ৯ লাখ মানুষ ২০৫০ সালের মধ্যে, এবং ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ ২১০০ সালের মধ্যে দ্বীপ বসতি হারাতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ এবং অতীত কয়েক দশকে চট্টগ্রাম বা খুলনা থেকে শুরু করে পটুয়াখালির মতো অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি কাজ হয়েছে। তবুও ২০৫০ সালের মধ্যে কৃষিক্ষেত্রের এক-তৃতীয়াংশ অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা এবং ১৩.৩ মিলিয়ন অভ্যন্তরীণ অভিবাসীর সম্ভাবনা উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত এই গবেষণা এবং তথ্য-উপাত্তগুলোই আমাদের জানান দেয় যে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতিমধ্যে লক্ষণীয় এবং ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।

উপসংহারঃ

সমগ্র বিশ্বে যেমন ক্রমবর্ধমান গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণে জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুত ঘটে চলছে, তেমনি বাংলাদেশের মতো নিম্ন তলদেশের দেশগুলো তার প্রভাবের মুখোমুখি হচ্ছে। বাংলাদেশের সরাসরি অভিজ্ঞতা এবং গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীববৈচিত্র্য – সব ক্ষেত্রে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। যথাযথ প্রস্তুতি ও বিজ্ঞানভিত্তিক অভিযোজন ছাড়া এ ঝুঁকি সামাল দিতে পারবে না। উন্নয়ন নীতি এবং শিক্ষা-প্রশিক্ষণে জলবায়ু সচেতনতা ও প্রস্তুতি ঢুকিয়ে আসলেই শিশু-তরুণদের ভবিষ্যত রক্ষা করা সম্ভব। বিশ্বব্যাংকসহ বৈশ্বিক গবেষণা সূচিত করছে কেবল তাজা পানি সরবরাহ বা বাঁধ নয়, বরং কৃষিতে জলবায়ু-বান্ধব প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ছোবল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা জরুরি। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে কয়েক দশকে ঝড়ে মৃত্যু কমিয়েছে এবং অভিযোজন শিখেছে। ভবিষ্যতের ঝুঁকি মোকাবিলায় আরও বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ, সম্প্রদায়ভিত্তিক উদ্যোগ ও অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এসব করলেই আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকৃত প্রভাব মোকাবিলা করে দেশের অগ্রযাত্রা রক্ষা করতে পারব।

তথ্যসূত্র: উল্লিখিত প্রতিবেদন ও বৈজ্ঞানিক সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্য এবং পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়েছে।

Written by,
Md. Fahad Hossain
Student, Department of Zoology.
Shahid Bulbul Govt. College, Pabna.
(Affiliated with the National University of Bangladesh)

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
পরিবেশ ও পৃথিবীবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

মরুভূমির পাথরে উটের গল্প: ইসলামী ঐতিহ্যের আলোয় এক প্রত্নআবিষ্কার

প্রাচীন সভ্যতার সাথে ইসলামী ঐতিহ্যের সংযোগ স্থাপনকারী আরবের ১২,০০০ বছরের পুরনো উটের...

পরিবেশ ও পৃথিবী

নদীর প্রাণ কি সত্যিই আছে?

নদী অধিকারের ধারণাটি অন্বেষণ করুন, নদীগুলিকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিন যা...

পরিবেশ ও পৃথিবীবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

সুন্দরবনের ভৌগোলিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপট।

সুন্দরবনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বেঁচে থাকার...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপরিবেশ ও পৃথিবী

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অদৃশ্য বিদ্যুৎ বিল

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জীবনকে সহজ করে তোলে, কিন্তু প্রতিটি চ্যাটবটের উত্তর এবং ছবি...

পরিবেশ ও পৃথিবীস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য ও নীল অর্থনীতি।

বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য এবং নীল অর্থনীতি অন্বেষণ করুন — সুন্দরবন এবং সামুদ্রিক সম্পদ...

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org