আজকাল বাংলাদেশে ভিওআইপি নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনা হচ্ছে। এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিটিকে নিয়ে রয়েছে আমাদের সবারই অনেক আগ্রহ। তবে ভিওআইপি বলতে আমরা অনেকেই বুঝি বিদেশে সস্তায় ফোন করার উপায়। প্রকৃতপক্ষে শুধু তাই নয় কোন প্রতিষ্ঠানের অভ্যান্তরিন টেলিফোন সিস্টেম হিসাবে এই ভিওআইপি কে ব্যবহার করা যেতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে জাপানে ও আমেরিকাতে বসবাসরত বলে আমি চারপাশেই দেখতে পাচ্ছি এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে হচ্ছে হরহামেশাই এবং দিন দিন এর ব্যবহার আরো বিস্তৃত হচ্ছে। আজকের প্রবন্ধে আমেরিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিভাবে ভিওআইপি ব্যবহৃত হচ্ছে তার কিছু উদাহরণ ও কেসস্টাডি নিয়ে আলোচনা করব। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এইরকম সিস্টেম ব্যবহার করে আমরা এই প্রযুক্তি থেকে উপকৃত হতে পারি এবং কম খরচে একটি প্রতিষ্ঠানের টেলিফোন সিস্টেম গড়ে তুলতে পারি।
যে কোন স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টেলিফোন ব্যবস্থার
প্রয়োজন হয় এবং তা বসাতে যেয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। এতোদিন পর্যন্ত
যেভাবে এই সমস্যাগুলির মুখোমুখি হয়ে আসছিলো তা হল প্রথমেই একটা পিবিএক্স
সিস্টেম সেটআপ করা। কিন্তু পিবিএক্স বসানোটা খুব একটা সহজ কথা নয়। প্রথমেই
খুঁজে বের করতে হয় পিবিএক্স কোম্পানীগুলো কি রকম। সেই কোম্পানীগুলোকে
ডাকতে হয়। তারপর পিবিএক্স এর জন্য একটা দরপত্র তৈরি করতে হয়। তারপর
পিবিএক্স সিস্টেমটি বসানো হয়। কিন্তু বর্তমানে নতুন প্রযুক্তি ভিওআইপি
(Voice Over Inernet Protocol) এসেছে এবং এটি যদি আমরা ব্যবহার করি, তবে
একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যাপারটা অনেকটাই সহজ হয় পিবিএক্স সিস্টেম বসানোর
তুলনায়।
প্রথমেই সব থেকে যে সুবিধাটা পাওয়া যায় তা হলো খুব কম খরচে এটি চালু করা
সম্ভব। আরেকটা সুবিধা হলো, আগের টেলিফোন সিস্টেম ব্যবহার করেই চালু করা
সম্ভব। অর্থাৎ কোন একটা প্রতিষ্ঠানে যদি আগে থেকেই কোন একটা পিবিএক্স
সিস্টেম থাকে, তবে সেই সিস্টেমটাকেই ভিওআইপি’তে রূপান্তর করা সম্ভব এবং তা
খুব কম খরচে এবং নিরাপদভাবে করা সম্ভব। ভিওআইপি’তে বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস
খুব সহজে দেয়া যায়; যেটি পিবিএক্স এ দেয়া সম্ভব হয় না; কিংবা সম্ভব হলেও
অনেক ক্ষেত্রে খুব কঠিন হয়।
আমেরিকার একটি প্রতিষ্ঠান রবার্ট ময়েস বিশ্ববিদ্যালয়ের (Robert Morris
University) উদাহরন আমি এখানে উল্লেখ করতে চাচ্ছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দশ
বছর ধরে পিবিএক্স সিস্টেম ব্যবহার করে আসছিলেন যেটি নর্টেলের
(www.nortel.com) তৈরি। তাদের দশ বছরের এই পুরোনো সিস্টেম দিয়ে কাজ করতে
বেশ সমস্যা বোধ করছিলেন। ২০০৫ এর দিকে প্রতিষ্ঠানটি দেখলো যে, তাদের
পুরানো সিস্টেমের চ্যানেলগুলো প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। ২০০৫ এর পরে
তাদের আরো কিছু টার্মিনাল হলো এবং আরো কিছু টেলিফোন সেট কেনার দরকার হলো।
ঠিক এমন সময় প্রযুক্তি বিভাগের পরিচালক ডাইরেক্টর রেন্ডি জনসন (Randy
Johnson) ছিলেন, তিনি বলছিলেন, “যখন পিবিএক্স সিস্টেমটা আরো প্রসারিত করার
প্রয়োজন হলো, তখন তারা চিন্তা করে দেখলো আরো কি ব্যবহার করা যেতে পারে।“
তারা সমাধান পেল অপেন সোর্সের একটা ভিওআইপি পিবিএক্স সল্যুশন যার নাম
Asterisk (www.asterisk.org)। এটি অনেকগুলো সল্যুশন ও সার্ভিস দিতে পারে।
এটা তিন (৩) দিকে কলিং, কনফারেন্সিং এবং কলার আইডি দিতে পারে (Caller ID,
যিনি ফোন করবে তার নাম প্রদর্শনের ব্যবস্থা) । এছাড়াও আরো অনেক ধরনের
সুবিধা দিতে পারে। জনসন বলেছিলেন, এটা ব্যবহার করার সব থেকে সুবিধা হলো
খরচ কমানোর বিশাল একটা সুযোগ পাওয়া যায়। তিনি জানান, ভিওআইপি প্রয়োগের
কারনে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ২৫,০০০ ডলার সাশ্রয় করতে পেরেছে।
তারা ব্যবহার করেছিলেন ডিভিয়ান (www.diviun.com) নামে একটা সল্যুশন। সাথে
সার্ভার ব্যবহার করেছিলেন হিউল্যাট প্যাকার্ডের (www.hp.com) সার্ভার। এটা
হলো অপেন সোর্সে যে সমস্ত সল্যুশনগুলো আছে, সেগুলোকে ব্যবহার করা।
আসটারিক্স খুব ভালো কিছু কাজ করেছিলো তাদের ক্যাম্পাসের জন্য। তারা জুন
২০০৬ এর দিকে এই নতুন ভিওআইপি সল্যুশন ব্যবহার করা শুরু করে।
ভিওআইপি দুই ধরনের। একটা হার্ডওয়্যার ভিত্তিক, যেটা সাধারন টেলিফোনের মতো
এবং অন্যটি সফওয়্যার ভিত্তিক, যেটি ইন্টারনেটের সংযোগ থাকলে ব্যবহার করা
যায়। অবশ্য সব স্থানেই যে অপেন সোর্সের ভিওআইপি সুবিধাজনক হবে, তাও নয়।
কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান অন্যান্য কমার্শিয়াল ভিওআইপি সল্যুশন ব্যবহার করছে।
যেমন আমেরিকার স্যাম ম্যাটিও কান্ট্রি কমিউনিটি কলেজ ডিসট্রিক (Sam Mateo
Country Community College District)। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি আগে একটি
পিবিএক্স সিস্টেম আগে ব্যবহার করতো। কিন্তু পরবর্তীতে ২০০৩ সালে যখন তাদের
পিবিএক্স প্রসারিত প্রয়োজনে পড়ে, তখন তারা সিমেন্স নামে একটি কোম্পানীর
কমার্শিয়াল ভিওআইপি সল্যুশন ব্যবহার করা শুরু করে। সাধারনত কমার্শিয়াল
ভিওআইপি না বলে এগুলোকে proprietary বলে। সিমেন্স ব্যবহার করার আগে
সানফ্রান্সিসকোর সল্যুশন প্রোভাইডার টিকম (www.teecom.com) এর মাধ্যমে
তারা যাচাই করে নিয়েছিলো যে কোনটা সব থেকে ভালো হবে। টিকম যেটা করেছিলো
সেটা হলো, লেভেল অব সার্ভিস কোয়ালিটি (যেটাকে আমরা QoS বলি) যাচাই করেছিল।
তারা ভিওআইপি’টা ধীরে ধীরে স্থাপিত করেছিলো। যেমন, সেই প্রতিষ্ঠানের একজন
কর্মচারী ভাসকেলিস (Vaskelis) জানান, ভিওআইপি সল্যুশনটা এক রাতেই করা
সম্ভব নয়। এটা আমরা যেভাবে করলাম, আমাদের মোট ৮৫টা দালান আছে। এই ৮৫টা
দালানে আগে পিবিএক্স সিস্টেম ব্যবহার হতো, সেখানে ভিওআইপি সল্যুশনগুলো
স্থাপিত করলাম।
২০০৫ এর দিকে এরকম অনেকগুলো কলেজেই, বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়ার এলাকাতে
অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ভিওআইপি সল্যুশনকে গ্রহণ করে তাদের প্রতিষ্ঠানের
টেলিফোন সিস্টেমের জন্য ব্যবহারের জন্য। এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু
প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখযোগ্য, একটি হচ্ছে রেডউড সিটিতে অবস্থিত কানাডা
কলেজ। এছাড়া আরেকটি কলেজ হলো সান ব্রুনো শহরের স্কাইলাইন কলেজ।
আবার ডিসেম্বর ২০০৫ এর দিকে আরেকটি কলেজ স্যাম ম্যাটিও এটা গ্রহন করলো।
স্যাম ম্যাটিও’র তিনটি ক্যাম্পাসেই ভিওআইপি স্থাপন করেছিলো। এভাবে বিভিন্ন
কোম্পানীগুলোতে ভিওআইপি সল্যুশন চালু করার পর খরচ বাঁচায় প্রায় ০.৫ মিলিয়ন
ডলার। ভিওআইপি স্থাপন করার ভাবার পর কিছু কিছু পাওয়ারের প্রয়োজন হলো এর
সার্ভিস চালু করার জন্য। এই পাওয়ারগুলো কিভাবে কমানো সম্ভব, সেটা চিন্তা
করতে গিয়ে ভসকেলিস জানান, কিছু কিছু যন্ত্র আছে যেগুলো ইথারনেট থেকেই
বিদ্যুত সংগ্রহ করে। যেমন ইউএসবি মডেম। এটা ইউএসবি ব্যবহার করেই চলতে
পারে। এর জন্য আলাদা করে পাওয়ার দিতে হয় না। এভাবে ইথারনেট থেকে পাওয়ার
নিয়ে চলতে পারবে, এমন কিছু পণ্য আছে যেগুলোকে আমরা বলি পিওই (POE, Power
Over The Ethernet)। ভাসকেলিস এই ধরনের পণ্যগুলোই ব্যবহার করেছেন।
ভাসকেলিস জানান, তারা যখন ২০০৫ থেকে তাদের এই প্রোজেক্টটা শুরু করেছিলো,
আশা করা হয়েছিরো জানুয়ারী ২০০৬ এর তার ৬০% কাজ শেষ হয়ে যাবে। অর্থাৎ ৬০%
ফোন ভিওআইপি’তে নিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলো, এটা ৯৮% পর্যন্ত
এগিয়েছিলো। ২% মাত্র আগের পিবিএক্স সিস্টেম ছিলো; যা ভাসকেলিসও আশা করতে
পারেনি। তাঁরা ৫,২৫,০০০ ডলার সাশ্রয় করতে পেরেছিলেন।
তবে সব থেকে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এতে শুধু খরচই বাঁচানো নয়; বরং এর
সাথে আরো অনেক সার্ভিস যুক্ত করা সম্ভব হয়েছিলো; যা পিবিএক্স এ সম্ভব হয়
না। এর মধ্যে একটি হলো কনফারেন্স সিস্টেম। ভিওআইপি’র কিছু কনফারেন্স
সল্যুশন আছে, যা দিয়ে নিজেদের মধ্যে কনফারেন্স করা যায়। এটা একটা চমৎকার
পদ্ধতি যা আমরা প্রাত্যাহিক ব্যবহার করছি। শুধু তাই নয়, একই সাথে ইমেইল
পাঠানোও সম্ভব; কিংবা ভয়েস মেসেজগুলো ইমেইলে চলে যাবে এমন একটা পদ্ধতি
তৈরি করা যায়। ভিওআইপি’তে ফোন সিস্টেমের সাথে ইমেইলের এমন সম্পর্ক তৈরি
করা সম্ভব।
চিত্র: ভিওআইপি কোন প্রতিষ্ঠানের অভ্যান্তরিন টেলিফোন হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে
তেমনি বাহিরের টেলিফোনের সাথেও সংযুক্ত করা সম্ভব
এক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে চাই। আমাদের কনসাল্টিং
ফার্মে আমরা ভিওআইপি সার্ভিস ব্যবহার করছি। আমরাও খরচ কমানোর জন্য অপেন
সোর্সের আসটারিক্স ভিওআইপি সল্যুশন ব্যবহার করছি। এই আসটারিক্স সার্ভার
ব্যবহার হচ্ছে জাপানে ও আমেরিকাতে। আমাদের নিজেদের সাথে যোগাযোগের জন্য এই
ভিওআইপি ব্যবহার করছি। এটা থেকে সব থেকে যে সুবিধা হয় তা হলো, আমেরিকা
থেকে জাপানে ফোন করতে গেলে অনেক খরচ হতো; সেই খরচ আমরা শুন্যে নিয়ে আনতে
পেরেছি এই ভিওআইপি ব্যবহার করে।
আমেরিকা ও জাপানে আমাদের সব কর্মচারীর কাছে ভিওআইপি ফোন আছে। যখন আমরা
ভ্রমণে বাহিরে থাকি তখন সফটের মাধ্যমেই ভিওআইপি সার্ভার দিয়ে কথা বলতে
পারে আর অফিসে থাকলে ভিওআইপি ফোনটি দিয়ে কথা বলতে পারি। ভিওআইপি এর সব
থেকে সুবিধা হলো আমরা প্রায়শই কনফারেন্সে কথা বলতে পারি ও সিদ্ধান্তগুলি
দ্রুত নিতে পারি। এমনকি ভিওআইপিতে কিছু রেডিও সার্ভিস দেয়া সম্ভব হয়। ফোনে
থাকা সম্ভব না হলে ভয়েস মেইলগুলি আমাদের ইমেইলে চলে আসে। এমন কিছু কিছু
সার্ভিস আছে যা কোন পিবিএক্স সল্যুশন দিতে পারবে না, তা ভিওআইপি’তেই
সম্ভব।
আমাদের প্রতিষ্ঠানে আমরা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে ভিওআইপি
সার্ভিসটি ব্যবহার করছি। কিন্তু বাংলাদেশে হয়তোবা এই রকম না করে একটি
প্রতিষ্ঠানের জন্য ল্যান দিয়ে সার্ভার চালু করে ভিওআইপি সার্ভিস দেয়া
সম্ভব। দেখা গেছে তুলনামূলক ভাবে পিবিএক্স থেকে এটি কম খরচে চালু করা
সম্ভব। যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে পিবিএক্স থেকে ভিওআইপি’তে খরচ কম পড়ে। শুধু
তাই নয়, এই রক্ষনাবেক্ষনের যে খরচটা আছে তা পিবিএক্স এর ক্ষেত্রে একটু
বেশি। পিবিএক্স প্রসারিত করার সময় খরচটা একটু বেশিই পড়ে যায়। কিন্তু
ভিওআইপি সল্যুশন ব্যবহার করলে কম খরচ হয়।
আমাদের দেশে ভিওআইপি নিয়ে এখন বেশ আলোচনা হচ্ছে। তবে ভিওআইপি বলতে অনেকের
ধারণা বিদেশে সস্তায় কথা বলার জন্যই এটি ব্যবহার হয়। প্রকৃতপক্ষে তা নয় যে
কোন প্রতিষ্ঠান এই ভিওআইপি সিস্টেমটি ব্যবহার করতে পারে তাদের অভ্যান্তরীন
ফোনের কাজে। উদাহরণ হিসাবে দেয়া যায়, একটি গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রির শাখা
ঢাকায় আছে, চট্টগ্রামে আছে, রাজশাহীতে আছে। তাদের যোগাযোগের জন্য ভিওআইপি
সিস্টেম ব্যবহার করা যায়। একই ভাবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এটির
প্রয়োগ সম্ভব। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিস ও ছাত্রাবাস গুলিতে টেলিফোন
সিস্টেম হিসাবে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
(প্রবন্ধটি আমার দেশ, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৭ এ প্রকাশিত: লিংক)
বণার্নাধর্মী লেখাটি পড়ে ধর্য্য হারিয়ে ফেলেছি।
Jodio onek prono hoye giyeche, tobuo khub valo laglo. Amra ekhon VOIP niye khub mete achi. Sei somoye apnar lekhata khub improtant chilo.