প্রথম আলো থেকে সংগ্রীহিত
বাংলাদেশের সামনে অপার সম্ভাবনা
মনজুর আহমেদ | তারিখ: ০৪-১১-২০১০
জার্মানির বিখ্যাত হুগো বস ও অ্যাডিডাস ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে সরাসরি
পোশাক কিনতে বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করছে। আগামী বছর তারা পোশাক কিনতে শুরু
করবে। বিশ্বখ্যাত এই দুই প্রতিষ্ঠান পোশাক কিনতে ভিয়েলা টেক্স গ্রুপের
সঙ্গে কাজ করছে।
কেবল হুগো বস ও অ্যাডিডাসই নয়, বিশ্বের নামীদামি সব কোম্পানি-ব্র্যান্ড,
খুচরা বিক্রেতা এখন বাংলাদেশমুখী। নামীদামি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ছোট ও
মাঝারি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এবং খুচরা বিক্রেতারাও বাংলাদেশে ভিড় করছেন।
চীন, শ্রীলঙ্কা, তুরস্কসহ অনেক দেশ থেকেই ক্রেতারা মুখ ঘুরিয়ে বাংলাদেশে
আসছেন পোশাক কিনতে।
যেসব কোম্পানি এত দিন অন্য দেশে তাদের অফিস বা অন্য কোনো
ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে (বায়িং হাউস) বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনত, তারাও
এখন সরাসরি এখানে আসছে। এতে করে বাংলাদেশ পোশাক বিক্রি করে ১৫ থেকে ২০
শতাংশ বেশি মূল্য পাবে।
পাশাপাশি উচ্চমূল্যের ও মানসম্পন্ন তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনাও
তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। খুবই মানসম্পন্ন কাপড় কিনে বিক্রি করে জার্মানির
অ্যাডি বায়ার, এস অলিভার, স্পিরিট, আমেরিকার ডিকেএনওয়াই, কোল, টমি হিল
ফিগার। অ্যাডি বায়ার শ্রীলঙ্কা থেকে চলে এসেছে বাংলাদেশে। কাজ দিয়েছে
দেশের অন্যতম একটি পোশাকশিল্পকে।
ইন্ডিটেক্স ইউরোপের বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড হলো
জারা, পুলেন বিয়ার, প্রেসকা। ইন্ডিটেক্স বাংলাদেশে নতুন আঙ্গিকে আসছে।
ইউরোপের বেনিটেল, স্পিরিট, পেনিটন, ম্যাক্স, ম্যাঙ্গো—সবাই এ দেশে তাদের
কার্যক্রম বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান নেক্সট এখানে
কার্যক্রম বন্ধ করেছিল, তারাও আবার খুলেছে। জেসিপেনি, এএনএফ—এরাও
কার্যক্রম বাড়িয়েছে।
গত আগস্ট মাসে লিবাইস ব্র্যান্ড অর্থাৎ ভিএফ করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট ও
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইরিক ওয়াইজম্যান বাংলাদেশ সফর করেন। আর
গত মে মাসে আসেন টেসকোর আন্তর্জাতিক ক্রয় পরিচালক ক্রিস্টোফি রোসেল।
ওয়ালমার্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডুগ ম্যাকমিলন এসেছিলেন গত
ফেব্রুয়ারিতে। ওয়ালমার্ট প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখনই বছরে ১০০ কোটি
ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য কেনে বাংলাদেশ থেকে। তাদের ইচ্ছা এই পরিমাণ
দ্বিগুণ-তিনগুণ করা। বাকিরাও বাংলাদেশ থেকে আরও বিপুল পরিমাণ পোশাক কিনতে
আগ্রহ দেখিয়েছে। জানতে চেয়েছে, ৩০-৪০ শতাংশ বেশি পণ্য কিনতে চাইলে
বাংলাদেশের সরবরাহকারীরা তা সময়মতো দিতে পারবে কি না।
একজন ব্যবসায়ী জানান, এ বছরের ১ মে রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে আয়োজিত এক
বৈঠকে টেসকোর ক্রিস্টোফি রোসেল জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের গ্যাস-বিদ্যুৎ
খাতের পরিস্থিতি ও বন্দর অব্যবস্থাপনার মধ্যে ৩০-৪০ শতাংশ বেশি পণ্য
কীভাবে দেবেন।
ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে জাপানেও বাংলাদেশের বড় বাজার তৈরির বেশ সম্ভাবনা
দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ দেওয়ার জন্য একাধিকবার
এখানে এসে বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শন করেছে। অনেকটা পথও এগিয়েছে কেউ কেউ।
জাপানের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান মারুবিনি, বড় খুচরা বিক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ওয়ান
ওয়ার্ল্ড এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
ডেনিম বা জিন্স পোশাক অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশ রপ্তানি করছে। দেশের মোট
পোশাক রপ্তানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৫০ কোটি ডলারের ডেনিম পোশাক রপ্তানি
হয় বিদেশে। এখন যুক্ত হয়েছে নতুন ও অত্যাধুনিক মানসম্পন্ন রোপ ডেনিম।
দারুণ এক সম্ভাবনার পণ্য হিসেবে মনে করা হয় এই রোপ ডেনিমকে। এত দিন
বাংলাদেশ কম দামে বিপুল পরিমাণ জিন্স পণ্য বিদেশে পাঠাত। এখন আরও যুক্ত
হয়েছে ফ্যাশন ও দামি ডেনিম তৈরি। রোপ ডেনিমের দুটি শিল্পও স্থাপন হয়েছে
দেশে। এনভয় গ্রুপ প্রথম দেশে রোপ ডেনিমের টেক্সটাইল মিল স্থাপন করে। তারা
প্রায় ৪০ বছরের পোশাক খাতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ডেনিম কাপড় রপ্তানি
করেছে, কাজও পাচ্ছে বিপুল পরিমাণে। গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ
বলেন, তাঁরা ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কা, ভারত, জার্মানি ও তুরস্কে কাপড় রপ্তানি
করেছেন। মিসরেও রপ্তানির প্রক্রিয়া চলছে। তিনি বলেন, ‘বড় বড় ক্রেতা এখন
ডেনিম পোশাকের কাপড় কিনতে আমাদের নির্বাচন করছে।’
দেশে স্থাপিত ২০-২২টি জিন্স বা ডেনিমশিল্পের প্রায় প্রত্যেকেই তাদের
উৎপাদনক্ষমতা দ্বিগুণ করার প্রস্তুতি নিয়েছে। বিশ্বের এক নম্বর ডেনিম
বিক্রেতা ভারতের অরবিন্ধ নামের একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের কুমিল্লা
ইপিজেডে কারখানা স্থাপন করছে।
বাংলাদেশের পোশাক খাতের বিপুল এসব সম্ভাবনার বড় কারণ নেপাল ও পাকিস্তানের
দিক থেকে ক্রেতাদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। রাজনৈতিক অস্থিরতাই এর বড় কারণ।
আবার ভারতের মুদ্রার মান যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়ায় তারাও প্রতিযোগিতায় টিকে
থাকতে পারছে না। কম্বোডিয়ার রপ্তানির পরিমাণ বেশি বড় নয়। ভিয়েতনামে
শ্রমিকের মজুরি অনেক বেড়েছে। আর সারা বিশ্বের মধ্যে অত্যন্ত দাপুটে
রপ্তানিকারক দেশ চীন ও তুরস্কের উৎপাদন খরচ বেড়েছে অনেক। এতে তারা
আন্তর্জাতিক বাজারে কম মূল্যের পণ্য জোগান দিতে পারছে না। অন্যদিকে
তাইওয়ান, কোরিয়া, জাপান একসময় পোশাক ও বস্ত্র খাতে ব্যাপক প্রসার ঘটালেও
এখন তারা নিজেরাই বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনছে।
গত বছর বিশ্বমন্দার মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিশ্বব্যাপী ভোগ কমায় রপ্তানি আয়ে এর প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক
গতিপ্রবাহে দেখা যাচ্ছে, উচ্চমূল্যের পণ্যের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কম
দামের পণ্যের বাজার ব্যাপক চাঙা।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশের সামনে এখন বিপুল সম্ভাবনা। বলা যায়, সম্ভাবনা
নিজেই হাজির হয়েছে বাংলাদেশের দুয়ারে। এখন এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে কি
না, সেটাই বড় প্রশ্ন বলে মানছেন উদ্যোক্তারা।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদি
বলেন, ‘যেভাবে ক্রেতারা বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছে, তাতে রপ্তানি আয় দ্বিগুণ
করা কোনো বিষয়ই হতো না, যদি জ্বালানিশক্তি ও বন্দর-অবকাঠামো নিশ্চিত করা
যেত।’
গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে শিল্প বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা চলছে তা দূর
হয়নি। নতুন করে গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। সারা দেশে অসংখ্য
শিল্প-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগের অভাবে কাজ শুরু করতে
পারছে না। কিন্তু এর মধ্যেও পোশাক খাতে বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে দেশের
অর্থনৈতিক ভিতকে শক্তিশালী করতে চান এই খাতের উদ্যোক্তারা।
পোশাক খাতের সাম্প্রতিক অগ্রগতির আরেকটি কারণ হচ্ছে নিট খাতের পশ্চাদমুখী
সংযোজন অর্থাৎ বস্ত্র খাতের বিকাশ। আবার ওভেন পোশাকের মধ্যে জিন্স বা
ডেনিমেরও টেক্সটাইল শিল্প গড়ে উঠেছে। নিট পোশাক মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি
ফজলুল হক মনে করেন, ‘এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে আমাদের শিল্পের
উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে হবে, তা যেমন বর্তমান স্থাপিত শিল্পের ক্ষেত্রে,
তেমনি নতুন স্থাপনের মাধ্যমেও।’ কিন্তু সবার মতো তাঁরও আশঙ্কা জ্বালানি
নিয়ে।
একইভাবে চট্টগ্রাম বন্দরও রপ্তানিমুখী এই শিল্পের সম্ভাবনাকে আটকে দিচ্ছে
বলে মনে করেন বিজিএমইএর সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদি। তিনি বলেন,
সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে রপ্তানিতে ৩০ শতাংশের বেশি যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার
একটা বড় অংশের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রত্যাবসিত হবে না। কারণ অনেক
ক্ষেত্রেই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য রপ্তানি করতে ব্যর্থ হয়ে
রপ্তানিকারকেরা ফিরিয়ে এনে বিমানে পাঠিয়েছেন। এ জন্য ক্রেতাদের সঙ্গে
আলোচনা করে রপ্তানিকারকেরাই রপ্তানি আয় থেকে বিমান ভাড়ার অর্থ সমন্বয়
করবেন। ফলে প্রত্যাবাসন কমে আসবে।
এদিকে দেশের ব্যাংকে এখনো প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে।
শেয়ারবাজারে এখন প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। দেশে
বিনিয়োগের তুলনায় সঞ্চয়ের পরিমাণ বেশি। অর্থাৎ বিনিয়োগযোগ্য প্রচুর অর্থ
রয়েছে আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতেই। কিন্তু বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিনিয়োগ
স্থবিরতায় উৎপাদন খাতে বাড়ছে না কর্মসংস্থানের হার। এ জন্য সংশ্লিষ্ট
ব্যক্তিরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং বন্দর সমস্যার সমাধান ছাড়াও রাজনৈতিক
স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেছেন, অর্থনীতি এখন
যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে বড় সম্ভাবনার ক্ষেত্র অনেকখানি তৈরিই হয়ে আছে।
সামাজিক খাতের সূচকগুলোতে আমরা সমপর্যায়ের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক
বেশি এগিয়েছি। তবে এই অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে হলে সামাজিক খাতে মাথাপিছু
সরকারি ব্যয় ও সেবার মান উন্নত করতে হবে।
ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, তৈরি পোশাক খাতে বিশ্বমন্দার প্রভাব যে কাটিয়ে উঠতে
পেরেছি, সেটা স্পষ্ট। এর পেছনে বড় কারণ আমাদের প্রতিযোগিতার শক্তি।
বিশ্ববাজার সংকুচিত হলেও সেখানে আমাদের রপ্তানির অংশীদারি বেড়েছে।
ওয়াহিদউদ্দিনের মতে, এখন পর্যন্ত আমাদের রপ্তানির বড় সাফল্য মূলত পোশাক
খাতেই। কিন্তু ওষুধ, ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি, জাহাজ নির্মাণ, প্রক্রিয়াজাত
খাদ্যসহ এমন কিছু খাতে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে সবকিছু নির্ভর করবে
আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় গুণগতমান এবং অবকাঠামো ও জ্বালানি সমস্যার
সমাধানের ওপর।
ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, ‘নিম্ন আয়ের দেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখাই
কঠিন, গণতান্ত্রিক সুশাসন তো দূরের কথা। সে ক্ষেত্রে আমাদের আশাহত হওয়ার
কারণ নেই। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং গণতান্ত্রিক সুশাসন—দুটোকেই হাত ধরাধরি
করে এগিয়ে নিতে হবে।
2010 November 04. Added from Canada, 2010 November 03.
শফিউল ইসলাম
Leave a comment