সেই ছেলেবেলা থেকেই বিজ্ঞানের যে টপিকটি আমাদের সবাইকে অবাক করে তা হল, টাইম ট্রাভেল। এটি শুধু কল্পবিজ্ঞান সিনেমা ও বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিজ্ঞানেও এ নিয়ে অনেক তত্ত্ব ও গবেষণা আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি আমরা সময়ের মধ্যে ভ্রমণ করতে পারবো? সময়কে কি আমরা পিছনে নিয়ে যেতে পারি বা ভবিষ্যতে এগিয়ে যেতে পারি?
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব (Theory of Relativity)
আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে তার আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন, যা সময় ভ্রমণের সম্ভাবনা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করে। এ তত্ত্ব অনুযায়ী, সময় এবং স্থান একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং একসাথে কাজ করে। যখন কোনো বস্তু আলোর গতির কাছাকাছি ভ্রমণ করে, তখন সময় তার জন্য ধীরে চলতে শুরু করে। এই ধারণাটিকে বলে টাইম ডাইলেশন বা সময় সম্প্রসারণ।
একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি সহজে বোঝা যাবে: যদি একটি মহাকাশযান আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে ভ্রমণ করে, তাহলে মহাকাশযানের যাত্রীদের জন্য সময় অনেক ধীরে চলে, অথচ পৃথিবীতে একই সময়ে অনেক বছর কেটে যেতে পারে। এটাই হলো আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের ফলাফল।
পরিসংখ্যান দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা
- আলোর গতি: ৩ লক্ষ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড।
- যদি আমরা আলোর গতির ৯০% গতিতে ভ্রমণ করি, তাহলে পৃথিবীতে ১০০ বছর কেটে যাওয়ার পর ভ্রমণকারী মাত্র ৪৪ বছর বয়সে পৌঁছাবে। অর্থাৎ, ৫৬ বছরের পার্থক্য তৈরি হবে।
তবে আলোর গতিতে ভ্রমণ করা বর্তমানে আমাদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু তত্ত্ব হিসেবে এটি এখনো বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়।
টাইম ট্রাভেলের অন্য তত্ত্ব: ওয়ার্মহোল (Wormholes)
বিজ্ঞানীরা আরও একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেন যাকে বলে ওয়ার্মহোল। এটি এমন একটি কাল্পনিক পোর্টাল যা দুই ভিন্ন সময় বা স্থানের মধ্যে সংযোগ ঘটায়। ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে আমরা হয়ত এক সময় থেকে অন্য সময় বা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত যেতে পারবো।
তবে এটি এখনও পরীক্ষিত নয়, এবং বাস্তব জীবনে এমন ওয়ার্মহোল খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি এ ধরনের কিছু তৈরি করার জন্য যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন, তা আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে সম্ভব নয়।
কল্পনা থেকে বাস্তবতা: আমরা কি কখনো টাইম ট্রাভেল করতে পারবো?
গবেষণার অনেক অগ্রগতি সত্ত্বেও, আমরা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নই যে, মানুষ কখনো সময় ভ্রমণ করতে পারবে কিনা। বিজ্ঞানীরা এখনও চেষ্টা করছেন এ ব্যাপারে আরও ভালো ধারণা পেতে।
পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা:
- নাসা’র এক গবেষণা অনুসারে, টাইম ট্রাভেল নিয়ে বর্তমানে প্রায় ৭৫টি ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে।
- ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক জরিপ অনুযায়ী, ৬৫% বিজ্ঞানী মনে করেন, টাইম ট্রাভেল ভবিষ্যতে সম্ভব হতে পারে, তবে তার জন্য আরও হাজার হাজার বছর প্রয়োজন।
টাইম মেশিনের ৫ মজার রহস্য!:
১. আলোর গতিতে ভ্রমণ করলে আপনি বুড়ো হবেন না!
আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব অনুযায়ী, আপনি যদি আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে ভ্রমণ করেন, তবে আপনার বয়স ধীরে বাড়বে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি ৫০ বছর ধরে মহাকাশে আলোর গতির ৯০% গতিতে ভ্রমণ করেন, তখন পৃথিবীতে হয়ত ১০০ বছর পেরিয়ে যাবে, কিন্তু আপনার বয়স হবে মাত্র ৪৪ বছর!
২. গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স: নিজেই নিজের দাদাকে মুছে ফেলবেন?
টাইম ট্রাভেলের এক মজার সমস্যা হলো গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স। যদি আপনি অতীতে গিয়ে আপনার দাদাকে কোনোভাবে মুছে ফেলেন, তাহলে আপনার জন্মই হবে না! কিন্তু যদি আপনি জন্মগ্রহণ না করেন, তাহলে আপনি অতীতে কীভাবে গেলেন? এই ধরনের সমস্যা বিজ্ঞানীদের জন্য এক ধাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩. ব্ল্যাক হোলের পাশে গিয়ে ভ্রমণ করলে সময় থেমে যেতে পারে!
বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, একটি ব্ল্যাক হোলের (অতিদানবীয় কৃষ্ণগহ্বর) কাছে গেলে সময় থেমে যেতে পারে। এর কারণ হলো, ব্ল্যাক হোলের বিশাল মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সময়কে “বাঁকা” করে ফেলে। বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে এখনও গবেষণা করছেন।
৪. ওয়ার্মহোল: মহাবিশ্বে শর্টকাট?
ওয়ার্মহোল হলো এমন একটি কাল্পনিক টানেল, যা মহাবিশ্বের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বা এক সময় থেকে অন্য সময়ে সরাসরি সংযোগ করতে পারে। ওয়ার্মহোলের ধারণা অনেকটা শর্টকাটের মতো—আপনি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দ্রুত পৌঁছাতে পারবেন, যদিও বাস্তবে এখনো এমন কিছু আবিষ্কৃত হয়নি।
৫. ভবিষ্যতে কি টাইম ট্রাভেল সম্ভব? বিজ্ঞানীরা কি বলেন?
এক জরিপে দেখা গেছে যে, পৃথিবীর প্রায় ৬৫% বিজ্ঞানী মনে করেন, ভবিষ্যতে হয়ত সময় ভ্রমণ সম্ভব হতে পারে। যদিও এর জন্য অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োজন, যা আমরা এখনও তৈরি করতে পারিনি। তবে তারা আশাবাদী যে একদিন হয়তো টাইম ট্রাভেল মানুষের জন্য বাস্তবতা হয়ে উঠবে।
উপসংহার
যদিও বর্তমানে সময় ভ্রমণ একটি কল্পনার বিষয়, তবুও বিজ্ঞানীরা সময়কে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে আপেক্ষিকতাবাদ ও অন্যান্য তত্ত্বগুলোকে কাজে লাগাচ্ছেন। ভবিষ্যতে হয়তো প্রযুক্তি এতটাই উন্নত হবে যে, আমরা সময়ের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করতে পারবো। তবে তার আগে আমাদের এই তত্ত্বগুলো সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে হবে এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি তৈরি করতে হবে।
আপনি কি মনে করেন, তা মতামতে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু?
Leave a comment