অর্থনীতিউচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ

কেন তরুণরা সুখের সংকটে ভুগছে?

Share
Share

আমরা প্রায়ই বলি, “যৌবনই জীবনের সেরা সময়!” কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা কী এই কথার সঙ্গে মেলে? এক সময়ের সেই প্রাণোচ্ছলতা কি এখনো তরুণদের মধ্যে বিদ্যমান?

শাহরিয়ার, ২২ বছর বয়সী একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, রাতে বিছানায় শুয়ে ছাদে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে ভাবে, “আমার বাবা-মা যখন এই বয়সে ছিলেন, তখন তারা চাকরি পেয়ে গিয়েছিলেন, নিজেদের স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটছিলেন। কিন্তু আমি? আমি প্রতিদিন একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি।

তরুণদের মাঝে যে উদ্দীপনা ও আশাবাদ থাকার কথা, সেটি কি সত্যিই আজকের দুনিয়ায় টিকে আছে? একাধিক গবেষণা বলছে, তরুণদের মাঝে সুখ ও মানসিক স্থিতিশীলতা কমছে, এবং এর পেছনে রয়েছে প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক চাপ, এবং সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাব।

একটি শীতের বিকেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বসে আছি, পাশের টেবিলে কয়েকজন তরুণ-তরুণী নিজেদের মধ্যে কথা বলছে—“জীবনটা যেন আটকে গেছে, কোথাও একটা গলদ আছে!” তাদের কথায় হতাশার সুর স্পষ্ট। তাদের মধ্যে একজন বলল, “আমাদের বাবা-মা যখন এই বয়সে ছিল, তখন তারা জীবনে অনেক কিছু অর্জন করছিল, কিন্তু আমরা যেন কেবল লড়াই করে যাচ্ছি!” বাকিরাও একমত হলো।

একটি সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বজুড়ে তরুণদের মাঝে সুখ কমে যাচ্ছে। ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ইকোনমিক রিসার্চ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ১৮-২৪ বছর বয়সী তরুণরা আগের তুলনায় অনেক বেশি হতাশ, উদ্বিগ্ন ও একাকীত্বে ভুগছে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যে করা এই গবেষণায় তরুণদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের ইঙ্গিত মিলেছে।

সুখের ইউ-আকৃতি: এখন আর কাজ করছে না!

সাধারণত, মানুষের সুখ একটি U-আকৃতির বক্ররেখা (Happiness Curve) অনুসরণ করে—অর্থাৎ, শৈশবে ও তরুণ বয়সে মানুষ সুখী থাকে, মাঝ বয়সে কিছুটা হতাশা আসে, পরে আবার বৃদ্ধ বয়সে সুখের অনুভূতি ফিরে আসে।

কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বলছে, এই প্রথাগত প্রবণতা ভেঙে পড়ছে! বর্তমান তরুণরা শুরু থেকেই কম সুখী অবস্থানে আছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।

তাহলে কেন তরুণদের মধ্যে সুখের অভাব দেখা দিচ্ছে?

তরুণদের সুখ সংকটের কারণসমূহ

গবেষকরা বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব

১. সামাজিক মাধ্যম ও স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার

তরুণদের মানসিক সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার

  • ২০১২ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী কিশোর ও তরুণদের মধ্যে বিষণ্ণতার হার ৬০% বৃদ্ধি পেয়েছে (Journal of Abnormal Psychology)।
  • ২০২৩ সালে করা পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে দেখা গেছে, ১৮-২৪ বছর বয়সীদের ৭৩% মনে করে সোশ্যাল মিডিয়া তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর
  • তরুণদের ৫৪% প্রতিদিন গড়ে ৪ ঘণ্টারও বেশি সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটায়, যা একাকীত্ব ও আত্মবিশ্বাসের অভাব তৈরি করে
  • ২০২২ সালের গ্লোবাল ওয়েলবিয়িং রিপোর্ট অনুযায়ী, যারা দিনে ৩ ঘণ্টার বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে, তাদের বিষণ্ণতার ঝুঁকি ২.৫ গুণ বেশি

তরুণদের নিজেদের জীবন অন্যদের সাজানো সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের সঙ্গে তুলনা করার প্রবণতা বেড়েছে, যা হতাশা ও আত্মবিশ্বাসের সংকট তৈরি করছে।

২. আর্থিক চাপ ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

তরুণদের মধ্যে সুখের অভাবের আরেকটি বড় কারণ অর্থনৈতিক চাপ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা

  • বাংলাদেশে বেকারত্ব হার ১০.৬% (ILO, ২০২৩), যা তরুণদের মধ্যে উচ্চ উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
  • বিশ্বব্যাপী শিক্ষাগত ঋণের বোঝা তরুণদের কাঁধে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই, ২০২৩ সালে শিক্ষাগত ঋণের পরিমাণ ১.৭৭ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে (Federal Reserve)।
  • উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে—বাংলাদেশে শহুরে এলাকায় বসবাসের ব্যয় গত এক দশকে ৪৫% বেড়েছে (BBS, ২০২৩)।
  • বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী চাকরির বাজারের ৪৭% অটোমেশনের কারণে পরিবর্তিত হতে পারে

তরুণরা চাকরি পাচ্ছে না, ব্যবসা শুরু করার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছে না, অথচ খরচ ও দায়িত্ব ক্রমাগত বাড়ছে।

৩. বিশ্বব্যাপী সংকট ও মহামারীর প্রভাব

  • কোভিড-১৯ মহামারী তরুণদের শিক্ষা, চাকরি ও সামাজিক জীবনকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
  • মহামারীর পরে, ৭২% তরুণ বলেছে তারা আগের চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন (Global Youth Report, ২০২২)।
  • অনলাইন শিক্ষার ফলে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কমে গেছে, যা তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ করেছে।

কীভাবে তরুণরা সুখের পথ খুঁজে নিতে পারে?

১. ডিজিটাল ডিটক্স ও ব্যালেন্স তৈরি করুন

  • দিনে অন্তত ২-৩ ঘণ্টা স্মার্টফোন-মুক্ত সময় রাখার চেষ্টা করুন।
  • সপ্তাহে ১ দিন ‘ডিজিটাল ফাস্টিং’ করুন—সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন।
  • রাতের খাবারের সময় মোবাইল স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুন, পরিবার বা বন্ধুদের সাথে সরাসরি সময় কাটান।

২. বাস্তব জীবনের যোগাযোগ বাড়ান

  • পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সরাসরি সময় কাটান।
  • স্থানীয় কমিউনিটি বা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে যুক্ত হন।
  • নিয়মিত আউটডোর অ্যাক্টিভিটিতে অংশ নিন, যেমন—খেলাধুলা, হাঁটা বা ভ্রমণ।

৩. মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিন

  • পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যায়াম, ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করুন।
  • মানসিক চাপ কমানোর জন্য মেডিটেশন ও যোগব্যায়াম চর্চা করুন।
  • প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিন।

৪. ক্যারিয়ার ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য পরিকল্পনা করুন

  • ফ্রিল্যান্সিং, স্টার্টআপ বা উদ্যোক্তা হওয়ার দিকেও মনোযোগ দিন।
  • ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঠিক রেখে ধাপে ধাপে কাজ করুন।
  • দক্ষতা উন্নয়নের জন্য অনলাইন কোর্স ও ট্রেনিং নিন।

উপসংহার

আমাদের যুবসমাজ যদি হতাশাগ্রস্ত হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ জাতির উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সামাজিক পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

আমরা কি পারবো AI ও প্রযুক্তিকে মানবকল্যাণের জন্য ব্যবহার করতে? আপনি কী ভাবছেন? আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না!

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগগবেষণায় হাতে খড়ি

বাংলাদেশে গবেষণার ভবিষ্যৎ: চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা ও করণীয়

বাংলাদেশে গবেষণার ভবিষ্যৎ আবিষ্কার করুন, যার মধ্যে রয়েছে তরুণ গবেষকদের মুখোমুখি হওয়া...

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগগবেষণায় হাতে খড়ি

বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রত্যাহার বা রিট্র্যাকশন

জালিয়াতি, তথ্য কারসাজি এবং ভুয়া পিয়ার রিভিউয়ের কারণে বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রত্যাহারের হার...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.