গবেষণায় হাতে খড়ি

কী নিয়ে পড়বো? বুঝতে পারছি না

Share
Share

ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল দশটা। রেজাল্ট বের হওয়ার পরদিন আমাদের ঘরে উৎসবের আমেজ। এসএসসি পরীক্ষায় আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি, আত্মীয়স্বজন থেকে পাড়া-প্রতিবেশী সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে। আনন্দে বাড়িতে মিষ্টি বিতরণ চললো, পাড়ার এক আন্টি খুশিতে আমার মুখে মিষ্টি তুলে দিলেন। মা খুশিতে বারবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন, “তুই আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছিস!” বাবা গর্বিত চোখে লোকজনকে বলছেন, “আমার ছেলে এবার সেরা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হবে।” সবার মুখে হাসি, শুধু আমি চুপচাপ।

প্রচুর মানুষ আমাকে ঘিরে আছে, কিন্তু আমার মন কোথাও হারিয়ে গেছে। চারপাশের আলাপ শুনি: “বিজ্ঞান পড়বে নিশ্চয়, ভবিষ্যতে ডাক্তার না ইঞ্জিনিয়ার?” আমার আত্মীয় এক চাচা বললেন, “বিজ্ঞান নিলে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ থাকবে। না হলে এত ভালো ফলের কী দাম?” আমি মৃদু হাসি দিয়ে মাথা নাড়ালাম। ভিতরে ভিতরে আমি দোটানায় পড়েছি। সত্যি কথা বলতে, আমি নিজেই জানি না আমি কী পড়তে চাই। এতদিন শুধু ভালো রেজাল্টের পেছনেই ছুটেছি, কখনও ভেবে দেখি নি যে আমার আসল আগ্রহ কোন বিষয়ে।

সেদিন রাতে সবাই চলে যাওয়ার পর, নিজের ঘরে পড়ার টেবিলে চুপচাপ বসে আছি। বই খাতা এলোমেলো পড়ে আছে, কিন্তু মনে শান্তি নেই। মনে পড়ছে স্কুলের শেষ দিনের কথা। ক্লাস টেনের শেষ দিনে আমাদের শ্রেণিশিক্ষক সবাইকে এক এক করে জিজ্ঞাসা করছিলেন, “বড় হয়ে তোমরা কী হতে চাও?” কতজন কত কিছু বলল – কেউ বলল ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ডাক্তার, কেউ বা বলল সরকারি চাকরিজীবী। আমার পালা আসতে আমি থমকে গিয়েছিলাম। কী বলব বুঝতে পারছিলাম না, কারণ আমার কোন পরিষ্কার স্বপ্ন তখন ছিল না। লাজুক হেসে বলেছিলাম, “এখনো ভেবে দেখিনি”, ক্লাসে কয়েকজন হাসাহাসি করেছিল।

সেই মুহূর্তটার কথা ভাবলে এখনও অস্বস্তি লাগে। আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম, আসলেই আমার কী ভাল লাগে? পরীক্ষায় ভাল করতে করতে, টিউশন আর কোচিং করতে করতে কখন যে নিজের পছন্দের কথা ভাবা ভুলে গেছি জানি না। আমার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল: সবাই এত বড় বড় স্বপ্ন দেখছে, আমি কেন কিছু ঠিক করতে পারছি না?

চাপের ভার

কয়েক সপ্তাহ পর আমি শহরের সেরা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম। চারদিক থেকে অভিনন্দন আর আশীর্বাদ পেলাম, কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি এখনও অনিশ্চিত। ভর্তির প্রথম দিন ক্লাসে পরিচয় পর্বে সবাই নিজেদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নিয়ে কথা বলল। অধিকাংশই ডাক্তার বা প্রকৌশলী হওয়ার কথা বলছে। আমি নিজেকে খুব ছোট মনে করতে লাগলাম, কারণ আমার এখনও মনে স্থির নেই আমি ভবিষ্যতে কী হব। তবু পরিচয়ের সময় বললাম, “বিজ্ঞান পড়ছি, ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে আছে,” কথাটা নিজেরই কেমন যেন লাগে।

নতুন ক্লাসের পড়াশোনা শুরু হলো। আগের মতোই আমি পরিশ্রম করছি, কোচিংয়ে যাচ্ছি, দিনরাত পড়ছি। কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও একটা চাপ অনুভব করি। রাত জেগে ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রির কঠিন সূত্র মুখস্থ করছি, কিন্তু বারবার মনে প্রশ্ন জাগে: আমি কি সত্যিই এগুলো নিয়ে পড়তে চাই? বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে আমি যেন মেশিন হয়ে গেছি। স্কুল, কোচিং, পড়া, পরীক্ষা – এই চক্রে নিজেকে বন্দী লাগতে লাগল।

বাসায় বাবা প্রায়ই জানতে চান, “কোচিং কেমন চলছে? প্রস্তুতি তো ঠিকঠাক?” মা বলেন, “আগামী বছর ভর্তি পরীক্ষা, এখন থেকেই সিরিয়াস হও।” আমি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলি, কিন্তু মনে মনে হাঁপিয়ে উঠি। একদিন রবিবার বিকেলে একটু গল্পের বই পড়ছিলাম, মা দেখে বললেন, “এখন এসব গল্পের বই পড়ার সময় না, পড়ায় মন দাও।” আমার পছন্দের জিনিসগুলোকে সব সময় শখ বলে এড়িয়ে যেতে দেখেছি বড়দের। পড়াশোনাই নাকি সবকিছু ঠিক করে দেবে ভবিষ্যতে।

কিছুদিন পর প্রথম সাময়িক পরীক্ষার ফল বের হলো। আমি আগের মতন সেরা নম্বর পাইনি, গড়পড়তা ফল হয়েছে। বাবা ফল শুনে একটু বিরক্ত হলেন। রাতের খাবারের টেবিলে তিনি বললেন, “এভাবে চালালে চলবে? এতটা মনোযোগী হয়ে পড়িস নি মনে হচ্ছে। মনে রাখিস, মেডিক্যালে ভর্তি হতে হলে কঠিন প্রতিযোগিতা পার হতে হবে।”

আমি চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়লাম। নিজের ঘরে গিয়ে ভাবতে লাগলাম। বাবা এতটা বিরক্ত হলেন দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাবা-মা আমার জন্য কত কিছু করছেন, আমার ভালো ভবিষ্যৎ দেখাই তাদের স্বপ্ন। হয়তো বাবা নিজে ইচ্ছা থাকলেও জীবনযুদ্ধে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেননি, তাই আমার মাধ্যমে সেই স্বপ্নটা দেখতে চান। কিন্তু আমার কি সত্যিই সমস্যা হচ্ছিল মনোযোগ দিতে? নাকি আমি বিষয়গুলোতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি? আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন পড়ার টেবিলে বসলে মন অন্যদিকে চলে যায়, কেন পড়া মুখস্থ করতে ইচ্ছে করে না। আগে তো পড়াশোনা ভালই লাগত! নাকি শুধু পরীক্ষা ভাল করার লক্ষ্যেই পড়তাম?

কলেজে আমার এক বন্ধু ছিল, নাম আরিফ। ও সবসময় কম্পিউটার নিয়ে মগ্ন থাকত। ক্লাসের ফাঁকে প্রোগ্রামিং নিয়ে বই পড়ত, বিকেলে বাসায় গিয়ে কোডিং করত নানা প্রোজেক্ট। ওর চোখে একটা আলাদা উজ্জ্বলতা দেখতাম যখন নতুন কিছু সফটওয়্যার বানানোর কথা বলত। আরিফ দৃঢ় কণ্ঠে বলত, “আমি বুয়েটে কম্পিউটার সায়েন্সেই পড়ব। এর জন্য যা করতে হয় করব।” ওকে দেখে আমি মুগ্ধ হতাম, ও কেমন করে এত নিশ্চিত নিজের নিয়ে! আমার নিজের জন্য তখন আফসোস হত – আমারও যদি এমন কোন জিনিস থাকত যেটা করতে গিয়ে সব ভুলে যেতে পারি! ক্লাসে আমি মাঝেমধ্যে বোঝার ভান করতাম যেন আমিও খুব লক্ষ্যে স্থির, কিন্তু নিজের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগত।

আগ্রহের খোঁজ

কলেজের ব্যস্ততার মাঝে একদিন আমার আলমারি গুছাতে গিয়ে পুরনো একটি ডায়েরি পেলাম। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে ধুলো ঝাড়তেই ভেতরে রাখা কয়েকটা পৃষ্ঠা বেরিয়ে এল – আমার স্কুল জীবনের পুরনো লেখা, ছোটবেলায় লেখা একটি গল্প। ক্লাস সেভেনে স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল সেটা। কৌতূহলে বসে পড়ে পড়তে লাগলাম নিজের পুরনো লেখা। সেই শিশুসুলভ ভাষা, সরল কল্পনার গল্প পড়ে বুকের ভেতর একটা হারানো উত্তেজনা টের পেলাম। ভাবলাম, কতদিন হলো আমি মন খুলে কিছু লিখি না! লেখালেখি ছোটবেলায় ভীষণ পছন্দ করতাম, গল্প-কবিতা লিখে বন্ধুদের পড়তে দিতাম। এসএসসি’র পড়ার চাপে ধীরে ধীরে সে শখটা হারিয়ে গেছে।

ডায়েরিটা পড়া শেষ করে আমি নতুন একটা খাতা বের করলাম। অনেকদিন পর মন থেকে কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করছি। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে একটি ছোট গল্প লেখা শুরু করলাম। লিখতে লিখতে টের পেলাম আমার মনের অনেক চাপ যেন কমে যাচ্ছে। শব্দের ভেতরে নিজের অনুভূতিগুলো ঢেলে দিচ্ছিলাম। ঘড়ির কাঁটা কখন যে দুটো পেরিয়ে গেছে খেয়াল নেই; গল্পের শেষে পৌঁছে দেখি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলেছি, কিন্তু মনে এক অদ্ভুত স্বস্তি লাগছে।

পরদিন কলেজে বাংলা ক্লাস শেষে সাহস করে বাংলা শিক্ষকের কাছে গেলাম। স্যার আমাদের সাহিত্য পছন্দ করেন, ক্লাসে প্রায়ই লেখা জমা দিতে বলেন। আমি লজ্জা লজ্জা ভাবে তাকে বললাম, “স্যার, আমি একটা ছোট গল্প লেখার চেষ্টা করেছি। আপনি কি একবার পড়ে দেখবেন?” উনি অবাক হলেও হাসিমুখে খাতা নিলেন। পরের দিনই স্যার আমাকে টিচার্স রুমে ডাকলেন। ভাবলাম হয়তো কোথাও ভুল হয়েছে। কিন্তু গিয়ে দেখি স্যারের মুখে প্রশংসার হাসি। তিনি বললেন, “তোমার গল্পটা পড়েছি। দারুণ লেখা! তুমি তো বেশ ভালো লেখো, আগে বলেনি কেন?”

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “স্যার, অনেক দিন পরে লিখলাম… ঠিক জানি না ভালো হলো কিনা।” স্যার উৎসাহ দিয়ে বললেন, “অবশ্যই ভালো হয়েছে। তোমার লেখার ভিতরে অনুভূতি আছে, মনের কথা প্রকাশ করতে পারছো। এগুলো চালিয়ে যাও। তোমাদের বয়সে নিজের আগ্রহগুলো খুঁজে বের করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষার পড়া তো সবাই পড়বে, কিন্তু আলাদা করে যেটা করতে ভালোবাসো সেটা বন্ধ করো না। হয়তো তোমার সত্যিকারের ক্যারিয়ার বা ভবিষ্যৎ ওই আগ্রহের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।”

স্যারের কথাগুলো আমার মাথায় যেন বাজতে লাগল: “নিজের আগ্রহ খুঁজে বের করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ… তোমার ভবিষ্যৎ ওই আগ্রহের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।” সেদিন বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে বারবার কথাগুলো ভাবছিলাম। আমার কী কী জিনিসে আগ্রহ আছে? লেখালেখি করতে আমার এত ভালো লাগছে কেন? মনে পড়ল, গল্প লেখা ছাড়াও আমি আগে আবৃত্তি করতে ভালোবাসতাম, স্কুলের অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করতাম। ছবি আঁকতেও ভাল লাগত ছোটবেলায়। এতদিন এসবকে স্রেফ শখ ভেবে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি, এগুলো করতে গিয়ে আমি সত্যিই আনন্দ পাই। যে আনন্দ কোন পড়ার বই মুখস্থ করে পাই না।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, পড়াশোনার বাইরে অল্প অল্প করে হলেও নিজের পছন্দের বিষয়গুলোকে সময় দেব। তাই প্রতিদিন পড়ার ফাঁকে অন্তত আধা ঘণ্টা করে গল্প লেখার বা বই পড়ার চেষ্টা শুরু করলাম। মাঝে মাঝে রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে কবিতা লিখতাম নিজের জন্য। লেখালেখি নিয়ে আমার মন আবার বাঁচতে শিখল যেন। কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তির জন্য নাম দিলাম। সেদিন মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর একটি লেখা থেকে অংশবিশেষ আবৃত্তি করলাম। শুরুতে ভীষণ ভয় লাগছিল, হাত-পা কাঁপছিল; কিন্তু একবার কবিতার লাইনগুলো বলা শুরু করার পর ধীরে ধীরে সব ভয় উধাও হয়ে গেল, মনে আত্মবিশ্বাস ফিরে এলো। আবৃত্তি শেষ করে মঞ্চ থেকে নামতেই পুরো হল করতালিতে ফেটে পড়ল। সেই মুহূর্তে আমার চোখে পানি চলে এসেছিল আনন্দে। আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছিলাম আস্তে আস্তে—আমি আসলেই একটা কিছু পারি, আমারও একটা আলাদা পরিচয় আছে পড়াশোনার বাইরেও।

পথের দিশা

এদিকে দিন কাটতে লাগল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে। বাবা-মা এখনও ধরেই নিয়েছেন আমি ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দিকেই যাব। কিন্তু আমার মনে এখন অন্য স্বপ্ন জাগতে শুরু করেছে। আমি যখনই সময় পাই, গল্প লিখি, কবিতা লিখি, বাংলা সাহিত্য পড়ি। মনে মনে ঠিক করেছি, উচ্চমাধ্যমিকের পর আমি সাহিত্য নিয়েই পড়াশোনা করতে চাইব। কিন্তু ব্যাপারটা বাবা-মাকে কীভাবে বলব ভেবে পাই না। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেক বড় আমার প্রতি। বাবা-মা নিজের জীবনে সাদামাটা ভাবে থেকেও আমার উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখেন। আমি যদি হঠাৎ তাঁদের চেনা নিরাপদ পথ ছেড়ে ভিন্ন কিছু করতে চাই, তাঁরা মেনে নেবেন কীভাবে?

এক সন্ধ্যায় বাবাকে বলব বলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বারবার ফিরে আসছি। মনের মধ্যে দ্বিধা চলছিল – কী বলব? যদি বাবা খুব রেগে যান? কিন্তু আবার ভাবলাম, আমার ইচ্ছের কথাটা না বললে উনি বুঝবেন কী করে! কিছুক্ষণ ভেবে নিজেকে বুঝালাম, যা হওয়ার হবে, তবু মনের কথা বলা দরকার। অবশেষে সাহস করে বাবার সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম।

বাবা তখন অফিস থেকে ফিরে চা খাচ্ছিলেন, আমি পাশে গিয়ে বসলাম। ধীরে ধীরে বললাম, “বাবা, একটা কথা বলব?” বাবা হাসিমুখে বললেন, “বল, কী হয়েছে?” আমি গলা শুকিয়ে আসতে লাগল, তবু বললাম, “আমি ভেবেছি যে উচ্চমাধ্যমিকের পর আমি সম্ভবত ডাক্তারি পড়ব না।” বাবা চমকে তাকালেন, “মানে? তাহলে কী করবে? ইঞ্জিনিয়ারিং?” আমি মাথা নাড়লাম, “না, আমার ইঞ্জিনিয়ারিংও ভালো লাগছে না। আমি আসলে সাহিত্য নিয়ে পড়তে চাই। বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে লেখালেখি নিয়ে এগোতে চাই।” কথাটা বলে ফেলার পর মনে হলো বুকের ওপর থেকে কোন ভার নেমে গেল, কিন্তু বাবার মুখ কঠিন হয়ে গেল। উনি একটু চুপ থেকে ধমকের সুরে বললেন, “এসব কী বলছিস? বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে এখন আর্টসে যাবে? মানুষ কী বলবে? তুই লেখক হবি? কবি হয়ে পেট চলবে?” পাশে মা এসে দাঁড়িয়েছিলেন নিঃশব্দে, তিনিও উদ্বিগ্ন চোখে আমার দিকে চাইলেন।

আমি শুকনো গলায় বললাম, “বাবা, আমি জানি আমার সিদ্ধান্তটা অপ্রত্যাশিত। কিন্তু আমি অনেক ভেবে দেখেছি – আমি লেখালেখি করতে ভালোবাসি। আমি যদি বাংলা সাহিত্য পড়ি, গবেষণা করি, লেখক বা শিক্ষক হওয়ার পথেও যেতে পারি। শুধু ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়াই ভালো ক্যারিয়ার নয়, অন্য বিষয়েও ভালো কিছু করা যায়।” বাবা বিরক্ত হয়ে হাত উল্টে বললেন, “শোন, আমি কিছুই শুনতে চাই না এখন। পরীক্ষার আগে মাথা ঠান্ডা রাখ। এইসব চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ায় মন দে।” এতদিন পর এত সাহস করে মনের কথা বলেছিলাম, বাবার এমন প্রতিক্রিয়া শুনে আমার চোখে পানি এসে গেল। কিছু বলতে গিয়ে গলায় কথা আটকে গেল, দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম।

সে রাতটা খুব কেঁদেছিলাম। মা এসে অনেকক্ষণ পাশে বসে রইলেন, চুপচাপ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি সরাসরি কিছু বললেন না তখন, কিন্তু বুঝলাম তিনি আমার মনের অবস্থাটা একটু হলেও বুঝেছেন। বাবা হয়তো রেগে গেছেন, কিন্তু মা নিশ্চয়ই বুঝবেন – এই আশা নিয়ে একটু শান্ত হলাম। মা যাওয়ার সময় শুধু বললেন, “তোর বাবাকে সময় দে, উনি আস্তে আস্তে ঠিক বুঝবেন। তুই আগে পরীক্ষাটা ভালো করে দে।”

কয়েক মাস পর আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলো। পরীক্ষাও বেশ ভালোই দিয়েছি। তবে মনের ভেতর দুর্ভাবনা ছিল – আমি কি পারব নিজের পথ বেছে নিতে? নাকি শেষ পর্যন্ত আবার সকলের চাপে হার মেনে বাবার কথাই মেনে নিতে হবে? ঠিক তখনই আশ্চর্য একটা ব্যাপার ঘটে গেল। কয়েক মাস আগে জাতীয় একটি নবীন লেখক প্রতিযোগিতায় আমার লেখা একটি গল্প পাঠিয়েছিলাম। পরীক্ষার পর একদিন হঠাৎ করেই ডাকযোগে একটা চিঠি পেলাম। খাম খুলে দেখলাম সেখানে একটি সার্টিফিকেট আর চিঠি – আমি সেই প্রতিযোগিতায় সারা দেশে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছি! বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।

চিঠিটা নিয়ে দৌড়ে গিয়ে মাকে দেখালাম। মা পড়ে অবাক, “তুই গল্প লিখেছিলি এটা আমাদের বলিসনি কেন!” আমি লাজুক হেসে বললাম, “ভাবলাম পাইনি হয়তো… আজ হঠাৎ ফলাফল পেলাম।” মা সার্টিফিকেটটা হাতে নিয়ে দেখলেন, মুখে গর্বের আলো। বাবা তখন ড্রয়িংরুমে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। মা উনাকে উচ্ছ্বসিত স্বরে বললেন, “শুনছেন, আপনার ছেলে লেখার প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়েছে!” বাবা অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে সার্টিফিকেটটা বাবার হাতে দিলাম। বাবার চোখ দিয়ে দেখলাম, সার্টিফিকেটে লেখা “National Young Writers Competition – Third Prize, [আমার নাম]”। উনি নীরবে অনেকক্ষণ ধরে কাগজটা দেখলেন, তারপর ভেবে ভেবে বললেন, “তোর লেখা এত ভাল? আমি তো জানতামই না!” মা হেসে বললেন, “ও তো আমাদের বলেনি কখন লেখালেখি করে। নিজের চেষ্টায় এত বড় পুরস্কার পেয়েছে, ভাবতেই পারিনি।”

আমি সাহস করে বললাম, “বাবা, আমি লেখালেখি করতে ভালবাসি সত্যি। তুমি যদি একটা সুযোগ দাও… আমি প্রমাণ করব যে এতে আমি কিছু করতে পারব।” বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “ঠিক আছে। তুই যদি সত্যি মন দিয়ে সাহিত্য পড়তে চাস, পড়। আমি আটকাব না। আমি ভেবেছিলাম বিজ্ঞান পড়ে তুই বড় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবি, সেটাই ভালো পথ মনে করেছি। কিন্তু তোর এই গুণটা যদি থাকে, আমি চাই না তোর স্বপ্ন নষ্ট হয়ে যাক। তবে একটা কথা—যা করবি মন দিয়ে করবি, পরিশ্রমে কমতি রাখা যাবে না।” বাবার কথা শুনে আমার চোখ আবার ভিজে উঠল, তবে এবার খুশির অশ্রু। আমি উঠে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম, বললাম, “আমি কথা দিচ্ছি বাবা, মন দিয়ে পড়ব, তোমাদের নিরাশ হতে দেব না।” মা-ও পাশে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছিলেন, হয়তো তিনিও সেদিন স্বস্তি পেয়েছিলেন আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কিছুটা ঘুচে যাওয়ায়।

উপসংহার: নিজের পথে এগিয়ে চলা

উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পর জানা গেল আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। খবরটা সবচেয়ে আগে দিয়েছিলাম কলেজের সেই প্রিয় বাংলা স্যারকে, যিনি আমাকে লিখতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। স্যার ফোনের অন্য পাশে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “বলেছিলাম না তোমার ভবিষ্যৎ তোমার আগ্রহেই আছে? খুব ভালো খবর দিয়েছ তুমি!” তার আশীর্বাদ নিয়ে আমি সামনে পা বাড়ালাম।

হাতে ভর্তি ফরম নিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকছিলাম, মনে হচ্ছিল স্বপ্নের পথে প্রথম পদক্ষেপ নিচ্ছি। বাবা-মা আমার পাশে ছিলেন সেদিন, দুজনের মুখেই চিন্তা ছিল বটে, তবে আমার উচ্ছ্বাস দেখে তারাও হাসছিলেন। আমার বন্ধু আরিফও ওর ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে বুয়েটে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে ভর্তি হয়েছে। আমরা দুজনেই যার যার ভালোবাসার পথে এগিয়ে গেছি। কলেজ জীবনের দ্বিধা আর সংশয় পেরিয়ে অবশেষে আমি নিজের জন্য ঠিক করা পথে চলতে শুরু করেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃত সবুজ ক্যাম্পাসে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ছিল সেই রাতগুলোর কথা, যখন ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি কত দুশ্চিন্তায় ছিলাম। যদি তখন হাল ছেড়ে দিতাম, আজ এই স্বপ্নপূরণের পথে আসতে পারতাম না। জীবনের সেই অনিশ্চিত সময়টুকুর মধ্য দিয়েই আমি ধীরে ধীরে নিজের লক্ষ্যের সন্ধান পেয়েছি।

এই পুরো সফরটা আমার জন্য খুব সহজ ছিল না, তবে এতে আমি জীবনের কয়েকটা বড় শিক্ষা পেয়েছি:

  • নিজের আগ্রহকে খুঁজে বের করা খুব দরকার। পড়াশোনা আর পরীক্ষার চাপে কী ভালো লাগে তা ভুলে যাওয়া সহজ, কিন্তু যেটা করতে গেলে মন থেকে আনন্দ আসে সেটাই তোমার আসল আগ্রহ।
  • সবার পথ এক হয় না। বন্ধুদের বা সমাজের চাপে নিজের ইচ্ছাকে দমিয়ে দিও না। কেউ ডাক্তারি পড়ে সুখী হয়, কেউ হয়তো সংগীত নিয়ে। প্রত্যেকের নিজের ক্ষমতা আর পছন্দ আলাদা।
  • তোমার পরীক্ষার ফলই সবকিছু নয়। শুধু ভালো গ্রেড পাওয়াই সফলতার মাপকাঠি নয়, আর এক-আধটা খারাপ ফলই জীবন শেষ করে দেয় না। নম্বরের পেছনে ছুটতে গিয়ে নিজের আসল প্রতিভা বা ভালো লাগার বিষয়কে অবহেলা কোরো না।
  • ভুল করলে বা দেরি হলে হতাশ হবে না। আমি নিজেও অনেকদিন বুঝে উঠতে পারিনি কী করতে চাই। ধীরে ধীরে নানা কিছু চেষ্টা করে দেখেই আমার পথটা খুঁজে পেয়েছি। কখনো ব্যর্থতা এলে তা থেকে শেখো, কিন্তু চেষ্টা ছাড়বে না।
  • সহায়ক পরামর্শদাতা খুঁজে নাও। প্রিয় কোনো শিক্ষক, বড় ভাইবোন কিংবা বিশ্বস্ত বন্ধুর সাথে তোমার আগ্রহ ও দ্বিধা নিয়ে কথা বলো। তাঁদের অভিজ্ঞতা আর উৎসাহ তোমাকে পথ খুঁজে পেতে অনেক সাহায্য করবে।
  • পরিবারের সঙ্গে কথা বলো, তাদের বুঝানোর চেষ্টা করো। প্রথমে ভয় লাগতে পারে, কিন্তু সত্যি কথা খুলে বললে পরিবার ধীরে ধীরে বুঝতে পারে। তারা তোমার ভালই চায়, তাই যুক্তি দিয়ে বলো এবং সময় দাও।
  • নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো। আজ আমি যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাতে এগোতে গিয়ে অনেক পরিশ্রম করতে হবে, হয়তো চ্যালেঞ্জও আসবে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, মন থেকে যে কাজটি করতে ভালবাসি তাতে আমি সফল হতে পারব যদি পরিশ্রম আর ধৈর্য ধরে থাকি।

শেষে এইটুকুই বলব: তুমিও তোমার নিজের পথ একদিন খুঁজে পাবে। যদি এখনো বিভ্রান্ত বোধ করো, মনে রেখো এতে ভুল কিছু নেই। আমরা সবাই একটু একটু করে নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ বুঝতে শিখি। এই পথ খোঁজার সময়টা সহজ নাও হতে পারে, কিন্তু হাল ছেড়ো না। নিজের মনকে প্রশ্ন করো, নতুন জিনিস এক্সপ্লোর করো, যেটা ভাল লাগে তা নিয়েই মেতে থাকো। পরিবার ও প্রিয়জনদের পাশে পাওয়ার চেষ্টা করো। তুমি যে একা নও – তোমার মতো আরো অনেকেই এই উত্তর খুঁজছে। ধীরে ধীরে তুমি তোমার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে, আর যেই পথে আনন্দ পাও সেটাই তোমার সঠিক পথ। নিজের উপর আস্থা রাখো এবং স্বপ্ন দেখতে কখনো ভুলো না।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
গবেষণায় হাতে খড়ি

AI দিয়ে লেখা কি বৈজ্ঞানিক চুরি?

একাডেমিক লেখালেখিতে AI ব্যবহার কি চুরি? নীতিশাস্ত্র, বাস্তবতা এবং একাডেমিক অসদাচরণের শিকার...

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগগবেষণায় হাতে খড়ি

রিসার্চ আর্টিকেল প্রকাশের জন্য উপযুক্ত জার্নাল কীভাবে নির্বাচন করবেন?

আপনার গবেষণা প্রবন্ধের জন্য সঠিক জার্নাল কীভাবে নির্বাচন করবেন তা শিখুন। এই...

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগগবেষণায় হাতে খড়ি

কীভাবে হাই কোয়ালিটি জার্নালে গবেষণাপত্র পাবলিশ করবেন?

বিশ্বখ্যাত জার্নাল সম্পাদকদের কাছ থেকে বিশেষজ্ঞ টিপস এবং বিনামূল্যে অনলাইন কোর্সগুলি আবিষ্কার...

গবেষণায় হাতে খড়ি

গবেষণার জন্য শীর্ষ প্ল্যাজিয়ারিজম চেকার টুলস

গবেষণা, থিসিস এবং একাডেমিক লেখার জন্য সেরা চৌর্যবৃত্তি পরীক্ষক সরঞ্জামগুলি আবিষ্কার করুন।...

গবেষণায় হাতে খড়ি

Sci-Hub – এর বিকল্প প্ল্যাটফর্ম

Sci-Hub ব্যবহার না করেই বিনামূল্যে গবেষণাপত্র খুঁজছেন? বিনামূল্যে একাডেমিক বিষয়বস্তু অ্যাক্সেস করার...

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org