মহামারির শুরুর দিনগুলোতে আমরা টেলিহেলথকে ভেবেছিলাম জরুরি পরিস্থিতির অস্থায়ী সমাধান—সামান্য সময়ের জন্য চালু হওয়া এক ধরনের ডিজিটাল ব্যান্ড-এইড। কিন্তু তিন বছর পরের বাস্তবতা বিজ্ঞানীদের এক অপ্রত্যাশিত সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে: টেলিহেলথ কেবল বিকল্প নয়, বরং ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অন্যতম স্থায়ী স্তম্ভ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্য-ডেটা প্রতিষ্ঠান athenahealth-এর সাম্প্রতিক গবেষণা দেখিয়েছে যে ক্রনিক রোগীরা (যাদের দীর্ঘমেয়াদি অসুখ আছে) টেলিহেলথ ব্যবহারে তাদের সুস্থ সহপাঠীদের তুলনায় ৮৮ শতাংশ বেশি আগ্রহী। এই সংখ্যা শুধু একটি প্রবণতা নয়—এটি পরিবর্তিত স্বাস্থ্য সচেতনতা, অভ্যাস এবং আস্থার পরিচয় বহন করে।
গবেষণাটি প্রায় দুই হাজার মার্কিন নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করেছে, সময়সীমা ২০১৯ সালের শুরু থেকে ২০২২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। মহামারির প্রথম ধাক্কায় যখন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দ্বার আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তখন ভার্চুয়াল ভিজিট দ্রুতই স্বাস্থ্যসেবার মূলধারায় প্রবেশ করে। ২০২০ সালের বসন্তে মোট স্বাস্থ্যসেবা ভিজিটের প্রায় ১২ শতাংশই ছিল অনলাইন—অর্থাৎ স্মার্টফোন বা কম্পিউটার স্ক্রিনের ওপারে ডাক্তার। মহামারি কমার সাথে সাথে এই হার কিছুটা কমেছে, ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে নেমে এসেছে ৮.৯ শতাংশে। কিন্তু গবেষণা বলছে, হ্রাস পাওয়া এই শতাংশের ভেতরেই লুকিয়ে আছে টেলিহেলথের প্রকৃত সাফল্য—এটি আর জরুরি বিকল্প নয়, বরং স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিপূরক অংশ।
দীর্ঘমেয়াদি রোগীরা কেন টেলিহেলথে এত বেশি নির্ভর করছেন? এর প্রথম কারণ প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা পাওয়া। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২৩ শতাংশ রোগী নিয়মিত চেক-ইন বা ফলো-আপের জন্য টেলিহেলথ ব্যবহার করেন, আর ৯ শতাংশ ব্যবহার করেন জরুরি বা হঠাৎ উদ্ভূত সমস্যার জন্য। ক্রনিক রোগে ভুগছেন এমন রোগীদের জন্য ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, জীবনযাত্রার পরিবর্তন, রক্তচাপ বা ব্লাড সুগারের ওঠানামার মতো বিষয় নিয়মিত মনিটরিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টেলিহেলথ সেই ব্যবধানটি পূরণ করছে, যেখানে ঘরে বসেই কয়েক মিনিটের মধ্যে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া সম্ভব।
টেলিহেলথ ব্যবহারের প্যাটার্নে লিঙ্গভেদও বেশ উল্লেখযোগ্যভাবে ধরা পড়েছে। গবেষণা অনুযায়ী, নারীরা পুরুষদের তুলনায় টেলিহেলথ ব্যবহার করেন বেশি। পুরুষদের ব্যবহারের হার নারীদের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম। আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো—যেসব রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসক একজন পুরুষ ডাক্তার, তারা টেলিহেলথ ব্যবহারে ৬০ শতাংশ কম আগ্রহী, তুলনায় যাদের ডাক্তার একজন নারী। কেন এই পার্থক্য? বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নারী চিকিৎসকরা অনলাইন যোগাযোগে রোগীদের বেশি উৎসাহিত করেন, এবং সম্পর্কনির্ভর চিকিৎসা-সংলাপের ক্ষেত্রে তারা তুলনামূলক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
বর্ণভেদেও টেলিহেলথ ব্যবহারে বৈচিত্র্য দেখা গেছে। কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপানিক রোগীরা টেলিহেলথ বেশি ব্যবহার করলেও, তারা সচরাচর ধারাবাহিকভাবে কোনো একক চিকিৎসকের সাথে যুক্ত থাকতে পারেন না। অর্থাৎ তাদের টেলিহেলথ অভিজ্ঞতা খণ্ডিত, ধারাবাহিকতা কম—যা দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যসেবার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। স্বাস্থ্য সমতার আলোচনায় এই তথ্যগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ টেলিহেলথের সহজ অ্যাক্সেস থাকলেও এর মানসম্মত ব্যবহার সব জনগোষ্ঠীর জন্য সমান নয়।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা টেলিহেলথের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। জরিপে দেখা গেছে, ২৫ শতাংশ রোগী মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার কারণে টেলিহেলথ ব্যবহার করেছেন, এবং এই রোগীদের ২৩ শতাংশ ভবিষ্যতেও ভার্চুয়াল সেবা ব্যবহারের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার বা জনসম্মুখে ক্লিনিকে যাওয়ার লজ্জা অনেক সময় রোগীদের চিকিৎসা নিতে বাধা দেয়। ভার্চুয়াল ভিজিট সেই মনস্তাত্ত্বিক বাধা ভেঙে দিয়েছে, চিকিৎসা পাওয়াকে সহজ এবং স্বাভাবিক করেছে।
গবেষণার সারমর্ম একটাই—টেলিহেলথ এখন স্বাস্থ্যসেবার এক শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি কোনোভাবেই শারীরিক চিকিৎসার বিকল্প নয়, কিন্তু সেই চিকিৎসার পরিপূরক হিসেবে এর গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। জেসিকা সুইনি-প্ল্যাট, athenahealth-এর গবেষণা ও কৌশল বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট, বলেন যে টেলিহেলথ রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং নতুন ধরণের সংযোগ সৃষ্টি করে যা চিকিৎসাকে আরও মানবিক ও সহজলভ্য করে তোলে।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটি প্রযুক্তি বনাম প্রচলিত চিকিৎসার নয়; বরং কীভাবে এই দুটিকে একত্রে ব্যবহার করা যায় যাতে রোগীরা সর্বোচ্চ সুবিধা পান। ক্রনিক রোগী, মানসিক স্বাস্থ্যপ্রত্যাশী কিংবা ব্যস্ত নগরজীবনের মানুষ—সবার জন্যই টেলিহেলথ এক নতুন সম্ভাবনার দোরগোড়া খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশেও যখন ডিজিটাল হেলথকেয়ার দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে, তখন এই বৈশ্বিক গবেষণাগুলো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেয়: স্বাস্থ্যসেবা আর সীমাবদ্ধ নয় চার দেয়ালে, বরং এখন তা পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের ঘরে, হাতের মুঠোয়, স্ক্রিনের ওপারে।

Leave a comment