বর্তমান সময়ে টেকসই উন্নয়ন বা Sustainable Development বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এটি এমন এক উন্নয়ন প্রক্রিয়া, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজন মেটানো হয়। আর এই টেকসই উন্নয়নের বাস্তবায়নে রসায়ন বা কেমিস্ট্রি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রসায়ন শুধু পরীক্ষাগার বা ক্লাসরুমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি পরিবেশ রক্ষা, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে সরাসরি জড়িত। সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হলে রসায়ন হতে পারে পৃথিবীকে টেকসই রাখার অন্যতম হাতিয়ার।
টেকসই উন্নয়নের মূল স্তম্ভ
টেকসই উন্নয়নকে তিনটি স্তম্ভে ভাগ করা হয়— পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক। এই তিনটি স্তম্ভেই রসায়নের অবদান রয়েছে:
1. পরিবেশগত টেকসইতা:
দূষণ নিয়ন্ত্রণে রসায়নের ভূমিকা অপরিসীম। যেমন: পানি বিশুদ্ধকরণে অ্যাক্টিভেটেড কার্বন, ফিল্টারিং কেমিক্যাল, মেমব্রেন টেকনোলজি ব্যবহার।
বায়ু ও মাটির মান বিশ্লেষণে বিভিন্ন কেমিক্যাল টেস্ট ও সেন্সর ব্যবহার করা হয়।
জীবাণুনাশক, বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক, গ্রীন কেমিক্যালস প্রভৃতি উদ্ভাবন রসায়নের মাধ্যমে হচ্ছে।
2. সামাজিক টেকসইতা:
ঔষধ প্রস্তুতকরণ, ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট, খাদ্য সংরক্ষণের রাসায়নিক উপায়, স্যানিটেশন ব্যবস্থা—সবই রসায়নের অবদান।
স্বল্পমূল্যের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কেমিস্ট্রির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।
3. অর্থনৈতিক টেকসইতা:
শিল্প উৎপাদনে কাঁচামাল বাঁচাতে ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারেও রসায়ন প্রয়োজন।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি (বায়োফুয়েল, হাইড্রোজেন সেল) উৎপাদনে রসায়নের অবদান অর্থনৈতিক টেকসইতাকে সহায়তা করে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) ও কেমিস্ট্রির ভূমিকা
২০১৫ সালে গৃহীত ১৭টি Sustainable Development Goals (SDGs) এর মধ্যে অন্তত ১০টির সরাসরি বাস্তবায়নে রসায়নের ভূমিকা রয়েছে। যেমন:
- Goal 3 – সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ:
ঔষধ, ভ্যাকসিন, পানি বিশুদ্ধকরণ, জীবাণুনাশক উৎপাদনে রসায়ন অগ্রগণ্য।
- Goal 6 – পরিচ্ছন্ন পানি ও স্যানিটেশন:
ফ্লোরাইড/আর্সেনিক দূষণ রোধে কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট, মেমব্রেন টেকনোলজি ও রসায়নিক ফিল্টার ব্যবহার করা হয়।
- Goal 7 – সাশ্রয়ী ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি:
সৌরকোষ (solar cells), হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল, বায়োফুয়েল উৎপাদনে রসায়ন ব্যবহার হয়।
- Goal 12 – দায়িত্বশীল ভোগ ও উৎপাদন:
পরিবেশবান্ধব উৎপাদন কৌশল, গ্রীন কেমিস্ট্রি, এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কেমিস্ট্রির ভূমিকা অপরিহার্য।
গ্রীন কেমিস্ট্রি: টেকসই উন্নয়নের হাতিয়ার
Green Chemistry হলো এমন এক শাখা, যার লক্ষ্য হলো পরিবেশবান্ধব রাসায়নিক উৎপাদন এবং বিপজ্জনক কেমিক্যাল ব্যবহার কমানো। এটি টেকসই উন্নয়নের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
গ্রীন কেমিস্ট্রির মূলনীতি হলো:
- কম বর্জ্য তৈরি
- টক্সিক উপাদান ব্যবহার কমানো
- নবায়নযোগ্য কাঁচামালের ব্যবহার
- শক্তি দক্ষতা নিশ্চিত করা
আজকের দিনে প্লাস্টিক বর্জ্য কমাতে বায়োডিগ্রেডেবল পলিমার তৈরি, কৃষিতে কম বিষাক্ত কীটনাশক উদ্ভাবন, পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যাটারি তৈরি—সবই গ্রীন কেমিস্ট্রির অবদান।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রসায়নের টেকসই ভূমিকা
বাংলাদেশ একটি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ।
ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক সমস্যা মোকাবেলায় বিশেষ কেমিক্যাল ফিল্টার তৈরি করা হয়েছে।
কৃষিক্ষেত্রে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব সার উৎপাদনে দেশীয় কেমিস্টরা কাজ করছেন।
রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার জন্য রাসায়নিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বর্জ্য শ্রেণিবিন্যাস করা হচ্ছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য সোলার সেল বা বায়োগ্যাস উদ্ভাবনে রসায়ন গবেষণা অব্যাহত আছে।
একজন শিক্ষার্থী বা গবেষকের করণীয়
যদি আপনি একজন রসায়নের শিক্ষার্থী বা গবেষক হন, তাহলে ভবিষ্যতের পৃথিবীকে টেকসই রাখতে তোমার কাজ হতে পারে:
- গ্রীন কেমিস্ট্রির দিক দিয়ে গবেষণা
- দূষণমুক্ত পণ্য উদ্ভাবন
- স্থানীয় সমস্যা (আর্সেনিক, মাটির লবণাক্ততা, কৃষির সার ইত্যাদি) সমাধানে কাজ করা
- নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে প্রজেক্ট করা
রসায়নের ব্যবহার শুধু পেশাগত গণ্ডিতে নয়, বরং একটি সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হয়ে উঠছে।
উপসংহার
টেকসই উন্নয়ন ও রসায়নের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। একটি পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে হলে বিজ্ঞান, বিশেষ করে রসায়নকে কাজে লাগাতে হবে সঠিকভাবে ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। রাসায়নিক উদ্ভাবন, উৎপাদন ও ব্যবহার যদি পরিবেশ, সমাজ এবং অর্থনীতির ক্ষতি না করে উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, তবে সেটাই হবে প্রকৃত টেকসই উন্নয়ন।
আমাদের দায়িত্ব, শুধু পড়াশোনা করাই নয়—জ্ঞান দিয়ে সমাজ ও প্রকৃতির উপকার করা। কারণ আজকের রসায়নই হতে পারে আগামী দিনের সবুজ পৃথিবীর চাবিকাঠি।
হোসেন মোঃ আরাফাত
রসায়ন বিভাগ,চট্টগ্রাম কলেজ।
Leave a comment