চিকিৎসা বিদ্যাসাধারণ বিজ্ঞান

মানুষের পাকস্থলী: মস্তিষ্কের আগের শিক্ষক

Share
Share

মানুষের শরীরের একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো: আমরা সবসময়ই ধরে নিই মস্তিষ্কই নাকি সব সিদ্ধান্তের কেন্দ্র। অথচ বিবর্তন নামের হাজার কোটি বছরের মহাকাব্যে মস্তিষ্ক দেয়ালের খুবই শেষে তৈরি হওয়া একটি বিলাসিতা মাত্র। তার অনেক আগেই পৃথিবীতে যে অঙ্গটি জীবনের দিকনির্দেশ করত, তা হলো পাকস্থলী। এই সত্যটি প্রথম শোনায় অবাক লাগতে পারে, কারণ আমরা কখনোই পাকস্থলীকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অঙ্গ হিসেবে ভাবতে শিখিনি। কিন্তু আপনি একটু সময় নিয়ে ভাবলে দেখবেন, প্রত্যেক জীবের কাছে খাবারই প্রথম সমস্যা, বেঁচে থাকার প্রথম শর্ত এবং বিবর্তনের প্রথম ধাপ। তাই পাকস্থলীর জন্ম হয়েছিল brain-এর নাড়ির আগেই। আর এই প্রাচীন অঙ্গ আজও আমাদের শরীরের গভীরে বসে মানুষের আচরণ, ক্ষুধা, আবেগ, টিকে থাকার প্রবৃত্তি ; সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে চলে, এমনকি আমরা কিছুই টের পাই না।

বিবর্তনের শুরুর দিকে পৃথিবীর প্রথম জীবগুলো ছিল অত্যন্ত সরল। তাদের কোনো মস্তিষ্ক ছিল না, কিন্তু খাবার গ্রহণের একটি জায়গা ছিল, একটি থলি, যেখানে বাইরের পরিবেশের রাসায়নিক কণা ভেঙে ব্যবহারযোগ্য শক্তিতে পরিণত হতো। এই “থলি”–ই ছিল সবচেয়ে আদিম পাকস্থলী। এবং এটিই ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় বিপ্লব। বাইরের বিশৃঙ্খল জগতকে ভেতরের শৃঙ্খলায় পরিণত করা। প্রকৃতপক্ষে, মস্তিষ্ক তৈরি হয়েছিল পরে, কেবলমাত্র পাকস্থলীর প্রয়োজনগুলো দ্রুত পূরণ করতে এবং পরিবেশকে আরও কার্যকরভাবে ব্যাখ্যা করতে। অর্থাৎ stomach ছিল master, brain তার পরবর্তী assistant।

এই ধারা মানুষ পর্যন্ত এসেছে। আমাদের পাকস্থলী এখন আর শুধু একটি থলি নয়, বরং একটি জটিল রাসায়নিক ল্যাবরেটরি, 8একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী, একটি আবেগের বারোমিটার। আর সবচেয়ে বড় কথা, পাকস্থলী এখনও আমাদের আচরণের মূল চালিকাশক্তি, আমাদের পছন্দ-অপছন্দের গোপন পরিচালক এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের টিকে থাকার স্মৃতি সংরক্ষণ করা একটি জৈব ইতিহাসপুঞ্জ।

মানুষের আবেগ, ক্ষুধা, স্ট্রেস সবকিছুই এত গভীরভাবে পাকস্থলীর সঙ্গে যুক্ত যে অনেক গবেষক এখন বলতেই শুরু করেছেন, 

The stomach is the first brain.”


এই বক্তব্য কাব্যিক মনে হলেও বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার ভিত্তি অত্যন্ত শক্তিশালী। কারণ মস্তিষ্কের অনেক সিদ্ধান্তই পাকস্থলী–উদ্ভুত সিগনালের উপর নির্ভর করে। আমরা নিজেকে যতই “বুদ্ধিমান প্রাইমেট” ভাবি না কেন, আমাদের প্রতিটি দিন শুরু হয় পাকস্থলীর ক্ষুধার সংকেতে এবং শেষ হয় তার ক্লান্ত ঘড়ির নির্দেশে। এমনকি প্রেম, ভয়, উত্তেজনা সবই পাকস্থলীতে chemical footprint রেখে যায়, যেভাবে আকাশে মেঘ হাওয়া রেখে যায়।

মানবজাতির পূর্বপুরুষদের দিকে তাকালে দেখা যায় খাদ্যের প্রাপ্যতা ছিল সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা। পাথরযুগের একটি সকাল মানেই ছিল খাদ্য সন্ধানের প্রস্তুতি, আর খাদ্য না পেলে শরীরের পুরো শারীরবৃত্তীয় সিস্টেম বদলে যেত। এই পরিস্থিতিতে পাকস্থলীই ছিল সবচেয়ে সক্রিয় অঙ্গ। ক্ষুধা লাগলে ghrelin হরমোন নিঃসৃত হতো, যা সরাসরি মস্তিষ্ককে নির্দেশ দিত “এখনই খাবার পাওয়া জরুরি।”
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মস্তিষ্ক সেই আদেশ মানতে বাধ্য। আজও সেই প্রবৃত্তি অক্ষত আছে। আমরা ক্ষুধার্ত হলে মাথা ঘোরে, বিরক্ত লাগে, মনোযোগ থাকে না, এসবই stomach-originated instruction।

আরেকটি প্রাচীন সত্য হলো : পাকস্থলী সবসময়ই পরিবেশের প্রতি সবচেয়ে সংবেদনশীল অঙ্গগুলোর একটি। বৃষ্টি নামা, ঠান্ডা বৃদ্ধি, নিরাপত্তার অভাব, শিকারী পশুর ভয় এগুলো মানুষের পূর্বপুরুষদের উপর মানসিক চাপ তৈরি করত, আর সেই চাপ প্রথমে প্রতিফলিত হতো পাকস্থলীতে। ফলে তার গতিবিধি ধীর হয়ে যেত, acid কমে বা বেড়ে যেত, appetite pattern বদলে যেত। এর কারণ খুব সহজ, বেঁচে থাকা গুরুত্বপূর্ণ হলে পাকস্থলী শক্তি সঞ্চয়ের মোডে ঢুকে যায়। আজও মানুষ স্ট্রেসে খেতে পারে না বা অতিরিক্ত খায় এটা modern problem নয়, বরং millions of years old biological reflex।

মানুষের পাকস্থলীর আরেকটি অদ্ভুত দিক হলো: এটা পরিবেশ বিশ্লেষণে অত্যন্ত পারদর্শী। কোনো খাবার কতটা নিরাপদ, কতটা ঝুঁকিপূর্ণ এই সিদ্ধান্ত stomach খুব দ্রুত নেয়। এই অঙ্গের মিউকোসাল রিসেপ্টরগুলো গন্ধ, স্বাদ, তাপমাত্রা, টক্সিন সবকিছুর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে। এমনকি খাবার মুখে নেওয়ার পর হজমের আগে পাকস্থলী chemical signature বুঝতে পারে। তাই প্রথমবার কোনো খাবার খেয়ে অসুস্থ হলে দ্বিতীয়বার সেই খাবার দেখলেই বমি বমি লাগে এটা পাকস্থলীর শেখা memory। এটা brain-এর শেখা নয়।

বিবর্তনীয় দৃষ্টিতে পাকস্থলী একধরনের biological sentinel। পৃথিবীতে খাদ্য–বাহিত রোগ ছিল সবচেয়ে বড় মৃত্যুর কারণ। তাই stomach became the ultimate gatekeeper. অতিমাত্রায় অ্যাসিডিক HCl সেই প্রাচীন যুদ্ধে মানুষের অস্ত্র হয়ে আছে। এই অ্যাসিডের শক্তির কথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয় এটি লোহার টুকরা পর্যন্ত ক্ষয় করতে পারে, কিন্তু মানুষের পাকস্থলী নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে mucus–bicarbonate shield দিয়ে। এই প্রতিরক্ষা রোজ নতুন করে তৈরি হয়। প্রতি ৩–৫ দিনে পাকস্থলীর পুরো অভ্যন্তরীণ কোষতল বদলে যায়, যেন একটি শহর প্রতিদিন নতুন দেয়াল তৈরি করে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রস্তুত থাকে।

মানুষের মস্তিষ্ক ও পাকস্থলীর সম্পর্ক আসলে একটি জৈব দ্বীপের মতো surface-এ সবকিছু মনে হয় brain-controlled, কিন্তু গভীরে গিয়ে বোঝা যায় stomachই প্রথম সিদ্ধান্ত নেয়। ক্ষুধা লাগাকে আমরা অনেক সময় “simple feeling” মনে করি, কিন্তু এর পেছনে জটিল hormonal cascade কাজ করে। Ghrelin নিঃসৃত হয়, ভেগাস নার্ভ সেই সংকেত brainstem-এ পাঠায়, সেখান থেকে hypothalamus appetite center সক্রিয় করে, এরপর behavioral urge তৈরি হয়। অর্থাৎ brain-এর ক্ষুধার অনুভূতি stomach-dependent।

উল্টো দিকেও একই ঘটনা ঘটে। আপনি যখন ভয় পান, প্রথম প্রতিক্রিয়া stomach feels যাকে আমরা বলি ‘butterflies in stomach’। আবার কোনও খারাপ খবর শুনলে পেট ভারী লাগে, ক্ষুধা উধাও। Evolutionary logic খুব পরিষ্কার পাকস্থলী সেই মুহূর্তে digestive mode থেকে survival mode-এ সুইচ করে যায়। এটি দ্রুত acid secretion কমিয়ে দেয়, peristalsis ধীর করে এবং শক্তি সংরক্ষণ করে।
এই switching ability ই ছিল টিকে থাকার মূল হাতিয়ার।

মানুষের পূর্বপুরুষদের প্রতিটি ঝুঁকিই পাকস্থলীর উপর ছাপ ফেলত। নিরাপদ বনভূমি, অনিরাপদ গুহা, খাবারের অভাব, শিকারীর উপস্থিতি, সামাজিক সংঘাত সবকিছু stomach–brain axis কে গঠন করেছে। ফলস্বরূপ মানুষ আজও emotional eater, stress-faster, pleasure-seeker এগুলো কেবল অভ্যাস নয়; বরং evolutionary codes।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, যখন মানুষ কথা বলতে শিখল, চিন্তা করতে শিখল, সমাজগঠন তৈরি করল, তখনও পাকস্থলী তার প্রাচীন দায়িত্ব ছাড়েনি। এটা আজও আমাদের জৈবিক প্রোগ্রামিংয়ের চালিকা শক্তি। তাই মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে পাকস্থলীর health এতটাই গভীরভাবে জড়িত যে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটাকে বলা হচ্ছে gut–feeling নয়, বরং gut–thinking।
এখনকার গবেষণা বলছে:
মানুষের গ্যাসট্রো-ইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টে প্রায় ৫০ কোটি নিউরন রয়েছে, যাকে বলা হয় enteric nervous system।
এটি এতটাই জটিল যে অনেক সময় brain থেকে স্বাধীনভাবেই পাচনতন্ত্রের কাজ চালিয়ে যায়। অদ্ভুত হলেও সত্য পাকস্থলী ও অন্ত্রের কাজ বন্ধ করতে brain-এর অনুমতি লাগে না।

যদি মানুষকে একটি “walking ecosystem” মনে করি, তাহলে পাকস্থলী হলো তার কেন্দ্র। emotional security, food preference, survival instinct সবকিছু পাকস্থলীই প্রথম শেখায়। মানুষ ক্ষুধার্ত হলে রাগী হয়, তৃপ্ত হলে শান্ত হয়, অসুস্থ হলে flavor aversion তৈরি হয় এগুলো brain-এর কৃতিত্ব নয়। বরং stomach-coded biological algorithm।

আরেকটি গভীর সত্য হলো, পাকস্থলী আমাদের সভ্যতা তৈরিতেও ভূমিকা রেখেছে। প্রাচীন মানুষ আগুন আবিষ্কার করে রান্না শুরু করেছিল মূলত পাকস্থলীর জন্যই, raw খাবার হজমে কষ্ট দিত, cooked খাবার সহজে শক্তি দিত। রান্নার ফলে পাকস্থলীর চাপ কমে গিয়ে মস্তিষ্কে শক্তি বরাদ্দ বাড়ল। এর ফলেই মানুষের brain এর বিশাল উন্নতি হলো। অর্থাৎ পাকস্থলীর চাহিদাই মানুষের মস্তিষ্ককে বড় করল যে brain পরে মানবসভ্যতা গড়ল।

এইচ. এল. মেনকেন এর একটি বিখ্যাত কথা আছে-

“Man is what he eats.”

কিন্তু বিজ্ঞান বলছে-

“Man is how his stomach evolved.”

আমাদের খাদ্যাভ্যাস, চিন্তা, আবেগ, ইচ্ছাশক্তি সবকিছুই সেই প্রাচীন অঙ্গের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। মানুষ নিজেকে যতই বুদ্ধিমান ভাবুক, যতই যুক্তির উপর নির্ভর করুক, তার জীবন এখনও পাকস্থলীর গোপন রসায়নে বাঁধা।
এটি আমাদের প্রাচীন শিক্ষক, সংবেদনশীল অভিভাবক, টিকে থাকার নীরব পরিচালক।

হয়তো এই কারণেই আমরা এখনও কোনো কাজ করার আগে পেটের অনুভূতি শুনি।
একটি সাক্ষাৎকারে যাওয়ার আগে, পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে, খারাপ খবর পাওয়ার আগে পেটই প্রথম জানায় যে কিছু ঘটতে যাচ্ছে। Brain পরে বুঝে, stomach আগে জানে।

আর তাই বলা যায়,
মস্তিষ্ক, জ্ঞান, সভ্যতা সবই পাকস্থলীর পরে এসেছে।
মানুষের প্রকৃত প্রথম মস্তিষ্ক হলো পাকস্থলী; যা চারদিকে অন্ধকার ছিল যখন, তখনও জীবনের পথ দেখিয়ে দিত।


মো. ইফতেখার হোসেন 
এমবিবিএস ১ম বর্ষ , কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ | আগ্রহের ক্ষেত্র মূলত আচরণবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান ও অভ্যাসবিজ্ঞান।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org