কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতথ্যপ্রযুক্তি

সোশ্যাল মিডিয়ার ডিএনএতেই কি বিষাক্ততার বীজ?

Share
Share

শহরের এক ক্যাফেতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন দুই তরুণ। একজন ফোন হাতে দেখাচ্ছিলেন নানা ফেসবুক পোস্ট, অন্যজন বিরক্ত মুখে বলে উঠলেন—“দেখো তো ভাই, মানুষ নাকি না, কেমন ঝগড়াঝাঁটি, বিষাক্ত কথাবার্তা!” পাশের টেবিল থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোক হেসে যোগ করলেন, “মানুষের হাতে দিলে তো দোষ দাও, এবার শুনি রোবটেরাও একই কাজ করছে!” গল্পটা যেন মজার, অথচ এর ভেতরে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর এক বাস্তবতা।

নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সম্প্রতি এমন এক পরীক্ষা চালিয়েছেন যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। পেটার টর্নবার্গ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সোশ্যাল মিডিয়ার সহকারী অধ্যাপক, আর তার সহকর্মী মাইক লারুই তৈরি করেন এক অভিনব নেটওয়ার্ক। আশ্চর্যের বিষয়, এতে কোনো মানুষকে যুক্ত করা হয়নি। পুরো প্ল্যাটফর্ম ভরানো হয়েছিল জিপিটি-৪ও চালিত এআই বট দিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল স্রেফ দেখা—মানুষ ছাড়া শুধু প্রযুক্তি দিয়ে কি ঝগড়া, বিভাজন, কিংবা ভুয়া খবর ঠেকানো যায়?

ফলাফল ছিল চমকপ্রদ, আবার হতাশাজনকও। নানা ধরণের কৌশল ব্যবহার করা হলো—খবর ফিডকে ক্রমানুসারে সাজানো, বিভিন্ন মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা, ‘লাইক’ ও এনগেজমেন্ট লুকানো, এমনকি অ্যালগরিদমে নানা পরিবর্তন আনা। কিন্তু যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, বটগুলো দ্রুতই বিভক্ত হয়ে পড়ল দলাদলিতে, তৈরি হলো ‘ইকো চেম্বার’, আর ছড়াতে শুরু করল ভুয়া তথ্য ও বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া।

টর্নবার্গ পরে মন্তব্য করেছেন, “যদি মানুষ না থেকেও এই প্ল্যাটফর্মগুলো একই পথে চলে যায়, তাহলে বোঝা যায় সমস্যাটা মানুষের চরিত্রে নয়, বরং নকশার ভেতরেই।”

বাংলাদেশের এক তরুণ পাঠক এই খবর শুনে সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “আমরা এতদিন ভেবেছি মানুষই দোষী। এখন তো মনে হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার ডিজাইনটাই যেন আমাদের ঝগড়াটে বানানোর ফাঁদ।”

এটা নিছক একাডেমিক কৌতূহল নয়। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ গবেষণা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—বিষাক্ততা যেন প্রযুক্তির রক্তেই মিশে আছে। এক খ্যাতনামা দার্শনিকের কথা মনে পড়ে যায়, যিনি বলেছিলেন, “যে যন্ত্র তুমি তৈরি করছো, একদিন সেই যন্ত্রই তোমাকে তৈরি করবে।”

প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এতদিন নানা অজুহাত দিয়েছে। বলেছে, সমস্যা ব্যবহারকারীর; কেউ ভুয়া খবর ছড়ায়, কেউ উস্কানি দেয়। কিন্তু যদি রোবট নিজেরাই একই আচরণে লিপ্ত হয়, তবে প্রশ্ন দাঁড়ায়—এই নকশাই কি তাহলে বিভাজনকে উসকে দেয়? আর যদি তাই হয়, তবে কি কেবল কিছু ‘পলিসি আপডেট’ বা ‘কনটেন্ট মডারেশন’ দিয়ে সমাধান সম্ভব?

ঢাকার এক তরুণ সাংবাদিক মন্তব্য করলেন, “এটা যেন রাস্তা এমনভাবে বানানো যেখানে মানুষ চাইলে না চাইলে গর্তেই পড়বে। তখন দোষ দেওয়া হবে পথিককে, কিন্তু আসলে দায় তো রাস্তাঘাটের ডিজাইনের।”

প্রশ্নটা এখন গম্ভীর। যদি কেবল অ্যালগরিদম আর প্ল্যাটফর্মের কাঠামোই আমাদের চিন্তাভাবনাকে নির্ধারণ করে, তবে গণতন্ত্র, তথ্যপ্রবাহ, এমনকি সমাজের সামগ্রিক সংহতিও বিপদের মুখে পড়তে পারে। পেটার টর্নবার্গের গবেষণা হয়তো ছোট আকারে শুরু হয়েছে, কিন্তু এর বার্তা বিশাল—সমস্যা আমাদের নয়, বরং সেই সিস্টেম যা আমাদের ঘিরে রেখেছে।

এখানেই উঠে আসে নীতিনির্ধারক আর প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব। কেবল লাইক বা শেয়ার কমানো যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন প্ল্যাটফর্মের মূল কাঠামোয় পরিবর্তন। তা না হলে, আমরা যতই সচেতন হই না কেন, প্রযুক্তির নকশাই আমাদের আবার ঠেলে দেবে একই বিভাজনের গহ্বরে।

লেখক জর্জ অরওয়েল একসময় বলেছিলেন, “যে সমাজে সত্যের পরিবর্তে শব্দের খেলা চলে, সেখানে মিথ্যাই হয়ে ওঠে বাস্তবতা।” আজকের এই গবেষণা যেন সেই কথারই প্রমাণ। যদি রোবটরাও মিথ্যা আর বিভাজনে ফেঁসে যায়, তবে মানুষ কীভাবে আলাদা হবে?

শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন থেকে যায়—আমরা কি এই নকশাকে পরিবর্তন করতে পারব, নাকি কেবল দর্শকের মতো বসে দেখব রোবট আর মানুষ মিলে একই বিষাক্ত খেলার পুনরাবৃত্তি?

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org