মানুষের সভ্যতার ইতিহাস আসলে আলোর ইতিহাস। আমরা গুহার অন্ধকার থেকে বের হয়ে এসেছি আগুনের আলোয়, নক্ষত্রের আলোয় দিক খুঁজেছি, আবার বৈজ্ঞানিক যুগে পৌঁছে আলোকে ভেঙে ভেঙে বিশ্লেষণ করেছি। কিন্তু এতদিন আলো বলতে আমরা বুঝতাম তরঙ্গ বা কণার বৈশিষ্ট্যের এক দ্বন্দ্বময় অস্তিত্ব। এখন সেই আলোকে আমরা দেখতে শুরু করেছি আরেকভাবে—একটি ফোটন, অর্থাৎ আলোর ক্ষুদ্রতম কণার আকারকে নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব হয়েছে।
২০২৪ সালে ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহ্যামের গবেষকেরা প্রথমবারের মতো একক ফোটনের নির্দিষ্ট আকারকে তাত্ত্বিকভাবে চিহ্নিত করেন। তাদের গবেষণা ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস জার্নালে প্রকাশিত হয়। এটি কোনো ছবির মতো ভিজ্যুয়াল প্রতিরূপ নয়, বরং কণাটির নির্দিষ্ট সম্ভাব্য বন্টন—সময়ে ও স্থানে ফোটন কীভাবে গঠিত হয় এবং বিকশিত হয়, তার এক নিখুঁত মানচিত্র। এ যেন আলোকে আরেক ভাষায় লেখা পড়া শুরু করা।
ফোটনের আকার নির্ধারণ এতদিন বিজ্ঞানীদের কাছে এক অদৃশ্য ধাঁধার মতো ছিল। আমরা জানতাম ফোটন শক্তি বহন করে, গতিশীল হয়, আবার কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নিয়মে তার অবস্থান বা ভরবেগ একই সঙ্গে জানা যায় না। কিন্তু বাস্তবে ফোটন একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে যখন কোনো পরমাণু বা অণু থেকে নির্গত হয়, তখন তার বিস্তার একটি জটিল প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। এ প্রক্রিয়াকে এতদিন সরলীকৃতভাবে দেখা হতো। বার্মিংহ্যামের দলটি কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সকে (QED) নতুনভাবে প্রয়োগ করে দেখাল, পরিবেশের প্রতিক্রিয়াগুলো উপেক্ষা না করে বরং সেগুলোকে যুক্ত করলে ফোটনের প্রকৃত “আকৃতি” নির্ণয় করা যায়।
এখানে তারা ব্যবহার করেছেন এক বিশেষ গণিতীয় কৌশল—ছদ্মমোড (pseudomode) পদ্ধতি। এর মাধ্যমে নন-মারকোভিয়ান গতিবিদ্যা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে। সহজ কথায়, যখন একটি সিস্টেম তার অতীতের প্রভাব ভুলে যায় না, বরং সেই স্মৃতি বহন করে ভবিষ্যতের প্রতিক্রিয়ায় যুক্ত করে, তখন সেটিকে বলা হয় নন-মারকোভিয়ান। আলোককণা নির্গমন প্রক্রিয়ায় এই বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি ন্যানোপার্টিকল বা ভাইরাসের চারপাশে আলো নির্গত হলে সেই কাঠামোর সঙ্গে জটিল প্রতিফলন ও প্রতিধ্বনি ঘটে। ফলে ফোটন তার জন্মের মুহূর্ত থেকে সময়ের সাথে কীভাবে প্রসারিত হবে, সেটি নির্ভর করে ঐ পরিবেশের স্মৃতিশক্তির ওপর।
এই তত্ত্বের সাফল্য আমাদের কাছে আলোর ভাষায় নতুন বর্ণমালা এনে দিয়েছে। এখন আর আলো কেবল অদৃশ্য তরঙ্গ বা বিমূর্ত কণা নয়, বরং নির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করা যায় এমন একক কণার বর্ণময় ছাপ। এর তাৎপর্য বৈজ্ঞানিক দিগন্তে অসাধারণ। প্রথমত, কোয়ান্টাম যোগাযোগ। আমরা ইতিমধ্যেই জানি, ভবিষ্যতের নিরাপদ বার্তা আদান-প্রদানে ফোটন হবে প্রধান মাধ্যম। কিন্তু ফোটনের গঠন সম্পর্কে যদি আমরা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাই, তবে তথ্যকে আরও সুরক্ষিতভাবে সংরক্ষণ ও পরিবহন করা যাবে। গুপ্তচর বা হ্যাকারদের জন্য এটি হবে প্রায় অসম্ভব এক চ্যালেঞ্জ। আলোকে আমরা আমাদের নিজস্ব কোডে সাজাতে পারব, যা কেবল নির্দিষ্ট গ্রাহকই পড়তে সক্ষম হবেন।
দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান। ভাইরাস বা প্রোটিনের মতো ক্ষুদ্র কাঠামোর সঙ্গে ফোটনের মিথস্ক্রিয়া তাদের সনাক্তকরণে বিপ্লব ঘটাতে পারে। প্রতিটি ভাইরাসেরই একটি নির্দিষ্ট “রেজোন্যান্স” বা অনুরণন বৈশিষ্ট্য থাকে। যদি আমরা সেই রেজোন্যান্সের সঙ্গে মেলে এমন ফোটনের আকার তৈরি করতে পারি, তবে আলো হবে এক অদ্বিতীয় ডায়াগনস্টিক টুল। ক্যানসার বা ভাইরাল সংক্রমণ নির্ণয়ে দ্রুত ও নির্ভুল পরীক্ষার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
তৃতীয়ত, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান। ফোটনের আকার নির্ধারণ করে আমরা রাসায়নিক বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আলোর দ্বারা অণুর বন্ধন ভাঙা বা গড়া নতুন কোনো ধারণা নয়, কিন্তু আলোককণার সূক্ষ্ম আকার ও সময়বিন্যাস নিয়ন্ত্রণ করে যদি বিক্রিয়ার গতিপথ নির্দিষ্ট করা যায়, তবে নতুন ওষুধ, নতুন পদার্থ কিংবা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের উপাদান তৈরি করা সম্ভব হবে।
এখানেই শেষ নয়। ফোটনের এই সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণ একদিন কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে। তথ্যবাহী কিউবিট হিসেবে ফোটন ব্যবহৃত হয়, কিন্তু তাদের নির্দিষ্ট আকার জানা থাকলে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কে ত্রুটি কমে আসবে, গণনা হবে দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য।
এক কথায় বলা যায়, আমরা এখন এমন এক যুগে প্রবেশ করছি যেখানে আলো আর কেবল আলোকিত করার মাধ্যম নয়, বরং তথ্য, নির্দেশনা ও প্রযুক্তির জন্য এক নতুন ভাষা। যেমন প্রাচীনকালে মানুষ গুহার দেওয়ালে ছবি এঁকে ভাষার সূচনা করেছিল, তেমনি আধুনিক বিজ্ঞানীরা এখন আলোর কণায় লিখতে শিখছেন।
এই আবিষ্কারটির প্রভাব হয়তো আগামীকালই আমাদের জীবনে আসবে না। কিন্তু এটি একটি মৌলিক মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। একসময় যে বিদ্যুৎ কেবল প্রদীপ জ্বালানোর জন্য ব্যবহৃত হতো, তা এখন পুরো সভ্যতার শক্তির কেন্দ্রবিন্দু। আলোর ক্ষেত্রেও সেই পরিবর্তন আসতে দেরি নেই। প্রশ্ন হলো, আমরা বাংলাদেশে এর জন্য কতটা প্রস্তুত? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি আলোকবিজ্ঞান বা কোয়ান্টাম প্রযুক্তি নিয়ে সিরিয়াস গবেষণা শুরু হয়, তবে তরুণ বিজ্ঞানীরাও এই বৈশ্বিক অগ্রযাত্রার সঙ্গী হতে পারবে। কেবল প্রযুক্তি আমদানি নয়, বরং জ্ঞান উৎপাদনেও আমরা ভূমিকা রাখতে পারি।
শেষ পর্যন্ত, আলোর আকার আবিষ্কারের এই যাত্রা আমাদের শিখিয়েছে, প্রকৃতির সবচেয়ে ক্ষুদ্র রহস্যও অগাধ সম্ভাবনা লুকিয়ে রাখে। আলোর এই নতুন বর্ণমালা একদিন হয়তো আমাদের নিরাপদ যোগাযোগ দেবে, রোগ নিরাময়ে সাহায্য করবে, কিংবা নতুন পদার্থ তৈরির পথ দেখাবে। আজ যা কেবল গবেষণাগারে তাত্ত্বিক অঙ্কের খেলা, আগামীকাল সেটিই হয়তো মানবসভ্যতার ভিত্তি বদলে দেবে।

Leave a comment