নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
বাংলাদেশের আজিমপুর মাতৃসদনের ব্যস্ত করিডোর থেকে শুরু হওয়া এক চিন্তা আজ ছড়িয়ে গেছে বিশ্বের চল্লিশটিরও বেশি দেশে। Maternal and Child Health Handbook বা MCH হ্যান্ডবুকের মাধ্যমে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যতথ্যকে মায়ের হাতের নাগালে এনে এক ধরনের নীরব স্বাস্থ্যবিপ্লব ঘটিয়েছেন ড. শফি ভূঁইয়া। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাকে তিনি এমনভাবে রূপ দিয়েছেন যে তা এখন বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের একটি সফল মডেল হিসেবে স্বীকৃত।
ভোরের আলো তখনও পুরোপুরি ফুটেনি, আজিমপুর মাতৃসদন হাসপাতালে মায়েদের লাইন লম্বা হচ্ছে, কারও কোলে নবজাতক, কেউ প্রসবের অপেক্ষায়, আবার কেউ স্রেফ শিশুর টিকাদানের জন্য এসেছে। সেই ব্যস্ত করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক তরুণ চিকিৎসক, নাম তার শফি ভূঁইয়া। তিনি দেখছিলেন যে চিকিৎসকের সংখ্যা কম, রোগী অনেক, কিন্তু এর চেয়েও বড় সমস্যা ছিল স্বাস্থ্যের তথ্যের ঘাটতি, সচেতনতার অভাব, এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবায় এক ধরনের অগোছালো বাস্তবতা।
সেই দিনটির অভিজ্ঞতা তাকে এক গভীর ভাবনায় নিয়ে যায়। একজন মা যদি নিজের ও সন্তানের স্বাস্থ্য তথ্য এক জায়গায় রাখার মতো একটি নির্ভরযোগ্য উপায় পেতেন, তাহলেই কি তার স্বাস্থ্যযাত্রা আরও নিরাপদ এবং সুশৃঙ্খল হতো না? এই সহজ কিন্তু অসাধারণ প্রশ্ন থেকেই জন্ম নেয় একটি ধারণা, Maternal and Child Health Handbook বা MCH হ্যান্ডবুক, যা পরবর্তীতে কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বস্বাস্থ্যের অগ্রগতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়।
আজ বাংলাদেশে MCH হ্যান্ডবুকের প্রবর্তক এবং বিশ্বজুড়ে প্রায় চল্লিশটি দেশে এই মডেলের প্রচারের নেতৃত্বদাতা হিসেবে ড. শফি ভূঁইয়া আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু এই বৈশ্বিক সাফল্যের গল্প শুরু হয়েছিল খুব সাধারণ একটি জায়গা থেকে, একজন তরুণ চিকিৎসকের প্রশ্ন এবং মানুষের প্রতি তার দায়বদ্ধতা থেকে।
একটি হাসপাতাল, একটি পুনর্গঠন, এবং একটি দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম
২০০০ সালে জাপানের সরকারি অনুদানে আজিমপুর মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পুনর্নির্মাণ হয়। প্রতিদিন তিন শতাধিক আউটডোর রোগী, বিশ থেকে ত্রিশটি প্রসব, এবং মাতৃ ও নবজাতকসেবায় উচ্চমান বজায় রাখার যে সক্ষমতা এই প্রতিষ্ঠান অর্জন করে, তার নেপথ্যে ছিল দুই দেশের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় এবং স্বাস্থ্য উন্নয়ন নিয়ে এক তরুণ চিকিৎসকের দূরদর্শিতা। সেই চিকিৎসকই ছিলেন ড. ভূঁইয়া, যিনি বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে এই কেন্দ্র পুনর্গঠনের অন্যতম কার্যকর সংযোগসূত্র হিসেবে কাজ করেন।
এই কেন্দ্র থেকেই শুরু হয় বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ MCH হ্যান্ডবুক উদ্যোগ। এটি শুধু একটি বই নয়, এটি ছিল মাতাদের জন্য একটি সুসংগঠিত স্বাস্থ্য অভিলেখ, সচেতনতার হাতিয়ার, এবং পরিবারের স্বাস্থ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।

জাপানে গবেষণা, বাংলাদেশে প্রয়োগ, তারপর বিশ্বের পথে
ড. ভূঁইয়া ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন এবং পরবর্তীতে JSPS Post Doctoral গবেষক হিসেবে মাতৃস্বাস্থ্য শিক্ষা ও তথ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করেন। এই অভিজ্ঞতাকে তিনি বাংলাদেশের জন্য উপযোগী করে সাজান। বাংলাদেশে এর সফল বাস্তবায়ন এতটাই কার্যকর হয় যে কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ মডেলটি গ্রহণ করতে শুরু করে। আজ বহু এশীয় দেশ, আফ্রিকার অনেক অঞ্চল এবং উত্তর আমেরিকার কিছু অংশেও এই হ্যান্ডবুক একটি পরীক্ষিত নীতি উদ্ভাবন হিসেবে স্বীকৃত।
এর বিস্তৃত গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে যে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন সবসময় উচ্চপ্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে না, কখনও কখনও মানুষের হাতে ধরে রাখা একটি তথ্যবহুল বইই সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে নতুন রূপে MCH হ্যান্ডবুকের উত্থান
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রেও MCH হ্যান্ডবুকের একটি উন্নত সংস্করণ তৈরির কাজ চলছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন ড. ভূঁইয়া। আধুনিক স্বাস্থ্যতথ্য ব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল রেকর্ড, অভিবাসী ও বহুসাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে একটি নতুন, প্রযুক্তিনির্ভর ও সহজবোধ্য মডেল তৈরি হচ্ছে। এটি দেখায় যে স্বাস্থ্যগত উদ্ভাবন কেবল একটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্থান ও সংস্কৃতি অনুযায়ী রূপান্তরিত হতে পারে।

কেন MCH হ্যান্ডবুককে বিপ্লব বলা হয়
এই হ্যান্ডবুক মা এবং পরিবারের হাতে ফিরিয়ে দেয় স্বাস্থ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। একজন মা তার গর্ভকাল থেকে শুরু করে শিশুর টিকাদান, বৃদ্ধির চার্ট, পুষ্টি, অসুস্থতার লক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সব তথ্য এক জায়গায় পেয়ে যান। যেসব পরিবার আগে হাসপাতাল ঘেঁষা তথ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তারা এখন ঘরে বসে নিজের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।
এতে শুধু চিকিৎসাসেবা নয়, পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, রোগ প্রতিরোধ, এবং চিকিৎসার সঠিক সময়ে প্রবেশ, সবকিছুর উন্নয়ন ঘটে। স্বাস্থ্যসেবার এ ধরনের শক্তিশালী, মানবকেন্দ্রিক মডেলই দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আরও দক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলে।
বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক গৌরব
আমরা যখন বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার কমে যাওয়া, টিকাদান কর্মসূচির সাফল্য অথবা শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসের কথা বলি, তখন নিঃসন্দেহে MCH হ্যান্ডবুককে সেই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে ভাবতে হয়। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেওয়া এই মডেলটিকে আজ বিশ্বের বহু দেশ অনুসরণ করছে। ড. ভূঁইয়ার নেতৃত্বের মূল্য এখানেই, তিনি কেবল স্বপ্ন দেখেননি, বরং সেই স্বপ্নকে বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বস্বাস্থ্যের মানচিত্রে স্থায়ী করে তুলেছেন।

শেষ কথা
ড. শফি ভূঁইয়ার কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জনস্বাস্থ্যের প্রকৃত শক্তি মানুষের মধ্যেই নিহিত। সঠিক তথ্য, সঠিক উপকরণ এবং সামান্য বিশেষজ্ঞ নির্দেশনা মানুষের স্বাস্থ্য এবং জীবনকে বদলে দিতে পারে। আজিমপুরের সেই ব্যস্ত করিডোরে দাঁড়ানো এক তরুণ চিকিৎসকের প্রশ্ন থেকেই যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা এখন মানবসেবার এক বৈশ্বিক উদাহরণ।
বাংলাদেশ থেকে জন্ম নেওয়া এই স্বাস্থ্য উন্নয়ন মডেল আজ প্রমাণ করে যে সঠিক ভাবনা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে স্থানীয় ধারণাই বিশ্বে পরিবর্তন আনতে পারে।
তথ্যসূত্র
https://canadianimmigrant.ca/education/program-empowers-internationally-trained-medical-doctors
https://discover.research.utoronto.ca/18562-shafi-bhuiyan/about
https://www.newcomernavigation.ca/en/news/featured-member-shafi-bhuiyan.aspx
https://discover.research.utoronto.ca/18562-shafi-bhuiyan/about

Leave a comment