ড. মশিউর রহমান
গবেষণা জীবনে এমন অনেক দিন আসে যখন মনে হয় আমরা এগোচ্ছি, আবার একই সঙ্গে মনে হয় কোথায় যেন আটকে আছি। একটি পরীক্ষায় সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাজ করলেন, ফল এল না। একটি প্রপোজাল লিখলেন, রিভিউতে ফিরল কঠোর মন্তব্য। ল্যাবে নতুন ডেটা পাওয়া গেল, কিন্তু আগেরটির সঙ্গে মেলেনি। বাইরে থেকে দেখলে সবকিছু ঠিকই চলছে—ল্যাবে যাওয়া, নতুন পেপার পড়া, আলোচনা, সেমিনার—কিন্তু ভেতরে কোথাও যেন এক অদৃশ্য স্থবিরতা মনকে পেয়ে বসে।
এই অভিজ্ঞতা শুধু আপনার নয়, পৃথিবীর প্রায় সব গবেষকের। কারণ গবেষণার সাফল্য কখনোই প্রতিযোগিতার মাপকাঠিতে মাপা যায় না। শতকরা হার দিয়ে, বয়স দিয়ে, কিংবা পরিচিত কারও সিভি দেখে নিজের অগ্রগতিকে বিচার করলে গবেষণা শুধু কঠিনই হয় না, নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। এই জায়গাতেই প্রয়োজন আত্ম-প্রতিযোগিতা—নিজের সঙ্গে লড়াই, নিজের সীমানাকে নিজেই প্রসারিত করা, নিজের গতিতে চলা।
আমরা সহজে ভুলে যাই যে প্রতিটি গবেষণার পথ আলাদা। কারো ল্যাব বড়, কারো ফান্ড বেশি, কারো গাইড উপস্থিত, কারো আবার নেই। কেউ চার বছরে পাঁচটা পেপার লিখে ফেলতে পারে, অন্য কেউ একই সময়ে একটি কাজকেও বারবার নতুনভাবে শুরু করতে বাধ্য হয়। কেউ সহজে একটি স্কিল শিখে ফেলে, অন্য কেউ একই স্কিল আয়ত্ত করতে দ্বিগুণ সময় নেয়। এই অসংখ্য ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রায়ই নিজেদের তুলনা করি এমন মানুষের সঙ্গে, যাঁর গবেষণার প্রেক্ষাপটই আমাদের মতো নয়।
একটি ভিডিও হয়তো আপনাকে দেখাল কেউ কোথায় পৌঁছেছে, কী অর্জন করেছে, কত দ্রুত এগিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আপনার মনে হতে পারে, “আমি কি তবে পিছিয়ে পড়ছি?” কিন্তু মনে রাখবেন, ভিডিওতে আমরা শুধু অন্যের ফলাফল দেখি, কখনোই তার প্রক্রিয়া দেখি না। তার হারানো রাত, ব্যর্থ পরীক্ষা, চিন্তার সংকট, ভাঙা মন, নতুন করে শুরু করা—এসব কিছুই অদৃশ্য থাকে। আর অদৃশ্য জিনিসের সঙ্গে নিজের দৃশ্যমান বাস্তবতাকে তুলনা করলে নিজের পথটাই অস্পষ্ট হয়ে যায়।
গবেষণার আসল প্রতিযোগিতা তাই বাইরের নয়, ভেতরের। আপনি কি গতকালের নিজের চেয়ে আজ একটু বেশি শিখলেন? গত সপ্তাহের চেয়ে কি পরীক্ষায় বেশি দক্ষ হলেন? গত মাসের চেয়ে কি বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ শুরু করলেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই আপনার প্রকৃত অগ্রগতির মাপকাঠি। গবেষণায় গতি কখনোই ধ্রুব নয়; কখনো ধীর, কখনো দ্রুত, কখনো বিরতি, কখনো আবার অপ্রত্যাশিত লাফ। কিন্তু এগোতে থাকাটাই আসল।
সমস্যা হলো, আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যেখানে সাফল্যের দৃশ্যমান ছবি তুলে ধরে বারবার দেখানো হয়। সোশ্যাল মিডিয়া কারও পেপার অ্যাকসেপ্টেড হওয়ার খবর দেখায়, কিন্তু ছ’বার রিজেক্ট হওয়ার কথাটি লুকিয়ে রাখে। কারও পিএইচডি সমাপ্তির ছবি আমরা দেখি, কিন্তু পাঁচ বছর ধরে সে ল্যাবে কতবার ব্যর্থ হয়েছে তা দেখি না। সমাজ যখন ফলাফলকে পুরস্কৃত করে কিন্তু প্রক্রিয়াকে নয়, তখন নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা বজায় রাখা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
তবুও গবেষকের শক্তি এখানেই—প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দেওয়া, ধৈর্য ধরে শেখা, আর নিজের গতিকে সম্মান করা। আপনি যেভাবে শিখছেন, তেমনি শিখছেন আপনার ল্যাবমেট; আপনার পদ্ধতি, সমস্যার জায়গা, সুবিধা–অসুবিধা সবই আলাদা। কারও সিভি দেখে নিজের মূল্যায়ন করা মানে হলো অন্য কারও মানচিত্র দিয়ে নিজের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা—যা কখনোই সঠিক গন্তব্যে পৌঁছায় না।
গবেষণার পথ একটি দীর্ঘ ম্যারাথন, স্প্রিন্ট নয়। এখানে কখনো কখনো ধীর হওয়া স্বাভাবিক। কিছু সময় অগ্রগতি কম মনে হবে, কিন্তু তাও এগিয়ে যাওয়া জরুরি। আপনার প্রতিটি ছোট সাফল্য, প্রতিটি শেখা, প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে উঠে দাঁড়ানোর মুহূর্ত—সবই যোগ হয়ে আপনার গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করলে মন পরিষ্কার থাকে, কাজের উদ্দেশ্য পরিষ্কার থাকে, আর নিজের সামর্থ্যের প্রতি আস্থা বাড়ে।
সবশেষে, জীবনে যখন মনে হবে “অন্যরা এগিয়ে যাচ্ছে, আমি কেন না”—ঠিক তখন মনে করুন, প্রতিযোগী কেউ নয়, প্রতিযোগী আপনি নিজে। গতকালের আপনি। আপনার পরিবর্তন, আপনার শেখা, আপনার ধৈর্য—এসবই আপনাকে এক সময় সেই জায়গায় পৌঁছে দেবে, যাকে আপনি আজ দূরের স্বপ্ন ভেবে দেখছেন।
নিজের সাথে এই নীরব, ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতাই গবেষকের সবচেয়ে বড় শক্তি। কারণ যারা নিজের পথে হাঁটতে জানে, নিজের মতো এগোয়, নিজের সীমানা নিজেই প্রসারিত করে—তারাই একসময় নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে, সভ্যতাকে এগিয়ে নেয়।
অন্যদের নয়, নিজের গতির প্রতি আনুগত্য রাখুন। প্রতিযোগিতা হোক নিজের সঙ্গে।

Leave a comment