ড. মশিউর রহমান
একজন স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী যখন কোনো বিজ্ঞানীর নাম শুনে, তখন নামের সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে ভেসে ওঠে একটি দূরের জগৎ—ল্যাবরেটরি, সাদা কোট, অচেনা যন্ত্র আর কঠিন ভাষার মানুষ। এই দূরত্বের কারণেই বহু কিশোর মনে করে, বিজ্ঞানী হওয়া বুঝি অন্য গ্রহের মানুষের কাজ। অথচ বাস্তবতা হলো—একজন বিজ্ঞানীর জীবনের গল্প, সংগ্রাম, ভুল আর সাফল্য যদি তাদের নিজের ভাষায় পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে সেই দূরত্ব মুহূর্তেই ভেঙে যায়। ঠিক এখানেই বিজ্ঞানীদের কাছে আমাদের অনুরোধ—আপনারা লিখুন, বলুন, কথা বলুন সাধারণ মানুষের ভাষায়। আপনার কণ্ঠই পারে ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের জাগিয়ে তুলতে।
একজন বিজ্ঞানী যখন জনপ্রিয় বিজ্ঞান নিয়ে লেখেন, তখন সেই লেখা আর সাধারণ লেখা থাকে না। সেটি হয়ে ওঠে অভিজ্ঞতার ভাষ্য, বাস্তবতার দলিল। একজন তরুণ পাঠক যখন পড়ে—কোনো বিজ্ঞানী নিজেও একদিন গণিতে কাঁচা ছিলেন, বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরটা ভীষণ কঠিন ছিল—তখন তার মনে প্রথমবারের মতো জন্ম নেয় এক অদ্ভুত সাহস, আমিও পারব। বিজ্ঞানীর লেখা তখন আর বইয়ের পাতা থাকে না, হয়ে ওঠে এক বন্ধু, যে বলে—ভয় নেই, আমি ছিলাম তোমার জায়গায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানীদের কলম আরও বেশি প্রয়োজন। এখানে অসংখ্য মেধাবী ছাত্র আছে, কিন্তু রোল মডেলের অভাব আছে। বিজ্ঞানীদের গল্প যদি পৌঁছায় তাদের হাতের মোবাইলে, স্কুলের দেয়ালপত্রিকায় বা অনলাইন ম্যাগাজিনে, তবে বিজ্ঞান আর পরীক্ষার খাতায় আটকে থাকবে না। বিজ্ঞান হয়ে উঠবে জীবিত একটি স্বপ্ন। একটি লেখা, একটি ছোট গল্প, একটি অভিজ্ঞতা—এই সামান্য জিনিসগুলোই কাজে লাগতে পারে ভবিষ্যতের বড় আবিষ্কারের বীজ বপনে।
একজন বিজ্ঞানীর অনুপ্রেরণার শক্তি আলাদা, কারণ তিনি কেবল তত্ত্ব বলেন না, তিনি প্রমাণ। তাঁর কথা বিশ্বাসযোগ্য, কারণ তাঁর পেছনে আছে গবেষণাগারের রাত জাগা সময়, ব্যর্থ পরীক্ষার হতাশা, আর হঠাৎ পাওয়া সাফল্যের আনন্দ। যখন তিনি বলেন, “আমি ভয় পেয়েছিলাম, তবু চেষ্টা ছাড়িনি”—তখন সেটি মোটিভেশনাল স্পিচ থাকে না, সেটি হয়ে ওঠে জীবনের সত্য। আর জীবনের সত্যই শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়।
জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখা মানে গবেষণাপত্রকে সহজ করে ছাপা নয়, এটি মানে মানুষকে বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্ক করানো। একজন বিজ্ঞানী যখন নিজের আবিষ্কার বা গবেষণাকে গল্পের মতো করে বলেন, তখন পাঠক বুঝতে শেখে—বিজ্ঞান কোনো ঠান্ডা মেশিন নয়, এটি হৃদয় ও মস্তিষ্কের যৌথ প্রয়াস। বিজ্ঞান তখন কেবল ক্লাসের বিষয় থাকে না, সে হয়ে ওঠে জীবনের অংশ।
একটি দেশের ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানীরা বই থেকে নয়, মানুষকে দেখে তৈরি হয়। যদি তারা দেখতে পায়—বিজ্ঞানীরা সাধারণ মানুষ, যাদেরও ভয় আছে, স্বপ্ন আছে, পরিবার আছে—তাহলে তারা বিজ্ঞানকে নিজের মতো করে ভাবতে শুরু করবে। এই ভাবনাই একজন শিশুর মনে জন্ম নেয়, একদিন সে নিজেই হয়তো কলম তুলে নেবে, নিজের মতো করে বিজ্ঞানকে বলবে।
এই কারণেই বিজ্ঞানীদের প্রতি বিশেষ আহ্বান—আপনারা শুধু গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ থাকবেন না। লিখুন আমাদের জন্য। বলুন, আপনার পথচলার গল্প। বলুন, কীভাবে আপনি ব্যর্থতা থেকে শিখেছেন। বলুন, কীভাবে ছোট একটি প্রশ্ন আপনাকে নিয়ে গেছে বড় আবিষ্কারের দিকে। আপনার একটি লেখা হয়তো আজ একটি কিশোর পড়বে, আগামীকাল সে বানাবে নতুন কোনো যন্ত্র, যা পৃথিবী বদলে দেবে।
আজকের দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ব্লগ, অনলাইন ম্যাগাজিন—এই সবই বিজ্ঞানীদের মাইক্রোফোন। এই মাইক্রোফোন ব্যবহার করে যদি বিজ্ঞানীরা মানুষের কাছে পৌঁছান, তবে বিজ্ঞানের চেহারাই পাল্টে যাবে। বিজ্ঞান আর ভয়ংকর বিষয় থাকবে না, হবে চেনা জগত। একজন মা তাঁর সন্তানকে বলবেন—দেখো, এই মানুষটিও বিজ্ঞানী, তুমিও হতে পারো।
সবচেয়ে বড় কথা, বিজ্ঞানী লিখলে বিজ্ঞান বাঁচে। কারণ বিজ্ঞান কেবল গবেষণায় নয়, মানুষের কৌতূহলে টিকে থাকে। সেই কৌতূহল জাগাতে হলে গল্প চাই, সম্পর্ক চাই, মানুষ চাই। বিজ্ঞানীরা যদি সেই মানুষ হয়ে ওঠেন, তবে একটি প্রজন্ম নয়, অনেক প্রজন্ম আলোকিত হবে।
তাই এই লেখা শুধুই অনুরোধ নয়, এটি আবেদন, এটি ডাক। বিজ্ঞানীদের ডাক—আপনার জ্ঞান শুধু জার্নালে বন্দি রাখবেন না, মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিন। আপনার কলমেই আছে ভবিষ্যৎ। আপনার শব্দেই জন্ম নিতে পারে পরবর্তী নোবেল, পরবর্তী মেরি কুরি, পরবর্তী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। আজ আপনি যদি লিখতে শুরু করেন, কাল কেউ একজন এই লেখা পড়েই স্বপ্ন দেখবে। আর স্বপ্ন থেকেই তো বিজ্ঞান শুরু হয়।

Leave a comment