১৯১২ সালের এক গ্রীষ্মকালীন সন্ধ্যায় লন্ডনের এক প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক সভায় সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলেন। বিজ্ঞানী চার্লস ডসন ঘোষণা করলেন, তিনি এক অভূতপূর্ব আবিষ্কার করেছেন—একটি মানব খুলির অংশ, যা আধুনিক মানুষের বিবর্তনের একটি নিখুঁত সংযোগসেতু! সভার সদস্যরা হতবাক হয়ে পড়লেন, কারণ এটি ছিল “পিল্টডাউন ম্যান”—যা বৈজ্ঞানিক মহলে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসেবে বিবেচিত হলো।
কিন্তু কয়েক দশক পর, ১৯৫৩ সালে, আধুনিক রেডিওকার্বন ডেটিং পরীক্ষা করে দেখা গেল, এই তথাকথিত “আদিম মানুষটি” ছিল আসলে এক সুপরিকল্পিত প্রতারণা। খুলিটি ছিল এক মধ্যযুগীয় মানুষের এবং জয়ের মতো চোয়ালের অংশ ছিল একটি ওরাংওটাং-এর!
একটি প্রশ্ন: বিজ্ঞান কি সবসময় সত্যের পথে?
একজন গবেষক হিসেবে বিজ্ঞানীর মূল দায়িত্ব হলো সত্যের অনুসন্ধান করা। কিন্তু কখনও কখনও, ব্যক্তিগত খ্যাতি, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বা অর্থনৈতিক সুবিধার কারণে কিছু বিজ্ঞানী অসততার পথে পা বাড়ান।
যুক্তরাষ্ট্রের এক নামকরা পদার্থবিদ রবার্ট মিলিকানের উদাহরণ নেওয়া যাক। তিনি ১৯১০-এর দশকে তেলের ফোঁটার পরীক্ষার মাধ্যমে ইলেকট্রনের চার্জ পরিমাপ করেছিলেন। যদিও তার গবেষণা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছে, পরে জানা যায়, তিনি তার ডেটা থেকে কিছু “অস্বস্তিকর” ফলাফল বাদ দিয়েছিলেন, যাতে তার উপসংহার সুসংগত দেখায়। বিজ্ঞানী রিচার্ড ফেইনম্যান এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন,
“আপনি যদি নিজের সঙ্গে সৎ না হন, তবে আপনি বিজ্ঞান করছেন না, আপনি শুধু নিজেকে প্রতারিত করছেন।”
বৈজ্ঞানিক জালিয়াতির আরও কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনা
হুইয়াং উ সুকের স্টেম সেল প্রতারণা (২০০৪)
দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানী হুইয়াং উ সুক একসময় স্টেম সেল গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্বনেতা হিসেবে বিবেচিত হতেন। তিনি দাবি করেছিলেন, তিনি মানব ক্লোনিং এবং কৃত্রিম স্টেম সেল তৈরি করেছেন। কিন্তু ২০০৬ সালে তদন্তে বেরিয়ে আসে, তার গবেষণার বেশিরভাগ তথ্যই মিথ্যা ছিল। তিনি মূলত ডেটা জালিয়াতি করেছিলেন, যা বিজ্ঞান মহলে বিরাট আলোড়ন তোলে।
জন ডারসি ও তার ঠকবাজি (১৯৮০-এর দশক)
জন ডারসি নামের এক চিকিৎসা গবেষক হৃদরোগ চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, তার বেশিরভাগ গবেষণার ফলাফল ছিল বানানো এবং অনুমাননির্ভর। তার এই প্রতারণার ফলে বহু রোগী ভুল চিকিৎসা পেয়েছিলেন।
জনাথন পিলার এবং বায়োমেডিক্যাল প্রতারণা (২০১০)
যুক্তরাজ্যের গবেষক জনাথন পিলার ক্যান্সার গবেষণায় এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের দাবি করেছিলেন। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই প্রকাশিত হয় যে তার গবেষণার বড় একটি অংশ ছিল সাজানো। এর ফলে তার একাধিক গবেষণা পত্র প্রত্যাহার করা হয় এবং বিজ্ঞান জগতে এটি একটি বড় আঘাত হানে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জালিয়াতির উদাহরণ
বাংলাদেশেও বিজ্ঞান গবেষণায় প্রতারণার নজির দেখা যায়। কিছু গবেষক বিদেশি গবেষণাপত্র অনুবাদ করে নিজেদের নামে প্রকাশ করেছেন। ২০১৮ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নালে নিবন্ধ প্রকাশের পর অভিযোগ ওঠে যে সেটি অন্য গবেষণার সরাসরি অনুলিপি। পরবর্তীতে তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিললে সংশ্লিষ্ট গবেষণাটি বাতিল করা হয় (সূত্র: The Daily Star, ২০১৮, “Plagiarism scandal at DU: Research paper retracted”).
বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া ও পাঠকের মন্তব্য
বিজ্ঞানী ও দার্শনিক কার্ল সাগান একবার বলেছিলেন,
“অসাধারণ দাবি অসাধারণ প্রমাণ দাবি করে।”
এটি বিজ্ঞান জগতের সবচেয়ে বড় সত্যগুলোর একটি।
বিজ্ঞান কেলেঙ্কারির ইতিহাস জানার পর, ঢাকার এক শিক্ষার্থী, রাফি ইসলাম বললেন,
“আমি মনে করতাম, বিজ্ঞানীরা সবসময় সত্যবাদী হন। কিন্তু এই প্রতিবেদন পড়ে বুঝলাম, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকেও যাচাই করতে হয়।”
অন্যদিকে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মার্টিন হ্যানসন বলেন,
“বিজ্ঞান স্বভাবতই স্ব-সংশোধনশীল। সময়ের সাথে সাথে ভুলগুলো প্রকাশিত হয়, এবং সেটাই বিজ্ঞানকে উন্নত করে।”
উপসংহার: বিজ্ঞান কি তাহলে প্রশ্নবিদ্ধ?
বিজ্ঞান কখনোই সম্পূর্ণ নিখুঁত নয়, কিন্তু তার শক্তি এখানেই যে, এটি ভুল স্বীকার করতে জানে এবং নিজেকে সংশোধন করতে পারে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ফেইনম্যান বলেছিলেন,
“বিজ্ঞান সত্যের অনুসন্ধান, এটি কখনোই সম্পূর্ণ নয়, তবে প্রতিনিয়ত উন্নতির পথে।”
যতই জালিয়াতি আর প্রতারণার ঘটনা সামনে আসুক, সত্যের আলো একদিন ঠিকই উদ্ভাসিত হয়। কারণ বিজ্ঞান, শেষ পর্যন্ত, সত্যেরই অনুসন্ধান।
সূত্র
- The Daily Star, ২০১৮, “Plagiarism scandal at DU: Research paper retracted”
- Broad, William J. “Betrayers of the Truth: Fraud and Deceit in the Halls of Science.” Simon & Schuster, 1982.
- Nature, ২০০৬, “Stem-cell fraud investigation: How Hwang Woo-suk fooled the world”
- The Guardian, ২০১০, “Fake cancer research scandal: Jonathan Piller’s case exposed”
Leave a comment