প্রফেসর ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা শিক্ষা এবং মেন্টরিং সিস্টেমের অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী এবং ফেলোদের মধ্যে গবেষণার প্রতি আগ্রহ কম, কারণ তারা গবেষণার ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন নয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার প্রশিক্ষণ বা উৎসাহিত করার কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেই। এর ফলে, তারা গবেষণার পরিবর্তে চাকরির প্রস্তুতির দিকে ঝুঁকে পড়ে, বিশেষত বিসিএস পরীক্ষার মতো সরকারি চাকরির দিকে। এমনকি একাডেমিক শিক্ষার প্রতি তাদের আন্তরিকতা কমে যায়, কারণ অনেকেই মনে করে, চাকরির প্রস্তুতির সঙ্গে একাডেমিক পড়াশোনার তেমন কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই।
অন্যদিকে, কিছু ছাত্র-ছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার দিকে মনোযোগ দেয় এবং স্কলারশিপের জন্য প্রস্তুতি নেয়। তারা IELTS পরীক্ষায় ভালো স্কোর করলেও, তাদের গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকেনা বলে তারা গবেষণায় অগ্রসর হতে পারে না। গবেষণার অভিজ্ঞতা ছাড়া তাদের স্কলারশিপ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, কারণ উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার প্রতি অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং সেখানকার স্কলারশিপ গুলো গবেষণার ভিত্তিতে প্রদান করা হয়।
ফলস্বরূপ, অনেকেই স্কলারশিপের অভাবে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিশাল অংকের টাকা দিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যান। কিন্তু গবেষণার অভিজ্ঞতা না থাকায় সেসব দেশগুলোতে এমএস বা পিএইচডি প্রোগ্রামে সঠিকভাবে কোর্সের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন না, কিংবা টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট (TA) বা রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট (RA) হিসেবে যোগ্যতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন। এর ফলে, অনেকের স্কলারশিপ বাতিল হয়ে যায় অথবা তারা ডিগ্রি অর্জন করতে ব্যর্থ হন এবং দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
এই সমস্যার সমাধানে গবেষণা শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের গবেষণায় উৎসাহিত করার জন্য একটি কার্যকরী মেন্টরিং সিস্টেম প্রয়োজন। এতে মেন্টররা তাদের গবেষণার প্রতি আকৃষ্ট করবে এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা শিখাবে। গবেষণার অভিজ্ঞতা ছাড়া ভাল পাবলিকেশন সম্ভব নয় এবং পাবলিকেশন ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণা ক্ষেত্রে মান অর্জন কঠিন।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি সঠিকভাবে গবেষণায় উৎসাহ দেওয়া হয় এবং প্রজেক্টের কাজে ইনভলভ করা হয়, তবে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে গবেষণার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। এটি তাদের কেবলমাত্র স্কলারশিপ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়াবে না, বরং তারা আন্তর্জাতিক মানের গবেষণার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে। এতে উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিএ বা আরএ হিসেবে কাজ করার যোগ্যতা অর্জন সম্ভব হবে এবং সঠিকভাবে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে।
সার্বিকভাবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার মান উন্নয়ন এবং ফেলোদের গবেষণার কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের অনাগ্রহ এবং শিক্ষকদের মেন্টরিং সিস্টেমের অভাব একটি বৃহৎ সমস্যা আগেই উল্লেখ করেছি। এই সমস্যার সমাধানে ফেলো, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তাদের প্রতিটি স্তরে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া গেলে গবেষণা শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব হবে।
নিচে এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রত্যেকের করণীয় বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
১. ফেলোদের করণীয়:
গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের প্রথমেই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ফেলোদের বুঝতে হবে, শুধু চাকরির প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত থাকার বদলে গবেষণা এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি মনোনিবেশ করলে তাদের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হতে পারে। ফেলোদের করণীয় বিষয়গুলো হলো:
⊕ গবেষণার গুরুত্ব উপলব্ধি করা:
ফেলোদের গবেষণার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান এবং উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ ঘটানো সম্ভব। শুধু চাকরি নয়, গবেষণার অভিজ্ঞতা অর্জন করাও পেশাগত জীবনে অনেক সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
⊕ স্কলারশিপ ও গবেষণা প্রকল্পে অংশগ্রহণ:
ফেলোদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্প বা প্রোগ্রামে যুক্ত হতে হবে। বিশেষ করে গবেষণায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে।
⊕ গবেষণা প্রশিক্ষণ ও কনফারেন্সে অংশগ্রহণ:
গবেষণার মূলনীতি, পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য বিভিন্ন কর্মশালা ও সেমিনারে অংশ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে গবেষণাপত্র উপস্থাপনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গবেষণার মান বুঝতে পারা সম্ভব।
২. শিক্ষকদের করণীয়:
শিক্ষকদের দায়িত্ব হলো, শিক্ষার্থীদের গবেষণার প্রতি উৎসাহিত করা এবং তাদের মেন্টর হিসেবে পাশে থাকা। শিক্ষকদের করণীয় বিষয়গুলো হলো:
⊕ মেন্টরিং ও দিকনির্দেশনা:
শিক্ষকদের নিয়মিতভাবে গবেষণা সংক্রান্ত মেন্টরিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে একটি নির্দিষ্ট গবেষণায় যুক্ত করা এবং তাদের কাজের উপর পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
⊕ গবেষণা প্রকল্পের আয়োজন:
শিক্ষকরা নিজেদের গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের গবেষণা কাজে যুক্ত করার জন্য প্রকল্প চালু করতে পারেন। এ ধরনের প্রকল্পগুলো শিক্ষার্থীদের গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান দেবে।
⊕ গবেষণাপত্র প্রকাশে সাহায্য করা:
শিক্ষার্থীদের গবেষণাপত্র লিখতে ও প্রকাশ করতে সাহায্য করা উচিত। শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক গবেষণার অভিজ্ঞতা দিতে আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশের সুযোগ করে দিতে হবে।
৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের করণীয়:
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব হলো গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা, প্রয়োজনীয় সম্পদ ও নীতিমালা প্রদান করা। প্রশাসনের করণীয় বিষয়গুলো হলো:
⊕ গবেষণা কেন্দ্র ও ল্যাব স্থাপন:
প্রশাসনকে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক গবেষণা ল্যাব এবং কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। এই ল্যাবগুলো শিক্ষার্থীদের গবেষণার প্রয়োজনীয় সুবিধা প্রদান করবে।
⊕ গবেষণার জন্য তহবিল প্রদান:
গবেষণা প্রকল্পগুলোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসনকে বিদেশি সংস্থা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নিতে হবে।
⊕ শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা:
শিক্ষকদের গবেষণায় দক্ষ করে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও আন্তর্জাতিক গবেষণা আদান-প্রদান প্রোগ্রাম চালু করতে হবে।
৪. দেশের করণীয়:
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গবেষণার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন ও সহায়তা প্রদান করা জরুরি। রাষ্ট্রের করণীয় বিষয়গুলো হলো:
⊕ গবেষণা তহবিল বৃদ্ধি:
সরকারকে জাতীয় পর্যায়ে গবেষণার জন্য তহবিল বৃদ্ধি করতে হবে। একাডেমিক গবেষণা ও উদ্ভাবনী প্রোগ্রামগুলোকে তহবিলের আওতায় নিয়ে আসা উচিত।
⊕ গবেষণা পুরস্কার ও অনুদান:
গবেষণা ক্ষেত্রে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের জন্য পুরস্কার ও আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে, যা গবেষণার প্রতি উৎসাহ বৃদ্ধি করবে।
⊕ গবেষণা নীতিমালা প্রণয়ন:
সরকারের উচিত গবেষণার উন্নয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা। এই নীতিমালা গবেষণা কার্যক্রমের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করবে।
⊕ বৃত্তি প্রদান:
সরকার আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করতে পারে। এটি দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের গবেষণা ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সুযোগ তৈরি করবে।
সমাপনী বিবেচনা:
গবেষণা একটি দেশের উন্নতির মুল চাবিকাঠি। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় গবেষণার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করা জরুরি। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ফেলো, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, এবং সরকারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। গবেষণায় বিনিয়োগ এবং মেন্টরিং সিস্টেমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ানো সম্ভব। ফলে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক মানের গবেষক তৈরি হবে এবং দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।
বিদ্র: ফেসবুক থেকে সংগ্রহীত:——–
Leave a comment