লেখক: প্রফেসর ড মোহাঃ ইয়ামিন হোসেন
ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
মোঃ ইয়ামিন হোসেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক, যিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি সুপারভাইজার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। তাঁর গবেষণা মূলত জ্বালানি ও শক্তির টেকসই সমাধান এবং তেল-গ্যাস খাতে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ওপর কেন্দ্রিত। তিনি শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন গবেষণা ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবদান রাখতে উদ্বুদ্ধ করেন। বিস্তারিত জানতে পড়ুন:
পিএইচডি ডিগ্রির সংখ্যা দিয়ে সুপারভাইজারের সাফল্য মাপা হয় কিন্তু আসলেই কি এটা ঠিক?
পিএইচডি সুপারভাইজারদের মধ্যে অনেকেই গর্ব করে বলে থাকেন যে তারা ১০ বা ২০টি পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যাগত গর্ব তখনই অর্থবহ হয়, যখন সেই ডিগ্রিধারী গবেষকরা গুণগত মানে উচ্চমানের অর্জন করতে পারেন। শুধু সংখ্যার উপর ভিত্তি করে একজন সুপারভাইজারের সাফল্য পরিমাপ করা মানে হবে পিএইচডি ডিগ্রির মূল লক্ষ্য এবং গবেষণার মানকে অবমূল্যায়ন করা।নিচে কিছু যুক্তি উল্লেখ করা হলো কেন শুধু পিএইচডি ডিগ্রির সংখ্যা দিয়ে সুপারভাইজারের সাফল্য মাপা উচিত নয়:
গুণগত মানই আসল সাফল্য:
⊕ একজন পিএইচডি গবেষকের মূল লক্ষ্য হলো নতুন জ্ঞান সৃষ্টি এবং তা প্রাসঙ্গিকভাবে প্রয়োগ করা। গবেষণার গুণগত মান, প্রাসঙ্গিকতা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি—এসবই একজন ভালো গবেষকের মাপকাঠি।
⊕ যদি ডিগ্রি অর্জনকারী গবেষকগণ গবেষণায় কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে না পারেন, তা হলে সুপারভাইজারের অনেক পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের কোনো বাস্তব মূল্য থাকে না।
গবেষণার ফলাফল এবং প্রভাব (Research Outcomes and Impact):
⊕ পিএইচডি প্রক্রিয়াটি শুধুমাত্র একটি শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া নয়, এটি এমন একটি ধাপ যেখানে গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান তৈরি হয়। তাই যদি সুপারভাইজারের অধীনে ডিগ্রি সম্পন্ন করা ফেলোরা কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা প্রকাশ বা উদ্ভাবন করতে না পারেন, তবে শুধুমাত্র সংখ্যা দিয়ে সাফল্য প্রমাণ করা যায় না।
⊕ গবেষণার ফলাফল হিসেবে আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনা, সাইটেশন, পেটেন্ট, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বা প্রাসঙ্গিক সমাজে গবেষণার প্রভাব থাকলে তবেই সেই ডিগ্রি ও সুপারভাইজার মূল্যবান প্রমাণিত হয়।
গবেষণার মান প্রমাণের অভাব:
⊕ যদি গবেষকরা নিজেদের দক্ষতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হন, যেমন উচ্চমানের জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশ করা বা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকল্পে অংশগ্রহণ করা, তাহলে তাদের পিএইচডি ডিগ্রি শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
⊕ একটি পিএইচডি ডিগ্রি শুধু প্রথাগত শিক্ষা নয়; এটি দক্ষতা, নতুন চিন্তা এবং প্রভাবশালী গবেষণার সাথে সম্পর্কিত। এই অর্জনগুলো ছাড়া ডিগ্রি প্রদান করার সংখ্যাগুলোর কোনো স্থায়ী মূল্য থাকে না।
শিক্ষার প্রভাব এবং নেটওয়ার্কের মান:
⊕ সুপারভাইজার হিসেবে একজন গবেষককে তার শিক্ষার্থীদের জন্য একটি গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার পরিবেশ এবং সঠিক নেটওয়ার্ক প্রদান করতে হয়, যাতে তারা বিশ্বব্যাপী গবেষণায় অবদান রাখতে পারেন।
⊕ যদি একজন পিএইচডি সুপারভাইজারের অধীনে গবেষকরা মানসম্পন্ন নেটওয়ার্ক গঠন করতে না পারেন বা উচ্চমানের গবেষণা সংস্থাগুলিতে কাজ করার সুযোগ না পান, তবে ডিগ্রির সংখ্যার ভিত্তিতে সুপারভাইজারের গর্ব করা অবাস্তব।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব:
⊕ একটি সফল পিএইচডি প্রোগ্রামের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকে গবেষকের ভবিষ্যত কর্মজীবন এবং সমাজে অবদানের ওপর। যদি সুপারভাইজারের অধীনে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ডিগ্রি অর্জন করেই থেমে যায় এবং কর্মজীবনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে ব্যর্থ হয়, তবে সেই ডিগ্রিগুলোর পরিমাণ কোনো স্থায়ী সাফল্য নির্দেশ করে না।
গবেষণার নেতৃত্ব প্রদান:
⊕ ভালো গবেষণা কেবলমাত্র পরিমাণ দিয়ে নয়, বরং নেতৃত্ব দিয়ে নির্ধারিত হয়। একজন দক্ষ সুপারভাইজার তার শিক্ষার্থীদের গবেষণার পথে নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করেন এবং তাদের নতুন গবেষণার ক্ষেত্রে উচ্চতর স্থানে পৌঁছাতে অনুপ্রাণিত করেন।
⊕ যদি সুপারভাইজারের অধীনে থাকা শিক্ষার্থীরা গবেষণায় নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সুপারভাইজারের দাবি করা সাফল্য শুধুমাত্র সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল থাকে, যা খুবই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি।
সুতরাং, পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের সাফল্য এবং দক্ষতা তাদের অর্জিত গবেষণার গুণগত মান, প্রাসঙ্গিকতা এবং সমাজে প্রভাবের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা উচিত। শুধুমাত্র ডিগ্রি প্রদানের সংখ্যা দিয়ে সুপারভাইজার বা শিক্ষার্থীর প্রকৃত সাফল্য এবং গবেষণার মান পরিমাপ করা সম্ভব নয়।
ভালো পিএইচডি ডিগ্রির মান এবং একজন গবেষকের দক্ষতা প্রমাণ নিম্নলিখিত বিষয়গুলি সহায়ক:
একজন গবেষক বা রিসার্চার হিসেবে প্রমাণ করতে যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত পিএইচডি ডিগ্রি গুণগত মানে ভালো এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দক্ষ হয়েছেন, তার জন্য বিভিন্ন বিষয় ও মানদণ্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। নিচে উল্লেখিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যা একটি ভালো পিএইচডি ডিগ্রির মান এবং একজন গবেষকের দক্ষতা প্রমাণ করতে সহায়ক:
প্রকাশনা (Publications):
⊕ পিএইচডি করার সময় এবং পরবর্তীতে গবেষণার ফলাফল হিসেবে আন্তর্জাতিক মানের পিয়ার-রিভিউড (peer-reviewed) জার্নালে প্রকাশনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
⊕ গবেষণার গভীরতা ও প্রাসঙ্গিকতা নির্ভর করে কোথায় প্রকাশিত হচ্ছে, অর্থাৎ ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর (impact factor) যুক্ত জার্নালগুলোতে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা।
⊕ গবেষণাপত্রের সাইটেশন (citation count) তথা অন্য গবেষকরা আপনার কাজকে কতবার উল্লেখ করছেন, তা গুণগত মানের সূচক।
গবেষণার প্রভাব (Research Impact):
⊕ গবেষণার ফলাফল কীভাবে বাস্তব দুনিয়ায় প্রভাব ফেলছে, বিশেষত তা যদি নতুন প্রযুক্তি, প্রক্রিয়া বা পলিসি নির্ধারণে ভূমিকা রাখে, তবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
⊕ পেটেন্ট, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, বা ব্যবসায়িক প্রয়োগ আপনার গবেষণার ব্যবহারিক মূল্য প্রমাণ করতে পারে।
ফান্ডিং এবং ফেলোশিপ (Funding and Fellowships):
⊕ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান থেকে গবেষণার জন্য ফান্ডিং পাওয়া, যেমন ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন (NSF), ইউরোপিয়ান রিসার্চ কাউন্সিল (ERC) ইত্যাদি।
⊕ প্রেস্টিজিয়াস ফেলোশিপ বা স্কলারশিপ পাওয়া, যেমন ফুলব্রাইট, মারি কুরি স্কলারশিপ ইত্যাদি।
অধ্যাপনা ও সুপারভিশন (Teaching and Supervision):
⊕ পিএইচডি পরবর্তী সময়ে একজন দক্ষ গবেষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করা এবং নতুন পিএইচডি ছাত্রদের সুপারভাইজ করা।
⊕ আপনার তত্ত্বাবধানে সফল পিএইচডি ছাত্রদের গবেষণা সম্পন্ন করা মানে গবেষণা ও তত্ত্বাবধানে দক্ষতা প্রমাণ করা।
কনফারেন্সে অংশগ্রহণ এবং উপস্থাপনা (Conference Participation and Presentation):
⊕ আন্তর্জাতিক গবেষণা কনফারেন্সে অংশগ্রহণ এবং গবেষণার উপস্থাপনা করা, যা আপনার কাজকে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি দেয়।
⊕ বিভিন্ন কনফারেন্সে কীনোট স্পিকার (keynote speaker) হিসেবে আমন্ত্রণ পাওয়া একজন প্রতিষ্ঠিত গবেষকের স্বীকৃতি।
গবেষণার সহযোগিতা (Collaborations):
⊕ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বা জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গবেষণায় সহযোগিতা করা এবং যুগ্মভাবে গবেষণাপত্র প্রকাশ করা। এটি গবেষণার গুণগত মান এবং বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে সহায়ক।
পুরস্কার এবং স্বীকৃতি (Awards and Recognition):
⊕ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা পুরস্কার পাওয়া। যেমন নোবেল পুরস্কার, ম্যাকার্থার ফেলোশিপ বা গবেষণা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি।
⊕ আপনার গবেষণা যদি কোনও গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সমস্যা সমাধানে সহায়ক হয়, তবে এটি পরবর্তী পর্যায়ে পুরস্কার ও সম্মান লাভে সহায়ক হতে পারে।
পেশাদারী নেটওয়ার্কিং এবং এসোসিয়েশন মেম্বারশিপ (Professional Networking and Association Membership):
⊕ বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত বা অন্যান্য প্রফেশনাল সোসাইটির সদস্য বা লিডারশিপ পজিশনে থাকা, যেমন IEEE, ACM, APS ইত্যাদি।
⊕ এসব সংগঠনের মাধ্যমে গবেষণার প্রভাব এবং আপনার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
এই উপাদানগুলো যদি একজন পিএইচডি গবেষকের জীবনে উপস্থিত থাকে, তাহলে তা তার পিএইচডি ডিগ্রির গুণগত মান এবং গবেষণা দক্ষতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করে।
ড. মোঃ ইয়ামিন হোসেন আপনাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। আপনার নিরলস প্রচেষ্টা ও গবেষণায় অবদান আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। আপনার তত্ত্বাবধানে গুণগত মানের গবেষণা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ভবিষ্যতেও আপনার সাফল্যের ধারা অব্যাহত থাকুক এবং নতুন উচ্চতায় পৌঁছান—এই শুভকামনা জানাই।
Leave a comment