ড. মশিউর রহমান
একটি সমৃদ্ধ, আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদের সকলের। আকাশচুম্বী অট্টালিকা কিংবা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঝলক নিঃসন্দেহে উন্নতির প্রতীক, কিন্তু সত্যিকারের অগ্রগতি নির্ভর করে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার ক্ষমতার ওপর। যে জাতি কেবল অন্যের প্রযুক্তি ভোগে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে নিজস্ব সমাধান উদ্ভাবন করে, কেবল তারাই পৃথিবীর বুকে স্থায়ী মর্যাদা অর্জন করতে পারে। এই জ্ঞান সৃষ্টির মূলভিত্তি গবেষণা—একটি দীর্ঘ, ধৈর্যসাধ্য এবং কঠিন যাত্রা। সেই যাত্রাপথে তরুণ প্রজন্মকে স্বাগত জানাতে এবং পথচলা সহজ করতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম ‘বিজ্ঞানী.অর্গ’ নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তুলছে।
বছরের পর বছর ধরে ‘বিজ্ঞানী.অর্গ’ নবীন গবেষক ও তরুণ বিজ্ঞানীদের জন্য এক অনুপ্রেরণার ঠিকানা হয়ে উঠেছে। পাঠকেরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, আমরা নিয়মিতভাবে গবেষণার জন্য অবশ্যপাঠ্য বইয়ের তালিকা, গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সহজ নির্দেশনা এবং মৌলিক গবেষণার বিষয়গুলোকে সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি আমরা অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করি, যা তরুণদের কৌতূহল জাগায় এবং তাদের সামনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। কিন্তু অনুপ্রেরণা কখনো একা যথেষ্ট নয়—প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের গবেষণার ক্ষেত্র যত বিস্তৃত হচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে বাংলা ভাষায় নবীন গবেষকদের জন্য উপযোগী রিসোর্সের অভাব। হাতে গোনা কিছু বই থাকলেও ভাষার জটিলতা এবং অতি তাত্ত্বিক উপস্থাপনা অনেককে শুরুতেই নিরুৎসাহিত করে। এই শূন্যতা পূরণে দায়বদ্ধতাই আমাদের কার্যক্রমে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
আজকের পৃথিবী তথ্যের অফুরন্ত সমুদ্র। ইন্টারনেট আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে যেকোনো তথ্য পাওয়া যেন মুহূর্তের ব্যাপার। কিন্তু এই তথ্যের পাহাড় অনেক সময় নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য আশীর্বাদ নয়, বরং বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সঠিক ও প্রাসঙ্গিক তথ্য বাছাই করা, আর গবেষণার প্রথম ধাপগুলো আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পেরোনো, অনেকের কাছেই চ্যালেঞ্জ। এখানেই দরকার একজন নির্ভরযোগ্য পথপ্রদর্শকের। আমরা সেই পথপ্রদর্শকের দায়িত্ব নিতে চাই। ছড়ানো-ছিটানো তথ্যকে কাঠামোবদ্ধ করে, প্রমিত ও সহজবোধ্য বাংলায় নবীন গবেষকদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রয়াসেই আমাদের নতুন সংযোজন—‘গবেষণায় হাতেখড়ি’। এখানে একজন নবীন গবেষক নিজের প্রয়োজনীয় সব রসদ এক জায়গায় খুঁজে পাবেন, কোনো দ্বিধা ছাড়াই গবেষণার প্রথম ধাপগুলো পেরোনোর সাহস সঞ্চয় করবেন।
তবে এই পথ মোটেও মসৃণ নয়। এর পেছনে রয়েছে গভীর সাংস্কৃতিক বাধা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরেই ‘শর্টকাট’-এর প্রতি এক ধরনের অদৃশ্য দুর্বলতা কাজ করছে। মূল বই না পড়ে নোট বা গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা আমাদের এক ধরনের স্বভাব হয়ে উঠেছে। সেই প্রবণতা আজ গবেষণার মতো নিষ্ঠা ও সততার দাবি করা ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়ছে। অর্থের বিনিময়ে গবেষণাপত্র লিখে দেওয়া বা ডেটা জালিয়াতির মতো অসাধু কাজের বিস্তার এই প্রবণতারই ভয়ংকর রূপ। তরুণদের বুঝতে হবে, জ্ঞানচর্চার কোনো শর্টকাট নেই। গবেষণার প্রকৃত সাফল্য নির্ভর করে সততা, অধ্যবসায় এবং দীর্ঘ সময়ের শ্রমসাধনার ওপর। যে নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে একজন গবেষক নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করেন, তার কোনো বিকল্প নেই। অসাধু চক্র শুধু ব্যক্তি গবেষকের ভবিষ্যৎ নয়, দেশের জ্ঞানচর্চার পরিবেশকেও কলুষিত করে।
তাই আমাদের কাজ কেবল তথ্য পরিবেশন নয়, গবেষণার নৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলার প্রচেষ্টাও। একজন প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার হয়তো তরুণদের চোখে স্বপ্ন জাগাবে, কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে যে মানসিক দৃঢ়তা ও অধ্যবসায় প্রয়োজন, সেই বার্তাও পৌঁছে দিতে হবে। গবেষণার প্রতিটি ধাপ—বিষয় নির্বাচন থেকে লিটারেচার রিভিউ, ডেটা সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, এবং শেষ পর্যন্ত পেপার লেখা—প্রতিটি পর্যায়েই প্রয়োজন গভীর ধৈর্য ও দীর্ঘস্থায়ী প্রচেষ্টা। সাফল্যের শিখরে ওঠার জন্য কোনো লিফট নেই; সিঁড়ি বেয়েই উঠতে হয়। আমাদের প্ল্যাটফর্ম সেই বার্তাই তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে চায়।
একটি দেশকে সত্যিকারের অর্থে স্বাবলম্বী হতে হলে অন্যের তৈরি পণ্য আমদানি বা বিপণনের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেদেরই করতে হবে, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি নিজস্ব মেধায় উদ্ভাবন করতে হবে। পৃথিবীর যে দেশগুলো আজ উন্নত ও প্রভাবশালী, তাদের সবার মাঝেই দেখা যায়—তাদের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ গবেষণা ও উন্নয়নে নিয়োজিত। তারা নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে এবং তা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। আমরা কেবল জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশ হয়ে থাকতে চাই না; আমরা চাই আমাদের তরুণরা দক্ষ ও উদ্ভাবনী শক্তিতে পরিণত হোক, যারা বাংলাদেশের মাটিতেই বিশ্বমানের কাজ করবে।
এই লক্ষ্যেই ‘বিজ্ঞানী.অর্গ’-এর পথচলা। আমরা বিশ্বাস করি, সঠিক দিকনির্দেশনা ও সহায়ক পরিবেশ পেলে আমাদের তরুণদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে আগামী দিনের জামাল নজরুল ইসলাম কিংবা সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ‘গবেষণায় হাতেখড়ি’ আমাদের এক বিনীত পদক্ষেপ। বাংলাদেশের নবীন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী গবেষকদের আমরা আহ্বান জানাই—এই উদ্যোগে যুক্ত হোন, আমাদের লেখাগুলো পড়ুন, নিজেদের সমৃদ্ধ করুন, এবং আপনাদের পরিচিত নবীন গবেষকদের মধ্যে এই বার্তা ছড়িয়ে দিন। সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই আমরা একটি জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব—যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হবে গবেষণার এই প্রশস্ত রাজপথে।
Leave a comment