বিজ্ঞানীদের জীবনীস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

ডা. রফিকুল ইসলাম: যার আবিষ্কার বদলে দিল বিশ্বের চিকিৎসা ব্যবস্থা;

Share
Share

শৈশব ও শিক্ষা

রফিকুল ইসলামের জন্ম বাংলাদেশের এক সাধারণ পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন কৌতূহলী ও পড়াশোনায় আগ্রহী। বিজ্ঞানের রহস্য জানার নেশা তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যায় চিকিৎসাশাস্ত্রের পথে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি গবেষণার প্রতি গভীরভাবে ঝুঁকে পড়েন। তাঁর লক্ষ্য ছিল—বাংলাদেশের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের জন্য এমন কোনো সহজ সমাধান খুঁজে বের করা যা ব্যয়বহুল চিকিৎসার বিকল্প হতে পারে।

গবেষণার পটভূমি

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই নয়, ছিল মানবিক সংকটেরও এক দুঃসহ অধ্যায়। যুদ্ধের সময় এবং পরবর্তীতে শরণার্থী শিবিরে কলেরা ও ডায়রিয়ার প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। অসংখ্য মানুষ তীব্র পানিশূন্যতায় মারা যাচ্ছিল। প্রচলিত চিকিৎসা ছিল অন্তঃশিরা তরল (IV fluid), কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তা সহজলভ্য ছিল না। ঠিক তখনই ডা. রফিকুল ইসলাম চিন্তা করলেন—যদি শরীরে পানি ও প্রয়োজনীয় লবণ সরবরাহের কোনো সহজ ও সস্তা পদ্ধতি বের করা যায়? এখান থেকেই জন্ম নেয় ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন বা ওরস্যালাইন।

আবিষ্কার ও সাফল্য

ডা. ইসলামের তৈরি প্রাথমিক স্যালাইন প্রথমে পরিচিতি পায় ঢাকা স্যালাইন নামে। এর সহজ রেসিপি—পানি, গ্লুকোজ এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ লবণ। অল্প খরচে সহজ প্রণালীতে তৈরি এই স্যালাইন খুব দ্রুত কার্যকর প্রমাণিত হয়। রোগীদের পানিশূন্যতা দূর হয়ে যায়, মৃত্যু হারের অবিশ্বাস্য হ্রাস ঘটে।

১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই আবিষ্কারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যান্সেট একে ঘোষণা করে “চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার”।

চ্যালেঞ্জ ও বাঁকবদল

প্রথম দিকে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন—শুধু মুখে খাওয়ানো এক তরল কীভাবে জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা হতে পারে? প্রচলিত চিকিৎসকরা এটিকে ‘প্রাথমিক’ বা ‘অপর্যাপ্ত’ বলে মনে করতেন। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা দেখাল, এই সাধারণ স্যালাইনই পারে হাজারো প্রাণ বাঁচাতে।

ডা. ইসলামকে লড়াই করতে হয়েছে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ, সরকারি অনুমোদন এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য। কিন্তু তিনি কখনো থেমে যাননি। তাঁর অধ্যবসায়ই ওরস্যালাইনকে স্থান দিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসার তালিকায়।

প্রভাব ও গুরুত্ব

আজ ওরস্যালাইন পৃথিবীর প্রতিটি মহাদেশে ব্যবহৃত হয়। আফ্রিকার দারিদ্রপীড়িত গ্রাম হোক বা এশিয়ার কোনো দূরবর্তী এলাকা—এই সস্তা ও কার্যকর সমাধান কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে প্রতিদিন। শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য ডা. রফিকুল ইসলামের এই আবিষ্কার এক অনন্য উপহার।

বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সম্মানিত করেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তিনি পেয়েছেন যথেষ্ট স্বীকৃতি। তবে তাঁর প্রকৃত কৃতিত্ব হলো—মানুষের কষ্ট লাঘব করা, মৃত্যুর মুখ থেকে তাদের ফিরিয়ে আনা।

শিক্ষার্থীদের প্রতি বার্তা

ডা. রফিকুল ইসলামের জীবন থেকে শিক্ষার্থীরা একটি বড় শিক্ষা নিতে পারে—সত্যিকারের বিজ্ঞান হলো মানবকল্যাণে নিবেদিত জ্ঞান। গবেষণা মানেই জটিল যন্ত্রপাতি নয়; কখনো কখনো সমাধান লুকিয়ে থাকে সাধারণ চিন্তা ও সাহসী প্রয়াসে।

তিনি যেন প্রতিটি তরুণ বিজ্ঞানীকে বলছেন—“নিজের দেশ ও মানুষের সমস্যাকে দেখ, সেখানেই তোমার গবেষণার বিষয় খুঁজে নাও। বড় কিছু আবিষ্কারের স্বপ্ন দেখো, তবে সেটি হোক মানুষের কল্যাণে।”

উপসংহার

ডা. রফিকুল ইসলাম প্রমাণ করেছেন যে, এক টুকরো কাগজে লেখা ফর্মুলাও বদলে দিতে পারে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস। তাঁর আবিষ্কার কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করেছে, আর বাংলাদেশকে দিয়েছে এক গর্বের পরিচয়।

আজকের প্রজন্মের জন্য তাঁর গল্প কেবল ইতিহাস নয়, এটি এক অনুপ্রেরণা—যা বলে, সীমিত সম্পদ থাকলেও দৃঢ় সংকল্প ও গবেষণার নেশায় এক বাঙালি বিজ্ঞানী হয়ে উঠতে পারে বিশ্বমানবতার ত্রাণকর্তা।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org