স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

উদ্দীপনার খেলাঘর

Share
Share

                                      অধ্যায় – ২ (যখন জেগে দেখি এ জগৎ)

 

প্রথম অধ্যায়ে আপেক্ষিকতা বোঝার পর সময় এসেছে মনুষ্য-মস্তিষ্কের প্রধান প্রধান অবস্থাগুলো একে একে বোঝার।

মনুষ্য-মস্তিষ্কের প্রধান প্রধান অবস্থা (স্টেট্স অফ  হিউম্যান ব্রেইন): মানুষের মস্তিষ্কের সাধারণ (কমোন্) অবস্থাগুলো (স্টেট্) ও পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আসা তথ্যসমূহ প্রধানত মিডব্রেইন এবং মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স ও মিডব্রেইন এর মাঝে অবস্থিত থ্যালামাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

 

নিরুদ্বেগ জাগ্রত অবস্থা (রিল্যাক্স্ড আওয়েক্ স্টেট) : আমাদের মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স কতগুলি লোবে (খন্ড)  বিভক্ত –  ফ্রন্টাল লোব, প্যারাইটাল লোব, অকিপিটাল লোব ও টেম্পোরাল লোব। জাগ্রত (আওয়েক্) কিন্তু অসতর্ক (নট্ অ্যালার্ট)  বা নিরুদ্বেগ (রিল্যাক্স্ড)  অবস্থায় অকিপিটাল লোব  থেকে এক বিশেষ ধরনের মস্তিষ্ক তরঙ্গ বা ব্রেইন ওয়েভ উৎপন্ন হয় যার নাম “আলফা ওয়েভ” ও কম্পাঙ্ক (ফ্রিকোয়েন্সি)  ৮ – ১২ হার্ৎজ।  চোখ বন্ধ অবস্থায় আলফা ওয়েভ অপেক্ষাকৃত বেশী পরিমাণে উৎপন্ন হয়। সেরিব্রাল কর্টেক্স এর ফ্রন্টাল লোব এর সামনের দিকে অবস্থিত “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটিই (সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ পার্ট)  প্রধানত আমাদের শর্ট টার্ম মেমোরিতে সংগৃহীত তথ্যগুলি ব্যবহার করে যৌক্তিক (লজিকাল্) ও স্বজ্ঞাত (ইন্টিউয়েটিভ) সিদ্ধান্ত নিতে বা কল্পনা করতে সাহায্য করে। মস্তিষ্কের এই অবস্থায় “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটি  নিষ্ক্রিয় (ইনার্ট)  থাকে। আচ্ছা তোমার “ল্যাদ্” খেতে ভালো লাগে? ব্যবহারিক বাংলা ভাষায় আমরা যাকে “ল্যাদ্ খাওয়া” বলি, তা মস্তিষ্কের এই অবস্থাকেই নির্দেশ করে।

“শর্ট টার্ম মেমোরি” শব্দটা ইতিমধ্যে ব্যবহার করেছি। “শর্ট টার্ম মেমোরি” কি তা সহজ করে বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দিই। তুমি এখন যে বাক্যটা পড়ছ তার অর্থ বুঝতে গেলে বাক্যের শেষের দিকের অংশটা পড়ার সময় বাক্যের শুরুটাও তোমাকে মনে রাখতে হবে আর তোমার মস্তিষ্কের শর্ট টার্ম মেমোরি -ই এই কাজটা করে দেয় – অর্থাৎ অল্প সময়ের  (১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড অথবা কখনও ১ মিনিট) জন্য অল্প কিছু তথ্য সে ধরে রাখে। সেরিব্রাল কর্টেক্স এর অকিপিটাল লোব-এ যে ভিসুয়াল কর্টেক্স আছে তার কাছাকাছি রয়েছে একটি নিউরাল লুপ (নিউরাল লুপ হলো কতগুলি স্নায়ুকোষের সমষ্টি যারা কোন একটি নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য একটি সিরিস বা ক্রমে সংযুক্ত থেকে তথ্যকে মস্তিষ্কের এক স্থান থেকে স্থানান্তরে বয়ে নিয়ে যায়) যা দৃষ্টি সম্বন্ধীয় তথ্যের (ভিসুয়াল ডেটা)  শর্ট টার্ম  মেমোরি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও একটি ফোনোলজিকাল নিউরাল লুপ আছে যা ফ্রন্টাল লোব-এ অবস্থিত “ব্রকাস্ এরিয়া”-র সাথে সম্মিলিতভাবে শব্দ ও ভাষা সম্বন্ধীয় তথ্যের (অডিও ডেটা)  শর্ট টার্ম  মেমোরি হিসাবে কাজ করে।

         মস্তিষ্কের ব্রকাস এরিয়া

 

               মস্তিষ্কের ভিসুয়াল কর্টেক্স

 

 

 

 

সতর্ক জাগ্রত অবস্থা (অ্যালার্ট আওয়েক্ স্টেট) : জাগ্রত অবস্থায় মনুষ্য-মস্তিষ্ক যখনই নিরুদ্বেগ অবস্থা থেকে ক্রমশ সতর্ক হয়, উচ্চ কম্পাঙ্কের (ফ্রিকোয়েন্সি) “বিটা ওয়েভ” বা “বিটা তরঙ্গ” [কম্পাঙ্ক  ১২.৫ – ২৮ হার্ৎজ] উৎপন্ন হতে শুরু করে এবং আলফা ওয়েভ উৎপাদন বন্ধ হয়। এই অবস্থায় “প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স” এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী অংশটি সক্রিয় হতে শুরু করে।

            মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স

 

আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে (নারভাস্ সিস্টেম) একটি স্নায়ুকোষ (নিউরোন)  থেকে আরেকটি স্নায়ুকোষে তথ্য যে সকল রাসায়নিক পদার্থের (কেমিকাল সাব্সট্যান্স)  অণুর (মলিকিউল) মাধ্যমে বাহিত হয় তাদের “নিউরোট্রান্সমিটার” বলে। “এন্ডর্ফিন”, “ডোপামিন”, “অক্সিটোসিন” ও “সেরাটোনিন” – এই চারটি নিউরোট্রান্সমিটার একত্রে “নিউরোট্রান্সমিটার কোয়ার্টেট্” নামে খ্যাত যারা আমাদের উপলব্ধিতে ভালো লাগা বা “ফিল্ গুড্ ফ্যাক্টার”-র জন্ম দেয়। তোমার সামনে এক থালা বিরিয়ানী রাখলে তার পরিপ্রেক্ষিতে তোমার যে সুন্দর উপলব্ধি তার কারণ তোমার মস্তিষ্কে “এন্ডর্ফিন”-র ক্ষরণ। জানি না, তুমি হয়ত প্রেম করেছ। কিন্তু তুমি কি সত্যিই কোনদিন প্রেমে পড়েছ? যদি পড়ে থাকো, তোমার মস্তিষ্ক সেদিন “ডোপামিন”-এ স্নান করেছে। তুমি তোমার উপলব্ধির ঘরে যাকে বিশেষ জায়গা দিয়েছ, তাকে ভাবলে বা তার চোখে চোখ রাখলে তোমার যে উথাল-পাথাল উপলব্ধি তার জন্য দায়ী “অক্সিটোসিন”। ভেবে দেখ, কোন আতঙ্কের সিনেমা দেখলে বা কোন নিষ্ঠুর ঘটনার সাক্ষী হলে, তোমার মস্তিষ্ক কোন্ ধরনের উপলব্ধি বয়ে চলে – এই সময় “সেরাটোনিন” নিউরোট্রান্সমিটারের ক্ষরণ কমে যাওয়ায় উপলব্ধিতে মিশতে থাকে “সারভাইভাল ক্রাইসিস”।

যে বিষয়টায় তুমি তোমার সাফল্য খুব একটা আশা করো না বা যে বিষয়ে তুমি বারবার হোচট্ খাও, সেই বিষয়ে হঠাৎ একটা ছোট্ট সাফল্যে কুড়িয়ে পাওয়া আনন্দ তোমার অজান্তেই বিষয়টিতে তোমার দক্ষতা বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দেয়। কারণ নিউরোট্রান্সমিটার কোয়ার্টেট্ এর পরিমিত ক্ষরণ প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স-র সক্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়। আবার নিউরোট্রান্সমিটার কোয়ার্টেট্ এর অতিরিক্ত ক্ষরণ প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স-কে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। সেইজন্য সাফল্য যত বড়ই হোক, অত্যধিক উচ্ছ্বাস মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ভালো নয়।

Share
Written by
Diganta Paul -

জন্ম: ১৯৮৯ সালে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলায়। শিক্ষা: প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা হাওড়া জিলা স্কুলে। এরপর কলকাতার "সেইন্ট থমাস্ কলেজ অফ এঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজি" কলেজ থেকে বৈদ্যুতিক কারিগরিবিদ্যা নিয়ে প্রযুক্তিতে স্নাতক (B.Tech. in Electrical Engineering)। পেশা: তথ্য প্রযুক্তি পেশাদার (IT Professional)। নেশা: বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনা। এছাড়াও বিজ্ঞান প্রবন্ধ, বিজ্ঞান নিবন্ধ, কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প, কল্পবিজ্ঞান কবিতা, গাণিতিক কল্পকাহিনী, বিজ্ঞান নাটক, ও বিজ্ঞান কবিতা লেখা। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি রৌপ্য পদক। যোগাযোগ: [email protected]

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচিকিৎসা বিদ্যাসাক্ষাৎকারস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

আমাদের গর্ব ড. ফারিয়াহ মাহযাবীন

কৃতি বিজ্ঞানীদের সিরিজে আমি কথা বলেছি ড. ফারিয়াহ মাহযাবীন এর সাথে। তিনি...

GenZপরিবেশ ও পৃথিবীসাক্ষাৎকারস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

ই-বর্জ্য এর গবেষক হৃদয় রায়

ই-বর্জ এর গবেষক হৃদয় রায়। বাংলাদেশের মধ্যে ই-বর্জ নিয়ে কাজ করছে এমন...

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

অন্ধকারে ভয়

কোন ব্যক্তি বাস্তবে যতই সাহসী হোন না কেন, গভীর রাতে অন্ধকার জনশূন্য...

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

পাখার শব্দে নাম যে পাখির

ঈগল, বাজ ইত্যাদি পাখি মানুষকে এরোপ্লেন আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা জোগালেও ফড়িং, মৌমাছি ইত্যাদি...

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

মাছরাঙার মাছ ধরা

একটি মাছরাঙা প্রতিদিন নিজের ওজনের প্রায় সম পরিমাণ ছোটো মাছ শিকার করে...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.