মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা আমাদের প্রধান প্রতিরক্ষা প্রাচীর—যা ক্ষতিকর জীবাণু, ভাইরাস ও নানা আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে কাজ করে। কিন্তু অনেক সময় এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উল্টে গিয়ে সুস্থ কোষকেই আক্রমণ করতে শুরু করে। ক্যান্সার, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস কিংবা টাইপ-১ ডায়াবেটিসের মতো অটোইমিউন রোগগুলোর মূলেই রয়েছে এই অসামঞ্জস্য। ২০২৫ সালের ফিজিওলজি বা মেডিসিনের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তিনজন বিজ্ঞানীকে—যারা “পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্স” নিয়ে মৌলিক গবেষণা করেছেন। এই প্রক্রিয়াই মূলত রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দেহের ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখে, একইসাথে অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও অটোইমিউন রোগের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
স্টকহোমে সোমবার ঘোষিত এই পুরস্কার পেয়েছেন মেরি ই. ব্রাঙ্কো, ফ্রেড রামসডেল ও শিমোন সাকাগুচি। সাকাগুচি বর্তমানে জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজি ফ্রন্টিয়ার রিসার্চ সেন্টারের বিশিষ্ট অধ্যাপক। ব্রাঙ্কো যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল শহরে ইনস্টিটিউট ফর সিস্টেমস বায়োলজির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার এবং রামসডেল ক্যালিফোর্নিয়ার সোনোমা বায়োথেরাপিউটিক্সের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা। নোবেল কমিটি তাঁদের গবেষণাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, কারণ এই কাজ নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পথ খুলে দিয়েছে—বিশেষ করে রেগুলেটরি টি-সেল নিয়ে, যা অতিরিক্ত সক্রিয় রোগপ্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া দমন করতে সক্ষম।
নোবেল কমিটির সদস্য মেরি ভারেন-হারলেনিয়াস এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন,
“এই বছরের নোবেল পুরস্কারটি মূলত আমাদের দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা কীভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেই প্রক্রিয়ার স্বীকৃতি। এভাবে আমরা জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করি, আবার একই সাথে অটোইমিউন রোগ এড়াতে পারি।”
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের অধ্যাপক মারিয়া-লুইসা আলেগ্রে বলেন,
“নোবেল পুরস্কারে কেবল তিনজনকে স্বীকৃতি দেওয়া যায়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে বহু গবেষক পথিকৃৎ ছিলেন। এই স্বীকৃতি আমাদের অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও অটোইমিউন রোগের চিকিৎসায় নতুন গতি দেবে।”
দমনকারী কোষ থেকে রেগুলেটরি টি-সেল
১৯৭০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা ধারণা দেন যে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থায় এমন কিছু টি-সেল থাকতে পারে, যা অন্য প্রতিক্রিয়াগুলোকে দমন করে। প্রথমে এগুলোকে “সাপ্রেসর টি-সেল” বলা হতো। তবে প্রাথমিক গবেষণায় নিশ্চিত প্রমাণ না মেলায় এই ধারণা ধীরে ধীরে ভুলে যাওয়া হয়।
কিন্তু পরে জাপানের নাগোয়ার আইচি ক্যান্সার সেন্টারে গবেষণা করার সময় সাকাগুচি আবার এই ধারণাকে সামনে আনেন। তিনি খুঁজছিলেন এমন কোনো আণবিক চিহ্ন (মার্কার) যা দিয়ে এই বিশেষ কোষগুলোকে আলাদা করা যায়। সাকাগুচি ও তাঁর সহকর্মীরা মাউস নিয়ে পরীক্ষা চালান এবং দেখতে পান—CD25 নামক এক বিশেষ প্রোটিনযুক্ত কোষ দেহকে নিজেই আক্রমণ করা থেকে প্রতিরোধ করতে অপরিহার্য। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় তিনি এই শ্রেণির কোষকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেন, যেগুলো এখন পরিচিত রেগুলেটরি টি-সেল নামে।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার স্যাভেজ বলেন,
“সাপ্রেসর সেলের ধারণা তখন অপ্রিয় ছিল। কিন্তু সাকাগুচি ধারাবাহিক ও নিখুঁত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করলেন যে আসলেই এমন শক্তিশালী ‘শান্তিরক্ষী’ কোষ বিদ্যমান।”
FOXP3 জিন ও রোগপ্রতিরোধ গবেষণার নতুন অধ্যায়
ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে ব্রাঙ্কো ও রামসডেল আরও গভীরে গিয়ে এই রেগুলেটরি টি-সেলের জেনেটিক ভিত্তি উদ্ঘাটন করেন। তাঁরা গবেষণা চালান এক বিশেষ প্রজাতির ইঁদুরে, যাদের স্কারফি মাউস বলা হয়। এদের ত্বকে খোসা ওঠা, লসিকা গ্রন্থি ফোলা—এমন উপসর্গ দেখা যেত এবং তারা অল্প সময় বাঁচত। গবেষণায় বেরিয়ে আসে যে FOXP3 নামক একটি জিন এর জন্যই এই অটোইমিউন রোগ সৃষ্টি হয়। পরে দেখা যায়, মানুষের ক্ষেত্রেও এই জিনে মিউটেশন ঘটলে গুরুতর রোগ IPEX সিনড্রোম (immune dysregulation, polyendocrinopathy, enteropathy, X-linked syndrome) দেখা দেয়।
এই আবিষ্কারগুলো সাকাগুচি ও অন্যান্য গবেষকদের জন্য নতুন ভিত্তি তৈরি করে, যার মধ্যে রয়েছেন আলেকজান্ডার রুডেনস্কি—যিনি বর্তমানে মেমোরিয়াল স্লোন কেটারিং ক্যান্সার সেন্টারের ইমিউনোলজি প্রোগ্রাম পরিচালনা করছেন।
উপসংহার
২০২৫ সালের নোবেল পুরস্কার আবারও প্রমাণ করল—মৌলিক গবেষণাই নতুন চিকিৎসার দিগন্ত উন্মোচন করে। সাকাগুচি, ব্রাঙ্কো ও রামসডেলের কাজ শুধু বৈজ্ঞানিক তত্ত্বেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাস্তবে কোটি মানুষের জীবন বাঁচানোর সম্ভাবনা তৈরি করছে। ভবিষ্যতে অটোইমিউন রোগ কিংবা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে তাঁদের আবিষ্কারের ফল সরাসরি চিকিৎসায় ব্যবহৃত হবে—এ নিয়ে আর কোনো সংশয় নেই।
Leave a comment