অতিথি লেখক- আজিজুল হক
সহকারী অধ্যাপক, ইয়েংনাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আমি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আমাদের গবেষণা ল্যাব নেই, কোনো গবেষণা প্রকল্পে কাজ করার সুযোগও খুব সীমিত। এই বাস্তবতায় অনেক শিক্ষার্থীর মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায় – আমাদের ভবিষ্যৎ কী? আমরা কি সত্যিই উচ্চশিক্ষা বা বিদেশে স্কলারশিপ পাওয়ার মতো যোগ্য হয়ে উঠতে পারবো?
বাংলাদেশে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধীনে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা লাখেরও বেশি। অথচ জাতীয় বা আন্তর্জাতিক উচ্চশিক্ষা পরিকল্পনা, স্কলারশিপ কর্মসূচি কিংবা গবেষণা উদ্যোগে এই বিশাল অংশের উপস্থিতি অনেকটাই উপেক্ষিত।
দুঃখজনকভাবে আমাদের সমাজে এখনো শিক্ষার্থীর মেধা মূল্যায়ন হয় সে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তার ভিত্তিতে। পাবলিক না প্রাইভেট না ন্যাশনাল? এই প্রশ্নটাই যেন ভবিষ্যতের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। এখানে গবেষণার পর্যাপ্ত পরিবেশ নেই, গবেষক বা শিক্ষকের তত্ত্বাবধান প্রায় অসম্ভব, অনেকেই পরিবার, চাকরি ও পড়ালেখা একসাথে সামলে নিচ্ছেন। বিশাল সিলেবাস, পর্যাপ্ত গাইডলাইন বা রিসোর্সের অভাব এবং তুলনামূলকভাবে CGPA অর্জন করা কঠিন। সব মিলিয়ে চ্যালেঞ্জ অনেক।
কিন্তু প্রশ্ন হলো এই সীমাবদ্ধতাই কি শেষ কথা? না।
শুরুর জায়গা যদি দুর্বলও হয়, নিজের গতিপথ যদি শক্তভাবে ঠিক করা যায়, তবে গন্তব্য কিন্তু পরিবর্তন করা সম্ভব।
নিজের জন্য নিজেকেই পথ তৈরি করতে হবে। আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, সেটি বড় কথা নয়। আপনি নিজেকে কীভাবে তৈরি করছেন, সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের যুগ তথ্যপ্রযুক্তির। একজন শিক্ষার্থী এখন ঘরে বসেই বই, গবেষণাপত্র, অনলাইন কোর্স, লেকচার ভিডিও এমনকি বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাসামগ্রীতে সহজেই প্রবেশ করতে পারে।
শুধু প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা, ইচ্ছাশক্তি, আর শেখার আগ্রহ।
যদি বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে চান, তবে হাজারো স্কলারশিপ, গবেষণাগার, ও প্রফেসরের রিসার্চ গ্রুপে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। দরকার শুধু সাহস করে খুঁজে বের করা, শেখা ও নিজেকে প্রস্তুত করা।
প্রথম ধাপ হিসেবে নিজের সাবজেক্ট ভালোভাবে বোঝা জরুরি। শুধু পরীক্ষার জন্য মুখস্থ পড়া যথেষ্ট নয়। শেখা মানে হলো নিজে বোঝা, প্রশ্ন করা এবং গভীরভাবে চিন্তা করা। পাশাপাশি IELTS, TOEFL বা GRE-এর প্রস্তুতিও যত দ্রুত সম্ভব শুরু করা উচিত। ভালো স্কোরের জন্য নিয়মিত চর্চা করতে হবে।
গবেষণাপত্র পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
শুধু একাডেমিক পড়াশোনা নয়, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্কিলও শেখা দরকার। যেমন কমিউনিকেশন স্কিল, প্রেজেন্টেশন স্কিল, প্রোগ্রামিং (Python/R), ডেটা অ্যানালাইসিস ইত্যাদি। এগুলো উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জগতে আপনাকে এগিয়ে রাখবে।
তবে শুধু পড়ালেখায় নয়। যুক্ত হোন বিতর্ক, অলিম্পিয়াড, স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম বা কালচারাল ক্লাবের সঙ্গে। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়বে, নেটওয়ার্ক তৈরি হবে, আর নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার সুযোগ পাবেন।
স্কলারশিপের জন্য সাধারণত কী কী যোগ্যতা বা requirements লাগে তা ভালোভাবে জানার চেষ্টা করুন। সেই সঙ্গে কীভাবে একটি মানসম্মত সিভি, রিসার্চ প্রোপোজাল, SOP, পার্সোনাল স্টেটমেন্ট এবং প্রফেসরের কাছে ইমেইল লেখা হয়, তা শেখাও জরুরি।
বিদেশে অনেক জায়গাতেই মাস্টার্সে স্কলারশিপের জন্য গবেষণাপত্র বাধ্যতামূলক নয়। অনেক সময় পিএইচডির ক্ষেত্রেও না। তাই অনার্স শেষ করে চেষ্টা করুন দেশের বাইরে মাস্টার্স করার। এতে গবেষণার অভিজ্ঞতা হবে, আন্তর্জাতিক পরিবেশে কাজের সুযোগ পাবেন, আর পিএইচডির পথটাও সহজ হবে।
সবচেয়ে বড় কথা বিদেশে কেউ আপনাকে জিজ্ঞেস করবে না বাংলাদেশে আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তারা দেখবে আপনি কী জানেন, কী পারেন, আপনি কীভাবে কাজ করেন।
এমনভাবে নিজেকে তৈরি করুন যাতে আজ যারা আপনাকে অবমূল্যায়ন করছে, কাল তারাই আপনার সাফল্য দেখে গর্ব করে বলবে —
“ও তো ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ে আজ এই জায়গায় এসেছে!”
আপনার পরিশ্রম, দক্ষতা আর ধৈর্যই একদিন আপনার সবচেয়ে বড় পরিচয় হয়ে উঠবে।
তাই আজ থেকেই শুরু করুন। নিজের স্বপ্নের প্রতি অবিচল থাকুন। প্রতিদিন একটু একটু করে শেখার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
হতাশাকে নয়, সম্ভাবনাকে শক্তি বানান। নিজেকে প্রমাণ করুন।
Not just to prove others wrong, but to prove yourself right!
Leave a comment