নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
কয়েক বছর আগেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) বড় ভাষা মডেল তৈরি করাটা ছিল একপ্রকার বৈপ্লবিক প্রযুক্তিগত সাফল্য। ২০২২ সাল পর্যন্ত, এমন একটি মডেল তৈরি করাই ছিল রীতিমতো চমকপ্রদ। তবে মাত্র তিন বছর পর, ২০২৫ সালে এসে, প্রযুক্তিবিদদের আর তা দিয়ে খুব একটা চমকে দেওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হলো—শুধু ভালো মডেল তৈরি করলেই হবে না, সেটা কত সস্তায় বানানো যায়, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে আসল চ্যালেঞ্জ।
আজকের এই AI দুনিয়ায়, ‘কত কম খরচে আপনি GPT বা ChatGPT-এর মতো একটি ভাষা মডেল বানাতে পারেন’—এটাই যেন প্রতিযোগিতার মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় একটি LLM (Large Language Model) বানাতে লাগত কয়েক মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এখন সেই খরচ নামিয়ে আনা হচ্ছে কয়েকশ, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে কয়েক ডলারের মধ্যেও।
💰 ছয় মিলিয়ন ডলারের মডেল এখন পুরনো গল্প
“একটা ছয় মিলিয়ন ডলারের LLM এখন আর ‘কুল’ নয়,” বলছেন প্রযুক্তিবিদরা। বরং একটা ছয় ডলারের মডেল তৈরি করতে পারা এখনকার দিনের বড় কৃতিত্ব। যেমন, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, কম শক্তিশালী হার্ডওয়্যার ও সীমিত ডেটা ব্যবহার করেও মাঝারি মানের একটি ভাষা মডেল বানানো যাচ্ছে মাত্র কয়েক ডলারে।
এই প্রবণতা যে শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফল, তা নয়। এর পেছনে আছে নীতিগত ও অর্থনৈতিক বিবেচনাও। আগে যেখানে কয়েকশ কোটি টাকার ফান্ড ছাড়া AI ল্যাব বা স্টার্টআপগুলো চলত না, এখন ছোট স্কেলেও কাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে।
📉 ব্যয় কমানোর তিনটি কৌশল
বড় বড় প্রতিষ্ঠান যেমন Google DeepMind, OpenAI বা Meta-র মতো সংস্থাগুলো প্রচুর টাকা খরচ করে ভাষা মডেল তৈরি করে। কিন্তু নতুন প্রজন্মের উদ্ভাবকেরা তিনটি মূল পদ্ধতিতে খরচ কমাচ্ছেন—
- ছোট ডেটাসেট ও টার্গেটেড প্রশিক্ষণ: পুরো ইন্টারনেট না ঘেঁটে নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
- সাশ্রয়ী হার্ডওয়্যার: ব্যয়বহুল GPU না কিনে ব্যবহার করা হচ্ছে কম খরচের প্রসেসর।
- খোলা উৎস (Open Source) প্রযুক্তি: HuggingFace বা Mistral-এর মতো ওপেনসোর্স প্ল্যাটফর্ম থেকে নেওয়া মডেল দিয়ে কাজ শুরু করা হচ্ছে।
এভাবে খরচ নামিয়ে আনা হচ্ছে নাটকীয়ভাবে। যেমন, একটি উদাহরণ অনুযায়ী, ২০২৫ সালের গোড়ার দিকে একটি LLM মাত্র ৫০০ ডলারে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ভাবা যায়?
🌏 AI এখন সবার জন্য
এই ব্যয় হ্রাসের সবচেয়ে বড় সুফল হলো—AI এখন ধনীদের একচেটিয়া হাতিয়ার নয়। এখন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা ছোট উদ্যোগগুলো নিজেদের ভাষা মডেল তৈরি করতে পারছে। বাংলা ভাষার জন্য নির্দিষ্ট মডেল তৈরি করাও এখন অনেক সহজ ও সস্তা।
বিশ্বজুড়ে দেখা যাচ্ছে, নানা ভাষা ও প্রেক্ষাপটে ছোট মডেলগুলো তৈরি হচ্ছে। আফ্রিকান ভাষা, মধ্য এশিয়ার আঞ্চলিক উপভাষা বা দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী ভাষার জন্য তৈরি হচ্ছে বিশেষকৃত ভাষা মডেল।
এগুলো হয়তো GPT-4-এর মতো সর্বব্যাপী হবে না, কিন্তু নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে এরা অনেক বেশি কার্যকর।
🧠 মডেল ছোট হলে কী হবে, কাজে কম?
অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে—কম খরচে বানানো LLM কি কাজের হবে? উত্তরে গবেষকরা বলছেন—‘কাজে হবে, যদি আপনি স্পষ্ট করে লক্ষ্য নির্ধারণ করেন’। যেমন ধরুন, কোনো ব্যাংক শুধু গ্রাহকের জিজ্ঞাসা উত্তর দেওয়ার জন্য একটি ছোট ভাষা মডেল তৈরি করলো, তাহলে সেটার জন্য GPT-4-এর মতো বিশাল মডেল প্রয়োজন পড়ে না। একই কথা বলা যায় গ্রাম পর্যায়ে কৃষি পরামর্শ, স্থানীয় ভাষায় মেডিকেল গাইডলাইন বা আইনি সহায়তার ক্ষেত্রেও।
🏗️ স্টার্টআপদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ
এই ব্যয় হ্রাসের ফলে ছোট স্টার্টআপগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে নিজেদের LLM বানিয়ে সেটিকে ব্যবসায়িকভাবে ব্যবহার করার। যেমন—
- 🧾 স্থানীয় ভাষার কাস্টমার সার্ভিস বট
- 👩⚕️ স্বাস্থ্য পরামর্শ সহায়ক AI
- 📚 শিক্ষামূলক চ্যাটবট
- 📈 স্থানীয় ব্যবসার অ্যানালিটিক্স টুল
আগে যেখানে এসব পরিষেবা গড়ে তুলতে বড় পুঁজি দরকার হতো, এখন একটি ৫০০-১০০০ ডলারের বিনিয়োগে এসব বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
🇧🇩 বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কী সম্ভাবনা?
বাংলাদেশে AI নিয়ে কাজ হচ্ছে বটে, তবে এখনো গবেষণার পরিমাণ সীমিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশি মডেলই ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এই সস্তা LLM তৈরির সুযোগ যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, তাহলে—
- বাংলা ভাষার জন্য কাস্টম GPT
- চট্টগ্রাম, সিলেটের উপভাষায় বিশেষ মডেল
- স্থানীয় সমস্যা যেমন কৃষি, পরিবেশ, নারী স্বাস্থ্য নিয়ে বিশেষ মডেল তৈরি করা সম্ভব
বিশ্বে এখন Localization বা স্থানীয়করণে বড় AI কোম্পানিগুলোর আগ্রহ বাড়ছে। বাংলাদেশের তরুণ AI গবেষকদের এই সস্তা LLM-এর জগতে ঝাঁপিয়ে পড়া এখন সময়ের দাবি।
🔮 ভবিষ্যৎ কী?
এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো আপনি নিজেই নিজের ফোনে একটি কাস্টম LLM বানিয়ে ফেলবেন—যেটা আপনার ইমেইল পড়বে, আপনাকে দৈনন্দিন কাজে সহায়তা করবে, এমনকি আপনার জন্য উপযুক্ত ক্যারিয়ার পরামর্শও দেবে।
এক সময় যেটা শুধু সিলিকন ভ্যালির বিশাল কোম্পানির হাতের মুঠোয় ছিল, এখন সেটা হতে চলেছে ‘প্রত্যেকের প্রযুক্তি’।
✍️ উপসংহার
এক মুষ্টি টাকায় LLM—এই কথাটা শুনতে আজকে অদ্ভুত লাগলেও, এটা আসলে আমাদের ভবিষ্যতের বাস্তবতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর বড় কোম্পানির বিষয় নয়, এটা আমাদের সমাজ, ভাষা, ব্যবসা ও জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের প্রযুক্তিবিদ, উদ্যোক্তা ও শিক্ষার্থীদের উচিত এই ঢেউয়ের অংশ হওয়া।
ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে—তবে সেটা কেবল তাদের জন্য যারা প্রস্তুত।
📧 যোগাযোগ: [email protected]
🖊️ লেখা: নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
🌐 biggani.org | বিজ্ঞানে আগামীর গল্প
Leave a comment