গবেষকদের যন্ত্রপাতি

অসীমের অস্তিত্ব কি সত্যিই আছে?

Share
Share

গণিতের ইতিহাসে এমন কিছু প্রশ্ন আছে যা মানুষের কল্পনাশক্তিকে হাজার বছর ধরে নাড়া দিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো—অসীম কি আদৌ আছে? প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বলেছিলেন, অসীমকে আমরা দু’ভাবে বুঝতে পারি। একদিকে আছে সম্ভাব্য অসীম—যেমন ধরা যাক, আমরা যদি ক্রমাগত একের পর এক সংখ্যা গুনি, তখন এই প্রক্রিয়াটি শেষ হয় না, কিন্তু সব সময়ই কেবল সম্ভাবনার মধ্যে থেকে যায়। অন্যদিকে আছে বাস্তব অসীম—যা তিনি একেবারেই অস্বীকার করেছিলেন। বাস্তব জগতে অসীম জিনিস নেই—এই ধারণা প্রাচীনকাল থেকেই দর্শন আর গণিতকে বিভ্রান্ত করেছে।

অনেক দিন পর্যন্ত গণিতবিদরা অসীমকে পাশ কাটিয়ে চলেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে জার্মান গণিতবিদ জর্জ কান্টর এসে এই সংশয় দূর করেন। সেট থিওরি বা সমষ্টি তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি দেখালেন, অসীম সংখ্যাগুলোকেও গণিতের কাঠামোর ভেতর আনা সম্ভব। তখন থেকে অসীম গণিতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠল। স্কুলে আমরা শিখি যে স্বাভাবিক সংখ্যা বা বাস্তব সংখ্যার সমষ্টি অসীম বড়, আবার π কিংবা √২–এর মতো অমূলদ সংখ্যাগুলোও অসীম দশমিক স্থান নিয়ে বিস্তৃত।

তবে এখানেই থেমে যায়নি বিতর্ক। আজও এমন একটি গোষ্ঠী আছে, যারা নিজেদের বলে “ফাইনাইটিস্ট” বা সীমাবাদী। তাদের মতে আমাদের মহাবিশ্বের প্রতিটি সম্পদ সীমিত—গণনার শক্তিও সীমিত—তাহলে গণিতে অসীম ব্যবহার করার মানে কী? তারা প্রস্তাব করেছেন একটি বিকল্প গণিতের কাঠামো, যেখানে কেবল সীমিত জিনিস নিয়েই কাজ করা হবে। আশ্চর্যের বিষয়, সাম্প্রতিক কালে কিছু পদার্থবিদও এই সীমাবাদের ধারণা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন—যদি সীমিত গণিতের মাধ্যমে প্রকৃতিকে আরও সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।

সেট থিওরিকে সহজভাবে ভাবলে এটি এক ধরনের ব্যাগ বা থলি, যেখানে সংখ্যা, ফাংশন বা যেকোনো জিনিস রাখা যায়। দুটি ব্যাগ তুলনা করতে হলে আমরা একসাথে ভেতরের জিনিসগুলো বের করি—যেটি আগে খালি হয়ে যাবে, সেটি ছোট। কান্টরের মৌলিক অবদান হলো, এই সাধারণ প্রক্রিয়া দিয়েই তিনি অসীম সংখ্যাগুলোর তুলনা করতে পেরেছিলেন। এবং অবাক করা বিষয় হলো—সব অসীম সমান নয়, কিছু অসীম অন্যগুলোর চেয়ে বড়।

এই ধারণাকে ভিত্তি করে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আবরাহাম ফ্রেনকেল ও আর্নস্ট জার্মেলো গণিতের জন্য এক নতুন ভিত্তি দাঁড় করান। নয়টি মৌলিক নীতিকে তারা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন। এর মধ্যে একটি হলো ‘শূন্য সমষ্টি’—একটি খালি ব্যাগের অস্তিত্ব সবাই মেনে নিলেও, আরেকটি স্বতঃসিদ্ধ বলছে অসীম সমষ্টির অস্তিত্বও নিশ্চিত। এখানেই ফাইনাইটিস্টরা আপত্তি তোলে। তাদের মতে অসীম ছাড়া গণিত হওয়া সম্ভব, বরং আরও যৌক্তিক।

সীমাবাদীরা শুধু দার্শনিক আপত্তিই তোলে না। তারা দেখায়, অসীম থেকে যে ফলাফল বের হয় তার অনেকটাই অস্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ, বেনাখ–তার্সকি প্যারাডক্স বলছে—একটি গোলককে ভেঙে টুকরো করলে তা থেকে আবার দুইটি সমান বড় গোলক বানানো সম্ভব। বাস্তবে এটি অসম্ভব হলেও, সেট থিওরির মাধ্যমে এটি গণিতগতভাবে সম্ভব। সীমাবাদীদের যুক্তি হলো—যদি এই ধরনের ফলাফল আসে, তবে মৌলিক স্বতঃসিদ্ধেই ত্রুটি আছে।

তাদের সহজ যুক্তি: একটি গণিতীয় বস্তু কেবল তখনই থাকবে যখন তা প্রাকৃতিক সংখ্যা থেকে সীমিত ধাপে তৈরি করা যাবে। এ কারণে অসীম ধারার উপর দাঁড়িয়ে থাকা অমূলদ সংখ্যাগুলো তাদের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। √২–এর মতো সংখ্যার অস্তিত্ব যে সূত্রে পাওয়া যায়, সেটি আসলে অসীম প্রক্রিয়ার ফল। ফলে সীমাবাদীরা তা মেনে নেয় না।

এতে করে আরেকটি বড় সমস্যা দাঁড়ায়। এরিস্টটলের “excluded middle” সূত্র—যেটি বলে প্রতিটি বিবৃতি হয় সত্য নয় মিথ্যা—তা এখানে খাটে না। সীমিত গণিতে কিছু বিবৃতি অনির্ধারিত থেকে যায়, কারণ কোনো সংখ্যা এখনো গণনা করে ধরা হয়নি। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় 0.999… এই সংখ্যাটিকে। অসীম ৯ ধরলে সেটি ১ হয়, কিন্তু অসীম যদি না-ই থাকে, তবে এই সমীকরণ আর সত্য হয় না।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে—তাহলে কি সীমিত গণিতের মাধ্যমে একটি নতুন জগৎ তৈরি করা সম্ভব? বেশির ভাগ গণিতবিদ মনে করেন, এটি বাস্তবের চেয়ে জটিলতর এক পথ। তবু কিছু পদার্থবিদ এর পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন। জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকোলাস গিসাঁ যুক্তি দেন, যদি মহাবিশ্বে তথ্য ধারণ করার ক্ষমতা সীমিত হয়, তবে অসীম সংখ্যা দিয়ে কাজ করা অর্থহীন। তখন সীমিত গণিতই প্রকৃতিকে সঠিকভাবে ধরতে পারে।

এই প্রচেষ্টা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। কিন্তু চিন্তাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান বহু মৌলিক প্রশ্নে আটকে আছে—মহাবিশ্বের জন্ম কিভাবে হলো, মৌলিক শক্তিগুলো কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত—এসব প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা। হয়তো সীমিত গণিত এক নতুন সূত্রপাতের পথ খুলে দিতে পারে।

তবে শেষ পর্যন্ত বিষয়টি বিশ্বাসের জায়গাতেই গিয়ে ঠেকে। কেউ হয়তো মেনে নেয় যে অসীম আসলেই আছে, আবার কেউ ভাবে সবকিছু সীমিত। গণিতের ভেতরে এই মতপার্থক্য ভবিষ্যতেও চলবে। কিন্তু আমাদের কাছে এই বিতর্ক কেবল গণিতের তত্ত্ব নয়, এটি মানুষের কল্পনাশক্তির সীমানা নিয়ে এক চিরন্তন অনুসন্ধান। অসীম কিংবা সীমিত—উভয় ক্ষেত্রেই মানবমনের অভিযাত্রা থেমে নেই।


✍️ এই নিবন্ধটি Scientific American–এ প্রকাশিত একটি লেখার উপর ভিত্তি করে রচিত, বাংলার পাঠকদের জন্য নতুন করে উপস্থাপিত।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
গবেষকদের যন্ত্রপাতিন্যানোপ্রযুক্তিপদার্থবিদ্যা

অণুজগতে চোখ: স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ (STM)

স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ (STM) কীভাবে পারমাণবিক-স্কেল গবেষণায় বিপ্লব ঘটিয়েছে তা আবিষ্কার করুন।...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.