বর্তমান বিশ্ব এক অভূতপূর্ব শিল্পবিপ্লবের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে – যেখানে প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধের মেলবন্ধন ঘটছে। আধুনিক শিল্পায়নের নতুন পর্যায়, বিশেষ করে চতুর্থ ও পঞ্চম শিল্পবিপ্লব, আমাদের কাজের ধরন, জীবনযাপন ও জাতীয় উন্নয়ন দর্শনে ব্যাপক পরিবর্তন আনছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের বিপুল যুবসমাজের জন্য এটি একই সঙ্গে সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের সময়। তরুণ প্রজন্মকে এখনই প্রস্তুত হতে হবে ভবিষ্যতের কর্মবিশ্বের জন্য, যেখানে ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বয়ংক্রিয়তা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেমন প্রভাব রাখবে, তেমনি টেকসই উন্নয়ন, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মানব-কেন্দ্রিক নকশার প্রতিও জোর দেওয়া হবে।
সম্প্রতি বিজ্ঞানী ডট অর্গ আয়োজিত ইনসাইট আওয়ার এর সেশনের এক আলাপচারিতায় প্রবাসী গবেষক এম.এস. হোসেন বাংলাদেশের শিল্পখাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে মূল্যবান অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। আমেরিকায় বসবাসরত এই থার্মোপ্লাস্টিক ও ন্যানোম্যাটেরিয়াল বিশেষজ্ঞ দেশের সাম্প্রতিক খবরের দিকে চোখ রাখেন এবং দেশের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি কষ্টের সাথে উল্লেখ করেন যে দেশে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা, যেমন তরুণ নেতা ওসমান হাদীর মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর প্রবাসী বাংলাদেশিদের গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। দেশের মেধাবীরা বিদেশে থেকেও দেশের কথা ভাবেন, জ্ঞানের প্ল্যাটফর্ম গড়ে তরুণদের সচেতন করতে চান – যেন এক সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সফল হয়। এই আবেগঘন প্রেরণাই আমাদের আজকের আলোচনার ভিত্তি, যেখানে শিল্পবিপ্লবের ক্রমবিকাশ থেকে শুরু করে প্রযুক্তি-সংস্কৃতির রূপান্তর, পরিবেশ-স্থিতিশীলতা, কর্মসুরক্ষা, এবং শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন – সব বিষয়ের উপরে আলোকপাত করা হবে।
শিল্পবিপ্লবের পথপরিক্রমা: প্রথম থেকে পঞ্চম অধ্যায়
শিল্প ও প্রযুক্তির ইতিহাসে ধারাবাহিক বিপ্লবগুলো মানবসভ্যতার অগ্রগতিকে প্রতিদিন নতুন রূপ দিয়েছে। প্রথম শিল্পবিপ্লবে (Industry 1.0) প্রবর্তিত হয় যন্ত্রচালিত উৎপাদন – বাষ্পশক্তি ও যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন শ্রমের চিরাচরিত ধরণ বদলে দেয়। দ্বিতীয় বিপ্লবে (2.0) বৈদ্যুতিক শক্তি ওassembly line-এর মাধ্যমে ব্যাপকহারে দ্রব্য উৎপাদন সম্ভব হয়, তৈরি হয় গণউৎপাদনের ভিত্তি। তৃতীয় শিল্পবিপ্লব (3.0) নিয়ে আসে কম্পিউটার ও স্বয়ংক্রিয়তার যুগ – ইলেকট্রনিক্স, তথ্যপ্রযুক্তি ও রোবোটিক্সের প্রাথমিক প্রয়োগ শিল্পকারখানায় কাজের গতি ও মান বৃদ্ধি করে।
এরপরে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (Industry 4.0) শুরু হয়, যার মূল চাবিকাঠি হলো ইন্টারনেট, সেন্সর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ে “স্মার্ট ফ্যাক্টরি” গড়ে তোলা। এই পর্বে Internet of Things (IoT) দ্বারা যন্ত্রপাতি ও ডিভাইসগুলো ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত হয়ে রিয়েল-টাইম তথ্য আদানপ্রদান করতে পারে। রোবোটিক্স ও স্বয়ংক্রিয় উৎপাদনব্যবস্থা মানুষের শারীরিক পরিশ্রম কমিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও মেশিন লার্নিং তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তগ্রহণে সহায়তা করছে। ফলস্বরূপ অনেক কারখানা এখন মানুষের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজে থেকেই অনেক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম, যা উৎপাদনকে দ্রুত, সাশ্রয়ী ও অনেক ক্ষেত্রে নিরাপদও করেছে। Industry 4.0-এর প্রযুক্তিগুলো যেমন AI, IoT, বিগ ডাটা ইত্যাদি ইতিমধ্যে শিল্পোন্নত বিশ্বে প্রক্রিয়া-দক্ষতা ৩০% পর্যন্ত বাড়ানোর সম্ভাবনা দেখিয়েছে। তবে একইসঙ্গে এসব প্রযুক্তির প্রসার কিছু উদ্বেগও তৈরি করেছে – বিশেষ করে পরিবেশগত স্থায়িত্ব, চাকরির নিরাপত্তা ও মানবসম্পৃক্ততা নিয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় আসা পঞ্চম শিল্পবিপ্লব (Industry 5.0) চতুর্থ বিপ্লবের ধারাবাহিকতায়ই এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাবিত একটি নতুন শিল্প-দর্শন, যেখানে উৎপাদন ক্ষেত্রের লক্ষ্য কেবল প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও লাভ বাড়ানো নয়, বরং মানবকল্যাণ, পরিবেশগত স্থায়িত্ব ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। সহজ কথায়, শিল্প ৫.০ মানুষ ও মেশিনের পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দেয়। Industry 4.0 যেখানেই পুরো অটোমেশন ও কর্মদক্ষতাকে প্রাধান্য দিয়েছে, Industry 5.0 সেখানে পুনরায় মানুষকে কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে আনছে – এটি নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে প্রযুক্তি মানুষকে প্রতিস্থাপন করার জন্য নয়, বরং সহযোগী হিসেবে কাজ করার জন্য। শিল্প ৫.০-এর বাস্তবতায় কোবট (Collaborative Robot) তথা সহযোগী রোবটের উদ্ভব ঘটেছে, যারা মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে এবং মানবকর্মীর দক্ষতা ও সুরক্ষাকে সমর্থন জোগায়। একইসঙ্গে শ্রমিকের স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় পরিধানযোগ্য এক্সোস্কেলেটন প্রযুক্তি আসছে, যা ভারী কাজের চাপ কমিয়ে চোট-আঘাত কমাতে সহায়তা করছে। শিল্প ৫.০ ধারণা মোটের উপর শিল্পকে একটি টেকসই, মানুষের জন্য অনুকূল এবং স্থিতিশীল ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করতে চায়, যেখানে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা ও মানব-মূল্যবোধ হাত ধরাধরি করে চলবে।
নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও মানব-কেন্দ্রিক নকশা
প্রতিটি শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে কাজের ধরণ পাল্টেছে, তবে পঞ্চম শিল্পবিপ্লব কর্মক্ষেত্রের সুরক্ষা ও মানবিক বিবেচনাকে প্রযুক্তির সমান্তরালে স্থান দিচ্ছে। আধুনিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন “শূন্য দুর্ঘটনা” লক্ষ্য নিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোরদার করছে। IoT-নির্ভর সেন্সর এবং এআই-চালিত মনিটরিং সিস্টেমের সাহায্যে কারখানাগুলো রিয়েল-টাইমে বিপদ শনাক্ত করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারছে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রমিকদের হাতে স্মার্ট ওয়্যারেবল ডিভাইস লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে যা দেহভঙ্গি ও পরিবেশের ডেটা পর্যবেক্ষণ করে; ঝুঁকিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি বা অতিরিক্ত ক্লান্তির লক্ষণ দেখলেই সতর্ক সংকেত দিচ্ছে এবং দুর্ঘটনা ঘটার আগেই পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে। উন্নত কারখানায় এখন এমন প্র্যাক্টিভ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে উঠছে, যেখানে কোনো বিপজ্জনক অঞ্চলেই মানুষ প্রবেশ করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেশিন থেমে যাবে অথবা অ্যালার্ম বাজবে।
মানব-কেন্দ্রিক নকশা বলতে বোঝায়, প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতিকে এমনভাবে ডিজাইন করা যাতে সেগুলো মানবশ্রমিকের জন্য সুবিধাজনক হয় এবং কর্মক্ষেত্রে মানুষ-মেশিনের পারস্পরিক আস্থা গড়ে উঠে। শিল্প ৫.০-এ এই নীতি সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে – রোবটগুলো এখন শ্রমিকের সহযোগী, যারা ক্লান্তিকর কাজগুলো নিজে করে কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক চাপ কমাচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, রোবট ব্যবহারে শ্রম শিল্পে কর্মীদের আহত হওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে এবং উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ যেন সৃজনশীল ও জটিল চিন্তাশীল কাজে আরো বেশি মনোনিবেশ করতে পারে সেজন্য যান্ত্রিক কাজগুলি অটোমেশনের হাতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। তার সাথে উৎপাদনের গুণগত মানও বেড়েছে, কারণ মেশিনের নির্ভুলতা ও মানুষের সৃজনশীলতার মিশ্রণ থেকে উদ্ভাবনী সমাধান বেরিয়ে আসছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা অতীতে বেশ উপেক্ষিত ছিল, যার ফল আমরা মর্মান্তিক শিল্প-দুর্ঘটনাগুলোর মাধ্যমে দেখেছি। এখন দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও ধীরে ধীরে নিরাপত্তা সংস্কৃতি গড়ে তোলার দিকে নজর দিচ্ছে। প্রক্রিয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা (Process Safety Management) বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বাড়ছে এবং বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক সেফটি স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলার প্রতি জোর দেওয়া হচ্ছে। আধুনিক কারখানাগুলোতে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে 5S, লীণ ম্যানুফ্যাকচারিং, এবং সিক্স সিগমা পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা শুরু হয়েছে, যা কর্মস্থলকে শৃঙ্খলাপূর্ণ, পরিচ্ছন্ন ও ঝুঁকিমুক্ত রাখতে সহায়ক। অবশ্যই এসব উদ্যোগের গতি এখনও ধীর, কিন্তু তরুণ প্রজন্মের প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে – তারাই হয়তো আগামী দিনে বাংলাদেশের শিল্পখাতে নিরাপদ ও মানবিক কর্মপরিবেশের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করবে।
পরিবেশগত স্থায়িত্ব: তিন-শূন্য লক্ষ্য ও ESG
প্রযুক্তিগত প্রগতি একইসঙ্গে পরিবেশের উপর বিরাট চাপও তৈরি করছে। পরিবেশ বান্ধব ও টেকসই শিল্পায়ন নিশ্চিত করা আজ বৈশ্বিক অঙ্গীকার, যার বিপরীতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোও পিছিয়ে থাকতে পারে না। বিশ্বব্যাপী Net Zero বা শূন্য নিঃসরণ লক্ষ্য গ্রহণ করা হচ্ছে, অর্থাৎ শিল্প-কলকারখানা থেকে নিঃসৃত মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। বাংলাদেশ সরকারও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ২০৫০ সালের মধ্যে নিট শূন্য কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণের আভাস দিয়েছে। শিল্পক্ষেত্রে কার্বন-ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য বর্জ্য গ্যাস কমাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার, শক্তির দক্ষ ব্যবহার এবং বর্জ্য পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
জনাব হোসেন আলোচনায় থ্রি জিরো নীতি সম্পর্কে বলেন, এই নীতির মূল কথা তিনটি ক্ষেত্রে “শূন্য” অর্জন করা – শূন্য নিঃসরণ, শূন্য দূষণ ও শূন্য অপচয়। তিনি ব্যাখ্যা করেন, শিল্পে যাতে কোনো দূষণকারী নিঃসরণ না ঘটে সেই লক্ষ্যেই গ্রিন কনসেপ্টে কাজ করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি গ্রিন হাইড্রোজেন শক্তির প্রকল্পে নিজের কাজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন, যেখানে সৌরশক্তি ও হাইড্রোজেনের মতো নবায়নযোগ্য উৎস ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে – এতে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর প্রয়োজন নেই, ফলে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা যায়। এ ধরনের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বিশ্বে আগেই শুরু হয়েছে; উন্নত দেশে বিশাল হাইড্রোজেন প্ল্যান্ট ও সৌরফার্ম প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে সৌরবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস, পवनচাপ সহ নানা নবায়নযোগ্য প্রকল্প চলছে, তবে আমাদের প্রয়াস এখনও প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম।
শিল্প খাতে পরিবেশ সচেতনতার আরেকটি দিক হলো কর্পোরেট পর্যায়ে ESG (Environment, Social, Governance) মানদণ্ড অনুসরণ করা। এখন বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগের আগে দেখে সে কোম্পানি পরিবেশকে কতটা রক্ষা করছে, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ কিনা, এবং প্রতিষ্ঠানের পরিচালন-ব্যবস্থাপনা স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক কিনা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর রপ্তানিমুখী কোম্পানিগুলোতেও ক্রেতারা ESG অনুশীলনের ব্যাপারে চাপ দিচ্ছেন। জনাব হোসেনের মতে, বাংলাদেশে ছোট-বড় সব শিল্পকেই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবেশ, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সুশাসনের এই মানদণ্ডে উন্নীত হতে হবে; অন্যথায় তারা ভবিষ্যতে টিকে থাকতে পারবে না। তিনি সতর্ক করেছেন যে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়তো শুরুতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে ভয় পান – মনে করেন ব্যয় সইবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনী ও বাজারের চাপে এটাই টিকে থাকার একমাত্র উপায় হবে। কারখানার যন্ত্রপাতিরও একটি আয়ুষ্কাল থাকে; সময়মত যদি দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি ও আধুনিক যন্ত্রে উন্নতি না করেন, তাহলে পুরনো যন্ত্র নিয়ে বেশিদিন উৎপাদন চালানো সম্ভব হবে না। সুতরাং শিল্পোদ্যোক্তাদের এখন থেকেই টেকসই প্রযুক্তি ও পরিবেশ অনুশীলনে অভ্যস্ত হতে হবে।
প্লাস্টিক দূষণ আমাদের দেশের এক গুরুতর সমস্যা হিসেবে আলোচনায় উঠে আসে। প্লাস্টিক বিশেষত থার্মোপ্লাস্টিকের লাগামহীন ব্যবহার বাংলাদেশে নদী-নালা ও পরিবেশ দূষণের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে পলিথিন ব্যাগের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাস্তবে এর ব্যবহার এখনো সর্বত্র, প্লাস্টিক বোতল-প্যাকেটের রিসাইক্লিং হার খুবই কম। জনাব হোসেন নিজে প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারে গবেষণা করছেন, এ ধরনের নবতর সমাধান খুব প্রয়োজন। আলোচনায় উল্লেখ করা হয় যে বাংলাদেশে প্রতি বছর লাখ লাখ টন ইলেকট্রনিক বর্জ্যও (ই-ওয়েস্ট) সৃষ্টি হচ্ছে নতুন ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর মাত্র ৩% সঠিক পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রিসাইক্লিং হয়, বাকি সব সাধারণ আবর্জনার সঙ্গে মিশে মাটিতে পূঁতিতে চলে যায় বা পরিবেশদূষণ করে। মোবাইল ফোন, কম্পিউটার থেকে শুরু করে রেফ্রিজারেটরের মত যন্ত্রের বিষাক্ত উপাদান মাটির নিচে জমা হচ্ছে, যা ভূগর্ভস্থ পানি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। এ বিপুল পরিমাণ ই-বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারের আওতায় আনা এবং সঠিকভাবে নিষ্পত্তি করার জন্য দেশে পর্যাপ্ত উদ্যোগ ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। সুখের কথা, কিছু স্টার্টআপ ও প্রতিষ্ঠান ই-ওয়েস্ট রিসাইক্লিং শুরু করেছে, তবে এটিকে আরও শিল্পায়িত ও বিস্তৃত করতে হবে।
টেকসই শিল্পায়নের পথে প্রযুক্তিগতভাবেও নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে। যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক প্রয়োগের ফলে বিশ্বজুড়ে ডেটা সেন্টার নির্মাণ দ্রুত বাড়ছে, যা বিরাট বিদ্যুৎ ব্যয় ও তাপ উৎপন্ন করছে। এই ডেটা সেন্টারগুলোর জন্য বিশাল শীতলীকরণ ব্যবস্থা চালাতে আবার প্রচুর জ্বালানি লাগে, ফলে কার্বন নিঃসরণও বৃদ্ধি পায়। একদিকে AI আমাদের সমস্যার সমাধান দিচ্ছে, অন্যদিকে তা পরিবেশের ওপর নতুন চাপ তৈরি করছে। এ সমস্যার সমাধানে বিজ্ঞানীরা গ্রিন কম্পিউটিং বা নবায়নযোগ্য শক্তিচালিত ডেটা সেন্টারের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। বাংলাদেশেও এখন সময় এসেছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার, শক্তি-দক্ষ সরঞ্জাম ও স্মার্ট কুলিং প্রযুক্তির বিস্তার ঘটানোর, যেন ডিজিটাল অগ্রগতি পরিবেশের প্রতি বৈরী হয়ে না দাঁড়ায়।
সামগ্রিকভাবে বলা যায়, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে শিল্পক্ষেত্রে তিন-শূন্য লক্ষ্য প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। তিন-শূন্য লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সরকার, শিল্পোদ্যোক্তা ও সমাজ – সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। তরুণ প্রজন্মকেও পরিবেশ রক্ষায় উদ্ভাবনী উদ্যোগ নিতে হবে। প্লাস্টিকের বিকল্প উদ্ভাবন, নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার, ও বর্জ্য থেকে পণ্য তৈরির নতুন প্রযুক্তি উন্নয়নে তরুণ বিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তাদের মেধা লাগবে। সুখের বিষয়, দেশে অনেক স্টার্টআপ এখন রিসাইক্লিং, সবুজ জ্বালানি ও পরিবেশবান্ধব ব্যবসায় এগিয়ে আসছে। তরুণদের এমন উদ্যোগই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের শিল্পায়নকে একটি গ্রিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন-এর পথে নিয়ে যাবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ
নতুন প্রযুক্তির সুবিধা অনেক, কিন্তু বাংলাদেশে Industry 4.0 ও 5.0-এর পথচলা মসৃণ নয়। এই পরিবর্তন গ্রহণে বহু কাঠখড় পোড়াতে হবে এবং নানা প্রাতিষ্ঠানিক-সামাজিক বাধা অতিক্রম করতে হবে। একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমাদের অবকাঠামোগত দুর্বলতা – উচ্চগতির ইন্টারনেট, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা। অধিকাংশ কারখানায় এখনো পুরনো যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হচ্ছে; স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি আনতে অপারাগl বিদ্যুৎ সরবরাহ ও মেশিন রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে বাংলাদেশে Industry 4.0 বাস্তবায়নে পাঁচটি মূল বাধা বর্তমানে লক্ষণীয় – দুর্বল অবকাঠামো, সস্তা শ্রমের প্রাচুর্য, প্রযুক্তি স্থাপনে উচ্চ ব্যয়, সরকারী সহযোগিতার অভাব, এবং জ্ঞানের অভাব। সত্যিই, সস্তা শ্রমশক্তি এতদিন আমাদের প্রতিযোগিতাক্ষমতার প্রধান ভিত্তি ছিল – ফলে প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিনিয়োগে অনেকের আগ্রহ কম। যখন স্বল্প মজুরিতে মানবশক্তি পাওয়া যায়, তখন অনেক উদ্যোক্তার কাছে রোবট বসানো বিলাসিতা মনে হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শ্রম সস্তা হলেও আমাদের উৎপাদন মান ও পরিমাণ উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে, যা প্রযুক্তি ছাড়া মেটানো যাবে না। উপরন্তু, বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে মানের বিষয়ে কোন আপস চলে না – সস্তা শ্রমনির্ভর পদ্ধতিতে পণ্যের মান ও প্রক্রিয়ার পরিবেশসম্মততা নিশ্চিত করা কঠিন।
আরেকটি বড় বাধা আমাদের মানসিকতা। নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের আগেই আমরা পরিবর্তনকে ভয় পাই এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলি – এই মানসিকতা থেকে বের হতে হবে। অনেক কারখানার মালিক-ব্যবস্থাপক এখনো “যা চলছে ঠিক চলছে, নতুন ঝামেলায় কী লাভ” ভেবে ডিজিটাল রূপান্তর এড়িয়ে যেতে চান। জনাব হোসেন বলেন, কোম্পানির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যে কোনো পরিবর্তন আসার আগে সেটাকে না বলতে চাওয়ার প্রবণতা; বরং প্রগতিশীল মনোভাব নিয়ে পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে হবে। পরিবর্তন যে এড়ানো যাবে না, তা সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট। বিদেশি ক্রেতারা এখন বাংলাদেশি গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে ডিজিটাল কম্পলাইঅন্স সিস্টেম, শ্রমিক নিরাপত্তা ও পরিবেশমান যাচাই করছেন – যেসব কারখানা এসব মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে তারা ক্রমেই অর্ডার হারাচ্ছে। অতএব, এগিয়ে আসতে হবে এবং নতুন প্রযুক্তি ও ধারণাগুলোকে আত্মস্থ করতে হবে।
শ্রমিক ও ব্যবস্থাপকদের দক্ষতার অভাবও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মেশিন ও সফটওয়্যার চালাতে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কারিগরি দক্ষ জনবল প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে এখনও পর্যাপ্ত তৈরি হয়নি। বহু কর্মী এখনো কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র চালনায় অভ্যস্ত নন, ইংরেজি ও ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাবও আছে। আবার ব্যবস্থাপক পর্যায়ে অনেকেই ডেটা-বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জ্ঞান বা IoT-সক্ষম প্রোডাকশন মডেল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। এ অবস্থায় কোম্পানিগুলো যদি বিনিয়োগ করেও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করে, তা সচল রাখতে এবং সর্বোচ্চ কার্যকারিতা পেতে দক্ষ অপারেটর ও ইঞ্জিনিয়ার দরকার হবে। এই স্কিল গ্যাপ বা দক্ষতা-শূন্যস্থান দ্রুত পূরণ করতে না পারলে প্রযুক্তি বসিয়েও লাভ হবে না।
সরকারের নীতিগত সহায়তা ও দূরদর্শিতা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদ্ভাবনী প্রযুক্তি আমদানি ও উৎপাদনে শুল্ক-কর রেয়াত দেওয়া, রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্টে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে উদ্দীপনা প্রদান, এবং শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তি-ভিত্তিক শিক্ষাক্রমের সংযোজন – এসব ক্ষেত্রে সরকারকে নেতৃত্ব দিতে হবে। ইতিমধ্যে সরকার “স্মার্ট বাংলাদেশ” ভিশন ঘোষণা করেছে যা ডিজিটাল অবকাঠামো ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির কথা বলে। এ উদ্দেশ্য সফল করতে হলে নীতিগত স্তর থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে যথেষ্ট কাজ করতে হবে।
জনাব হোসেন আলোচনায় ছোট ছোট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসঙ্গও তোলেন, যারা পরিবেশবান্ধব আধুনিক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে আর্থিক ও কারিগরি বেশি সমস্যায় পড়ে। তাদের পুঁজি সংকট বা বিনিয়োগ ফেরত পাওয়া নিয়ে আশঙ্কা থাকে বলে তারা নতুন যন্ত্রপাতিতে টাকা ঢালতে ভয় পায়। সরকার ও বড় প্রতিষ্ঠানগুলো মেন্টরশিপ ও সহযোগিতার মাধ্যমে এসএমইগুলোকে এই রূপান্তরে সাহায্য করতে পারে। বিশেষ অর্থ তহবিল বা সহজ ঋণের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে, যেন পরিবেশ ও প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ করতে উদ্দীপনা পায়। একই সাথে বড় শিল্পে স্থানীয়ভাবে যেসব যন্ত্রাংশ বা সফটওয়্যার দরকার, সেগুলোর উৎপাদনে দেশীয় স্টার্টআপগুলোকে উৎসাহিত করতে পারলে আমদানি নির্ভরতা কমবে এবং দেশের মধ্যে একটি প্রযুক্তিগত ইকোসিস্টেম গড়ে উঠবে।
দক্ষতা উন্নয়ন ও তারুণ্যের করণীয়
শিল্পের এই বিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে দক্ষতা উন্নয়ন ও মানসিকতার পরিবর্তন অতি জরুরি পদক্ষেপ। শুধু বর্তমান কর্মীবাহিনীকেই নয়, আগামী দিনের কর্মী – আজকের শিক্ষার্থী তরুণদেরও প্রস্তুত করতে হবে নতুন বাস্তবতার জন্য। আমাদের বিদ্যমান কর্মীরা যারা বছরের পর বছর একভাবে কাজ করে আসছেন, তাদের reskill ও upskill করতে হবে – অর্থাৎ নতুন করে প্রশিক্ষণ দিয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি চালানো, কম্পিউটার ও ডেটা বিশ্লেষণ, এবং নিরাপত্তা ও মানের নতুন স্ট্যান্ডার্ডগুলো শেখাতে হবে। একইসাথে নতুন প্রজন্মের কাছে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সফটস্কিল ও টেকনিক্যাল স্কিল অর্জনের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।
জনাব হোসেন তাঁর অভিজ্ঞতায় বলেছেন, অনেক সময়ই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা তরুণরা যখন সরাসরি কোনো শিল্পকারখানায় কাজে যোগ দেয়, তারা সেই প্রতিষ্ঠানের চলমান ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যান্ডার্ডগুলোর কথা বলতে পারে না বা সেসব মানদণ্ড সম্পর্কে ধারণাই রাখে না। ফলে বাস্তব কর্মক্ষেত্রে গিয়ে হোঁচট খায়, নিজের জ্ঞান ঠিকভাবে প্রয়োগ বা উপস্থাপন করতে পারে না। এই পরিস্থিতি এড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই কিছু প্রযুক্তিগত সার্টিফিকেশন ও ট্রেনিং নিয়ে রাখা খুবই উপকারী। যেমন, যে শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে কোনো প্রসেস ইন্ডাস্ট্রিতে ক্যারিয়ার চায় সে মূল পড়াশোনার পাশাপাশি প্রসেস সেফটি ম্যানেজমেন্ট (PSM)-এর উপর একটি কোর্স বা সার্টিফিকেশন করে রাখতে পারে। যিনি বিদ্যুৎ প্রকৌশলী, তিনি এনএফপিএ ৭০ (বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা বিধি) বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। একইভাবে ফাংশনাল সেফটি বা কুইন সিক্স সিগমা প্রভৃতি বিষয়ে ছোটখাট কোর্স করা থাকলে কর্মক্ষেত্রে ওইসব মানদণ্ড মেনে কাজ করতে সুবিধা হবে। এসব অতিরিক্ত দক্ষতা ও মানের সার্টিফিকেট যখন একটা তরুণ প্রফেশনাল দেখাতে পারবে, তখন চাকরিদাতার সামনে নিজেকে আরো আত্মবিশ্বাস ও প্রমাণসহ উপস্থাপন করতে পারবে। সংক্ষেপে, ডিগ্রির সঙ্গে দক্ষতা-সনদ যোগ হলে প্রতিযোগিতামূলক চাকরিবাজারে তিনি এগিয়ে থাকবে।
শুধু সার্টিফিকেট নয়, হ্যান্ডস-অন অভিজ্ঞতা বা practically কাজ শেখার উপরও জোর দিতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিল্প-সংযোগ বৃদ্ধি করা দরকার যাতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি বাস্তব প্রকল্প ও ইন্টার্নশিপে অংশ নিতে পারে। টেক্সটাইল, আইটি, ইলেকট্রনিক্স এমন বহু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা যদি শেষ বর্ষের_PROJECT প্ল্যান্টগুলোতে কিছু সময় কাজ করে আসতে পারে তবে তাদের বাস্তব জ্ঞান অনেক বাড়বে। শিল্পকারখানাগুলোও নিজ উদ্যোগে ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম চালু করতে পারে – এতে তারাও পরবর্তী কর্মী বাছাইয়ের সুযোগ পাবে।
তরুণদেরকে আজীবন শেখার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। প্রযুক্তি এখন এমন এক জিনিস যেখানে হয়ত এক-দুই বছরের মধ্যেই আপনার শিখনো দক্ষতা পুরনো হয়ে যেতে পারে, আসবে নতুন ভার্সন বা নতুন পদ্ধতি। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাস শেষ কথা নয় – নিজে থেকে নতুন জিনিস শিখতে হবে নিয়মিত। অনলাইন কোর্স, মুক্ত জ্ঞানভাণ্ডার, ওউপেন সোর্স প্রকল্পে অবদান রাখার মাধ্যমে একজন ছাত্র বা তরুণ পেশাজীবী নিজের জ্ঞানকে আপটুডেট রাখতে পারে। আজকাল ইন্টারনেটে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সও উন্মুক্ত থাকে, ইউটিউবে অসংখ্য টিউটোরিয়াল, কোডিং চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি সহজলভ্য – এই বিপুল রিসোর্সকে কাজে লাগাতে হবে। নিজের শেখার উৎসাহ ধরে রাখতে ছোট ছোট টার্গেট সেট করুন, নতুন কোনো সফটওয়্যার বা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ বা মেশিন পরিচালনা শিখলে নিজেকে পুরস্কৃত করুন। এভাবে শেখার আগ্রহ বজায় রাখতে পারলে, ভবিষ্যতের যে কোনো প্রযুক্তিগত পরিবর্তনেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে সহজ হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, নতুন প্রজন্মকে মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। চাকরি মানেই আটটা-পাঁচটা রুটিন কাজ করে যাওয়া – এই ধারণা বদলাতে হবে। পরিবর্তে, প্রতিটি কাজে উদ্ভাবনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি আনা, সমস্যা দেখলে সমাধানের উপায় খোঁজা এবং দায়িত্ব নেওয়ার মনোভাব থাকতে হবে। যেকোনো প্রযুক্তি বা প্রবণতা শুরুতে কঠিন লাগতে পারে, কিন্তু শেখার সাহস ও উদ্যম থাকলে তা আয়ত্তে আসবেই। শিক্ষক, সিনিয়র ও বিশেষজ্ঞদের সাথে নেটওয়ার্ক তৈরি করে পরামর্শ নেওয়া, পেশাগত ইভেন্ট ও সেমিনারে গিয়ে জানা – এসবের মাধ্যমে তরুণরা দ্রুত নিজেদের বিকাশ করতে পারবে। দেশে এখন বিভিন্ন হ্যাকাথন, মেকাথন প্রতিযোগিতা হচ্ছে; এগুলোতেও অংশ নিয়ে বাস্তব সমস্যার প্রযুক্তিগত সমাধান করার অভ্যাস গড়তে পারে আমাদের শিক্ষার্থীরা।
জনাব হোসেন নিজে ও তাঁর পরিচিত বেশ ক’জন উদাহরণ দিয়েছেন, যাঁরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা বা গবেষণা করে এরপর দেশে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাক্ষেত্রে অবদান রাখছেন। এই মেধাবী প্রবাসী বাঙালিরা বিদেশে থেকেও দেশের সাথে সংযুক্ত থেকে কিছু না কিছু কাজ করছেন – কেউ গবেষণায় জ্ঞান বিনিময় করছেন, কেউ বিনিয়োগ বা পরামর্শ দিচ্ছেন, আবার কেউ সরাসরি দেশে ফিরে শিক্ষকতা ও গবেষণার ল্যাব গড়ে তুলেছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের অ্যাকাডেমিয়া ও ইন্ডাস্ট্রির মাঝের ব্যবধান কমবে। দেশে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ তৈরিতে তরুণ প্রজন্মকেই এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের উচিত প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের দেশে কাজের সুযোগ করে দেওয়া এবং মস্তিষ্কের “ব্রেন গেইন” বাড়ানো।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে সৃজনশীলতা ও মনোযোগ
তরুণদের ভবিষ্যৎ কর্মজগতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এক বিরাট প্রভাবক শক্তি হিসেবে থাকবে – ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ভাবেই। একদিকে AI এবং স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম অনেক কঠিন সমস্যার সমাধান দ্রুততর করছে, মানুষের সময় ও শ্রম সাশ্রয় হচ্ছে; অন্যদিকে এই প্রযুক্তির অতি-নির্ভরশীলতা যদি তৈরি হয়, তবে আমাদের সৃজনশীলতা ও মনোনিবেশ ক্ষমতা হ্রাসের ঝুঁকিও রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, AI যত বুদ্ধিমান ও “সহায়ক” হয়ে উঠছে, ততই এটি মানুষের মনোযোগকে দুর্বলও করে দিতে পারে – কেননা AI আমাদের হয়ে অনেক চিন্তা ও কাজ এগিয়ে দিলে আমরা নিজেরা চিন্তা-প্রক্রিয়া অনুশীলন কম করি। বিশেষ করে যারা খুব অল্প বয়সেই জেনারেটিভ এআই-এর ওপর ভরসা করে কাজ করা শুরু করবে, তাদের মৌলিক চিন্তা এবং সমস্যার গোড়া থেকে সমাধান খোঁজার দক্ষতা গড়ে না ওঠার শঙ্কা আছে। এমনকি ইমেইল লেখা, প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বা আইডিয়া জেনারেশনের মত কাজে যদি সম্পূর্ণ AI ভরসা করে শুরু থেকেই অভ্যস্ত হয়ে যায় কেউ, তবে ভবিষ্যতে জটিল ও অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সে নিজ সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খেতে পারে।
তবে এর মানে এই নয় যে AI আসায় মানুষের সৃজনশীলতার যুগ শেষ। বরং AI-কে আমরা একে সহকারী যন্ত্র হিসেবে দেখাতে পারি, যা কঠিন পরিশ্রমের কাজগুলো সহজ করে দিয়ে আমাদের মেধাকে মুক্ত করবে আরো উচ্চস্তরের সৃজনশীলতায় সময় দিতে। উদাহরণস্বরূপ, AI এখন ডেটা ঘেটে প্যাটার্ন বের করে দিতে পারে, যা দেখে গবেষক নতুন হাইপোথিসিস দাঁড় করাতে পারেন। আবার AI বড় বড় তথ্যভাণ্ডার থেকে দরকারী তথ্যগুলো ছেঁকে দিয়ে আমাদের “বড় ছবি” দেখতে সাহায্য করতে পারে। এসব কাজে AI আমাদের “ক্রিয়েটিভ ক্যাটালিস্ট” হতে পারে, অর্থাৎ উদ্ভাবনের প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করতে পারে। কিন্তু চূড়ান্ত সৃজনশীল সিদ্ধান্ত এবং নতুন মৌলিক আইডিয়া বের করার কাজটি এখনো মানুষের মস্তিষ্ককেই করতে হবে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মতামত হলো – AI নিজে থেকে একেবারে নতুন ধারণা তৈরি করতে পারে না, তবে মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে অনুঘটক হিসেবে ত্বরান্বিত করতে পারে।
জনাব হোসেন আলাপচারিতায় এক তরুণের মনোযোগ হারিয়ে ফেলার সমস্যার প্রশ্নের জবাবে বলেন, মানসিক উদ্বেগ, স্ট্রেস এবং অতিরিক্ত তথ্যের চাপে আমাদের মনোযোগ ধীরে ধীরে কমে যেতে পারে। এক্ষেত্রে নিজের মোটিভেশন বা প্রেরণা ধরে রাখতে ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ, নতুন কিছু শেখার মাধ্যমে উদ্দীপনা ফিরে পাওয়া এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয় থেকে দূরে থেকে কাজের মধ্যেই সার্থকতা খোঁজার পরামর্শ দেন তিনি। আসলে ডিজিটাল যুগে অগণিত নোটিফিকেশন, সোশ্যাল মিডিয়ার স্ক্রল – এসবই মনঃসংযোগের শত্রু। AI চলেও যদি আমাদের হয়ে অনেক কাজ করে দেয়, মানবিক সৃষ্টিশীলতার জন্য নিরিবিলি চিন্তার সময় ও গভীর মনোনিবেশের জায়গা কোন বিকল্প প্রযুক্তি দিতে পারবে না। তাই তরুণদের ডিজিটাল ডিটক্স বা প্রযুক্তি থেকে মাঝে মাঝে বিরতি নেওয়া, নির্জন চর্চা (deep work) এবং ধ্যান/যোগব্যায়ামের মাধ্যমে মন শান্ত রেখে দীর্ঘসময় মনোযোগ ধরে রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।
সৃজনশীল পেশায় যেমন লেখালেখি, ডিজাইন, গবেষণা – AI যেন আমাদের সহায়ক হয় কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ককে নিষ্ক্রিয় না করে ফেলে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, AI দ্বারা একটি প্রবন্ধের খসড়া তৈরি করা গেলেও তাতে নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণ যোগ করে সত্যিকারের মানসম্মত লেখনী দাঁড় করাতে হবে – এটাই হবে AI ব্যবহারের সুফল। বিপরীতে, যারা সম্পূর্ণ নির্ভর হয়ে শুধু AI দিয়ে কাজ সারতে চাইবে, তারা হয়তো বড় কোনো নতুন সমস্যা সমাধানে পিছিয়ে পড়বে, কারণ তাদের নিজের সমস্যামোচন সক্ষমতা (problem-solving skill) অনুশীলন হয়নি পর্যাপ্ত। সুতরাং, AI-কে ভয় না পেয়ে এটিকে দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করা শিখতে হবে। সঠিক প্রশ্ন করার কৌশল, AI থেকে প্রাপ্ত উত্তরের সত্যতা যাচাই এবং AI-এর সাহায্যে নতুন কিছুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা – এদিকগুলোতে দক্ষতা অর্জনই ভবিষ্যতের কর্মীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
উচ্চশিক্ষা ও বিদেশযাত্রা: তরুণদের জন্য নির্দেশনা
বাংলাদেশের অনেক মেধাবী তরুণ-তরুণীর উচ্চাশা থাকে বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের, বিশেষত বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নানা শাখায় গবেষণা করতে বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে তারা। সর্বাধিক গন্তব্য হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তবে বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রক্রিয়াটি বহু ধাপের এবং সঠিকভাবে প্রস্তুতি না নিলে ভিসা পাওয়া থেকে শুরু করে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত নানা প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্রভিসা পাওয়া আগের তুলনায় কিছু কঠিন হয়েছে বলে শোনা যায়। জনাব হোসেনের পরামর্শ অনুযায়ী, যে সব শিক্ষার্থী আমেরিকায় পড়তে যেতে ইচ্ছুক তাদেরকে প্রস্তুতিটা অনেক গভীর থেকে শুরু করতে হবে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, শুধু ভালো IELTS স্কোর করলেই চলবে না – বরং যদি গবেষণার ইচ্ছা থাকে তবে আগেভাগেই সম্ভাব্য সুপারভাইজার প্রফেসরের সাথে যোগাযোগ করে নিজের আগ্রহ প্রকাশ ও রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ (RA) বা টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ (TA) জোগাড়ের চেষ্টা করতে হবে। যেসব শিক্ষার্থী বাংলাদেশ থেকেই কোনো প্রফেসরের ল্যাবে কাজের অফার এবং সেইসঙ্গে পর্যাপ্ত অর্থায়ন (স্কলারশিপ/ফান্ডিং) নিশ্চিত করতে পারে, তাদের ভিসা পাওয়ার সুযোগ অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া TOEFL/IELTS, GRE/GMAT পরীক্ষাগুলোতে ভালো স্কোর (গড়ে তুলনামূলক উচ্চমাত্রার) রাখতে হবে – এই সবগুলো মিলিয়ে আপনার একাডেমিক প্রোফাইল যত শক্তিশালী হবে, ভিসা অফিসার ততই আশ্বস্ত হবেন যে আপনি সত্যিই গুণগত শিক্ষা ও গবেষণার উদ্দেশ্যেই যাচ্ছেন।
ভিসা ইন্টারভিউর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো আপনার অভিপ্রায় পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা – আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে উচ্চশিক্ষা শেষ করে আপনি দেশে ফিরবেন বা আপনার পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত। যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন আইন অনুযায়ী, প্রত্যেক নন-ইমিগ্রান্ট ভিসা আবেদনকারীকেই প্রথমে সন্দেহভাজন অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করা হয়; আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনি অস্থায়ী ভিত্তিতে যাচ্ছেন এবং পড়াশোনা শেষে নিজ দেশে ফিরে আসবেন। কাজেই ইন্টারভিউতে আপনার পারিবারিক বন্ধন, দেশে আপনার সম্পত্তি/দায়িত্ব কিংবা দেশে ফিরে কী ক্যারিয়ার পরিকল্পনা আছে সেসব বিষয়ে জোর দিয়ে বলতে হবে। অনেক সময়ে প্রার্থীরা পর্যাপ্ত অর্থের প্রমাণপত্র দেখাতে না পারা বা নথিপত্রে অসঙ্গতি থাকার কারণে ২১৪(b) ধারা অনুসারে ভিসা প্রত্যাখ্যানের শিকার হন। এটা এড়াতে ব্যাংক স্টেটমেন্ট, স্পনসর লেটার ইত্যাদি যথাযথ থাকা চাই। কোনো তথ্য লুকানো বা ভুল উপস্থাপন করলে তা বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি করতে পারে, যা আরেকটি সাধারণ প্রত্যাখ্যানের কারণ। তাই আপানার অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম থেকে শুরু করে ইন্টারভিউ – সর্বত্র সত্য ও পরিষ্কার উত্তর দিন।
জনাব হোসেন আক্ষেপ করে একটি ব্যাপারও উল্লেখ করেছেন – আমরা বাংলাদেশিরা বিদেশে গিয়ে অনেক সময় সে দেশের নিয়মকানুন মানি না, বেআইনি কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ি বা ভিসার শর্তভঙ্গ করি; এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হচ্ছে। ভিসা অফিসাররাও বাংলাদেশি আবেদনকারীদের অতীতে কারো কারো খারাপ রেকর্ড দেখে সন্দেহের চোখে দেখতে পারেন। কাজেই যারা বিদেশে পড়তে বা থাকতে যান তাদের অবশ্যই ভিনদেশের আইন, নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে – কখনো অবৈধ কাজ করার চেষ্টা করা যাবে না, পড়াশোনার উদ্দেশ্যকে সমনে রেখে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনার আচরণ শুধু ব্যক্তিগত নয়, দেশের ভাবমূর্তিও বহন করে। আপনার সাফল্য ও সৎচরিত্র বিদেশে বাংলাদেশের জন্য সুনাম বয়ে আনবে এবং ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থী-প্রবাসীদের পথ সুগম করবে।
বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আরেকটি বাস্তব বিষয় হলো প্রত্যাশা ও বাস্তবতার ফারাক বুঝে নেওয়া। অনেক শিক্ষার্থীই ভেবে বসে বিদেশে গেলেই সব সমস্যা শেষ – কিন্তু আসলে সেখানেও কঠোর পরিশ্রম, প্রতিযোগিতা এবং নানা সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের প্রয়োজন পড়বে। শুরুতে ভাষা বা উচ্চারণগত সমস্যা হতে পারে, পড়াশোনার পদ্ধতিতে পার্থক্য থাকবে, একাকীত্বও অনুভব হতে পারে। এসব মোকাবিলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। সেখানে পৌঁছে সিনিয়র বাংলাদেশি ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্র অফিসের সহায়তা নিন। যারা নতুন দেশে যাবেন তাদের প্রতি জনাব হোসেনের উপদেশ – নম্রতা ও শেখার মানসিকতা বজায় রাখুন। নিজেকে সবসময় উদ্যমী ও অনুগত ছাত্র হিসাবে উপস্থাপন করলে বিদেশের শিক্ষকরাও আপনাকে পছন্দ করবেন এবং সুযোগ দেবেন। আর অবশ্যই নিজের দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন; পরিবার, বন্ধুবান্ধবের সংস্পর্শে থাকলে মানসিক চাপ কমবে।
পরবর্তী সময়ে বিদেশে ডিগ্রি শেষ করে দেশে ফিরবেন নাকি বিদেশেই ক্যারিয়ার গড়বেন – এই দ্বন্দ্বটি আসে। প্রত্যেকের পরিস্থিতি ভিন্ন, তবে দেশ বর্তমানে ভালো দক্ষ জনশক্তির জন্য অপেক্ষা করছে। জনাব হোসেনের মত অনেকেই মনে করেন, আমাদের জাতির উন্নয়নে মেধাবীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং Brain Drain না হয়ে Brain Gain ঘটানো উচিত। আপনি বিদেশে থেকে গেলেও দেশে জ্ঞান-অর্থ পাঠিয়ে অবদান রাখতে পারেন, আর দেশে ফিরলে তো সরাসরি কাজ করা যাবে। দিন শেষে, সিদ্ধান্ত যার যার – কিন্তু দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা মনে রেখে সিদ্ধান্ত নিলে তাতে আত্মতৃপ্তি বেশি থাকবে। প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদদের প্রতি দেশবাসীরও কিছু প্রত্যাশা থাকে; যেমন দেশে বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিনিময়। অনেক প্রবাসী ইতোমধ্যে বিভিন্ন সেমিনার, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের তারুণ্যকে গাইড করছেন, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এই সংযোগ আরও বাড়াতে হবে।
এম.এস. হোসেন এর সম্পূর্ণ Insight Hour এ তার বক্তব্যটি পুরোটা দেখুন: 👇👇👇
উপসংহার: আগামীর পথে বাংলাদেশ
চতুর্থ ও পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের মিশ্র বাস্তবতা আমাদের সামনে এক বৃহৎ canvas খুলে দিয়েছে – যেখানে একদিকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, স্বয়ংক্রিয়তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা; অন্যদিকে মানবকল্যাণ, সামাজিক ন্যায়বিচার ও পরিবেশ রক্ষা – সবকিছুকে একসাথে সামঞ্জস্য করতে হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ এই পথচলায় পিছিয়ে থাকলেও, আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হল আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠী। সঠিক দিকনির্দেশনা ও সুযোগ পেলে তারাই পারে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে একটি উদ্ভাবনী, টেকসই ও সমৃদ্ধ দেশে রূপ দিতে।
এম.এস. হোসেনের কথায় ফুটে উঠেছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশের প্রতি টান এবং দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার তীব্র ইচ্ছা। দেশ-বিদেশের সেরা মেধাবীরা যদি একসাথে কাজ করে – কেউ সরাসরি দেশে থেকে, কেউ দূর থেকে জ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়ে – তবে আমাদের শিল্পখাতের রূপান্তর ত্বরান্বিত হবে। নতুন শিল্পবিপ্লবের সুবিধাগুলো কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশও একদিন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল ঘরে তুলতে পারবে এবং পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের মানবিক আদর্শ বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে। অবশ্যই, পথে বাধা রয়েছে অনেক – প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক – কিন্তু সদিচ্ছা ও দূরদর্শিতা থাকলে এ বাধা অতিক্রম অসম্ভব নয়।
এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন একটি জাতীয় মানসিকতার পরিবর্তন – যেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, গবেষণা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা হবে, এবং একই সঙ্গে সুশাসন ও ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজ গঠনের অঙ্গীকার থাকবে। আমাদের শিল্পকারখানাগুলোকে লাভের পাশাপাশি পরিবেশ ও সামাজিক মূল্যকে গুরুত্ব দিতে হবে; সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রতিটি সিদ্ধান্তে টেকসই উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রাখতে হবে। তরুণদের শেখার সুযোগ, কাজের সুযোগ ও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে।
সবচেয়ে বড় বিষয়, আত্মবিশ্বাস ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোতে হবে। জনাব হোসেন যথার্থই বলেছেন যে আমরা সবাই আশাবাদী – ইনশাআল্লাহ আমরা আমাদের লক্ষ্যে সফল হবো। বাংলাদেশের তারুণ্য যদি বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জ্ঞান নিজের করে নেয়, শ্রম ও মেধা দিয়ে দেশের জন্য কিছু করতে চায়, তাহলে চতুর্থ ও পঞ্চম শিল্পবিপ্লবকে বিচ্ছিন্ন কোনো তত্ত্ব হিসেবে নয়, বরং বাংলাদেশের উন্নয়নের পথিকৃৎ হিসেবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। প্রযুক্তি ও মানবিকতা একসূত্রে গাঁথা একটি আধুনিক, সবুজ এবং দুর্বার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এ যাত্রায় পথ কঠিন হতে পারে, কিন্তু দিকনির্দেশনা স্পষ্ট: নতুন যুগের জ্ঞান অর্জন কর, উদ্ভাবন কর, এবং দেশ ও পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে একসাথে কাজ কর। তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হবে – যেখানে শিল্পায়ন ও মানবিক মূল্যবোধের জয় একসূত্রে হবে।
অনুষ্ঠানটিতে উপস্থাপক ছিলেন বিজ্ঞানী অর্গ এর ভলেন্টিয়ার তাহসিন আহমেদ সুপ্তি। অনুষ্ঠানটি ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ এ অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। সার্বিকভাবে অনুষ্ঠানটি সমন্বয় করার জন্য বিজ্ঞানী অর্গ এর পক্ষ থেকে মহিউদ্দিন কে বিশেষভাবে ধন্যবাদ।

Leave a comment