নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
📧 [email protected]
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় অনেকেই মনে করে, “জিপিএটাই সবকিছু না!” কথাটা কিছুটা ঠিক, কিন্তু একেবারেই ভুল নয়। কারণ, গবেষণা আর বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে—ভালো জিপিএ থাকলে জীবনের বহু দরজা খুলে যায়। স্কলারশিপ থেকে শুরু করে চাকরির ইন্টারভিউ, হায়ার স্টাডি থেকে শুরু করে নিজের আত্মবিশ্বাস—সবখানে জিপিএয়ের প্রভাব রয়েছে। চলুন দেখে নেওয়া যাক, কোন কোন ক্ষেত্রে জিপিএ বড় ভূমিকা রাখে।
১. নিয়োগকারীদের চোখে জিপিএ
অনেক কোম্পানি বললেও যে তারা জিপিএ দেখে না, বাস্তবতা একটু ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের National Association of Colleges and Employers (NACE) এর এক জরিপ বলছে—নতুন গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে ৪৬.৩% নিয়োগদাতা এখনো জিপিএ দেখে। যদিও ২০১৯ সালে এই হার ছিল ৭৩.৩%, এখন কমে এলেও প্রভাব একেবারে হারায়নি।
বিশেষ করে যারা ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট, তাদের ক্ষেত্রে জিপিএ একটি বড় সূচক—কেননা তখন কাজের অভিজ্ঞতা কম থাকে। ৩.০ এর নিচে জিপিএ হলে অনেক নিয়োগকারী নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে।
২. স্কলারশিপ ও টিউশন ফি ছাড়
Dean’s List—এমন একটি সম্মানজনক তালিকা যেখানে শুধু ভালো জিপিএধারীরা সুযোগ পায়। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক সময় ৩.৭৫ বা তার বেশি জিপিএ ধরে রাখতে পারলে ৫০–৭৫% পর্যন্ত টিউশন ফি মাফ পাওয়া যায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে ৩.৯ এর ওপরে থাকলে ১০০% স্কলারশিপও মেলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের অনেক প্রতিষ্ঠান যেমন—ব্র্যাক, ড্যাফোডিল ফাউন্ডেশন, ইউনিসেফ প্রভৃতি সংস্থা বিভিন্ন স্কলারশিপ দেয়, সেখানে আবেদন করার সময় GPA একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হিসেবে দেখা হয়।
৩. উচ্চশিক্ষা ও পিএইচডি’র পথে জিপিএ
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপে হায়ার স্টাডির জন্য জিপিএ একটি মূল যোগ্যতা। এক গবেষণায় দেখা গেছে—
- ৩.৫ GPA এর শিক্ষার্থীদের হায়ার স্টাডিতে ফান্ডসহ অ্যাডমিশনের সম্ভাবনা প্রায় ৩০%
- ৩.৮ GPA এর শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা প্রায় ৬৬%
অর্থাৎ GPA বাড়লে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, স্কলারশিপ, গবেষণা তহবিল ও TA/RA পাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ে।
৪. প্রথম চাকরির বেতন এবং জিপিএ
Zou et al. (2022) এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের GPA ভালো, তাদের স্টার্টিং স্যালারি তুলনামূলকভাবে বেশি। তারা দেখতে পায়, GPA গ্যাপ অনুযায়ী স্যালারির গড় পার্থক্য হতে পারে ২৯.৬% পর্যন্ত।
Journal of Applied Psychology–এর আরেকটি গবেষণায় বলা হয়, উচ্চ GPA পাওয়া শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষতা ও সুপারভাইজারদের রেটিং—উভয়ই তুলনামূলকভাবে ভালো হয়। কোরিলেশন রেট ছিল প্রায় r ≈ 0.30, যা একটি মাঝারি পজিটিভ সম্পর্ক নির্দেশ করে।
৫. আন্তর্জাতিক সম্মানজনক ফেলোশিপের জন্য জিপিএ
বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন স্কলারশিপ ও ফেলোশিপগুলো পেতে হলে GPA একটি মৌলিক শর্ত।
ফেলোশিপ | প্রয়োজনীয় গড় GPA |
---|---|
Fulbright (USA) | ৩.৭–৪.০ (ডিপার্টমেন্টভেদে) |
Rhodes (UK) | ৩.৯+ |
Marshall | ৩.৮+ |
Hertz | ৩.৯+ |
NSF GRFP | ৩.৮+ |
[নোট: অবশ্য কিছু স্কলারশিপ কম GPA থাকলেও পাওয়া যায়, কিন্তু সেখানে GRE স্কোর, গবেষণাকাজ, কিংবা অতিরিক্ত অবদান দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়।]
৬. ক্যাম্পাস জব: RA ও TA হওয়ার সুযোগ
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অনক্যাম্পাস চাকরি যেমন—Research Assistant (RA) বা Teaching Assistant (TA) হওয়ার জন্য জিপিএ বড় ভূমিকা রাখে।
যুক্তরাষ্ট্রের ২২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সমীক্ষায় দেখা যায়—
৬৮% ফ্যাকাল্টি সদস্য জিপিএকে প্রধান মাপকাঠি হিসেবে ধরে নিয়োগ দেন।
এই ধরনের কাজ শুধু অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা দেয় না, বরং গবেষণা অভিজ্ঞতা হিসেবে ভবিষ্যতের উচ্চশিক্ষায় বড় প্রভাব ফেলে।
৭. ইমিগ্রেশন ও স্টাডি ভিসার ক্ষেত্রে জিপিএ
যদিও অনেক ইমিগ্রেশন পলিসি সরাসরি জিপিএ চায় না, তবুও Canada Express Entry স্কিমে এডুকেশন পয়েন্ট হিসেব করা হয় যেখানে ট্রান্সক্রিপ্ট জমা দিতে হয়। সেখানে GPA কম হলে গুরুত্ব কমে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই স্কলারশিপ ও ফান্ড পাওয়ার পর GPA মেইনটেইন করতে হয়। GPA কমে গেলে ফান্ড বাতিল হয়ে যেতে পারে এবং ভিসা স্ট্যাটাসও ঝুঁকিতে পড়ে।
৮. মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মবিশ্বাসের সাথে সম্পর্ক
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, GPA ভালো থাকলে ডিপ্রেশন ও এংজাইটি কম হয়।
- ডিপ্রেশনের সাথে GPA-এর নেগেটিভ কোরিলেশন ছিল: r ≈ –0.60
- আত্মবিশ্বাস ও পরিবারিক সাপোর্টের সাথে পজিটিভ কোরিলেশন: r ≈ 0.47–0.62
তাছাড়া ভালো জিপিএ ওয়ালাদের টাইম ম্যানেজমেন্ট, কনসিসটেন্সি, এবং গ্রিট অনেক বেশি হয়। এসব অভ্যাস পরবর্তীতে চাকরির জীবনেও তারা বজায় রাখতে পারে, যা কর্মজীবনে সফলতা আনে।
Educational Psychologist Zimmerman দেখিয়েছেন—
GPA সরাসরি সম্পর্কযুক্ত শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস, লক্ষ্য নির্ধারণ, এবং দীর্ঘমেয়াদি সহনশীলতার সাথে।
🔚 শেষ কথা: GPA সব নয়, কিন্তু অনেক কিছু
জিপিএ অবশ্যই জীবনের একমাত্র সাফল্যের সূচক নয়। তবে এটি অনেক দরজা খুলে দেয়, ভালো অভ্যাস তৈরি করে, এবং জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এগিয়ে রাখে।
তুমি হয়তো একজন চমৎকার নেতা, চিন্তাশীল গবেষক, অথবা সৃজনশীল শিল্পী হতে পারো। কিন্তু যদি তোমার জিপিএ ভালো থাকে, তাহলে তুমি নিজের যোগ্যতাকে আরও বেশি প্রমাণ করতে পারো—কম প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বেশি সুযোগে।
তাই বলাই যায়—“GPA is not everything, but it is often the first thing.”
আপনার মতামত পাঠান
এই প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো? কিংবা আপনি যদি কোনো গবেষণার লিংক বা অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চান, যোগাযোগ করুন আমাদের ইমেইলে: [email protected]
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সমাজ নিয়ে আরও লেখা পড়তে ভিজিট করুন: biggani.org
✍ লেখক: বিজ্ঞানী অর্গ রিপোর্টিং টিম
📅 প্রকাশকাল: জুলাই ২০২৫
📚 বিষয়: শিক্ষাব্যবস্থা, ক্যারিয়ার, মনোবিজ্ঞান, উচ্চশিক্ষা
Leave a comment