অতিথি লেখক:
আজিজুল হক
সহকারী অধ্যাপক, ইয়েংনাম বিশ্ববিদ্যালয়।
গবেষণার জগতে রিভিউ আর্টিকেল (Review Article) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে পূর্বে প্রকাশিত গবেষণাগুলোর একটি সমন্বিত বিশ্লেষণ এবং পর্যালোচনা। এই ধরনের আর্টিকেলের প্রধান লক্ষ্য হলো একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই প্রকাশিত তথ্য ও গবেষণার ভিত্তিতে একটি সামগ্রিক এবং সম্যক ধারণা প্রদান করা। এটি মূলত নতুন গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনের জন্য নয়, বরং, যে গবেষণা ইতোমধ্যে হয়েছে তার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বর্তমান অবস্থা তুলে ধরার মাধ্যমে একটি বিস্তৃত চিত্র উপস্থাপন করে। এতে বোঝা যায়, সেই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, কী ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে এবং এখন পর্যন্ত গবেষণার কোন দিকগুলো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। রিভিউ আর্টিকেল শুধু বিদ্যমান তথ্য উপস্থাপন করে থেমে থাকে না; বরং এটি গবেষণার ফাঁকগুলো চিহ্নিত করে এবং ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাব্য গবেষণার নতুন দিকগুলো উন্মোচন করে। ফলে গবেষণার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এটি এক ধরনের পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে।
রিভিউ আর্টিকেল লেখার প্রক্রিয়া শুরু করার আগে ৯ টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য রাখা উচিত:
১. জার্নালের লক্ষ্য ও পরিধি (aims and scope) যাচাই করুন:
আপনি যে জার্নালে আর্টিকেল জমা দিতে যাচ্ছেন, লেখা শুরু করার আগে সেই জার্নালের লক্ষ্য ও পরিধি (aims and scope) ভালোভাবে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। প্রতিটি জার্নালের নিজস্ব নীতি এবং নির্দিষ্ট আর্টিকেলের ধরন থাকে। সব জার্নাল রিভিউ আর্টিকেল গ্রহণ করে না, তাই প্রথমে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে যে জার্নালটি রিভিউ আর্টিকেল গ্রহণ করে এবং তার নির্ধারিত নির্দেশিকা অনুসরণ করে লেখা প্রস্তুত করতে হবে।
২. আপনার গবেষণার ক্ষেত্র নির্ধারণ করুন:
রিভিউ আর্টিকেলের scope বা আলোচনার ক্ষেত্র সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কোন গবেষণা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চান এবং তা বর্তমান গবেষণায় কীভাবে নতুন দিক সংযোজন করবে—এটা স্পষ্টভাবে বোঝাতে হবে। খুব বড় বা খুব ছোট বিষয় এড়িয়ে চলা উচিত। ক্ষেত্রটি এমনভাবে নির্ধারণ করুন, যাতে পাঠকরা সহজেই মূল গবেষণার দিকগুলো বুঝতে পারেন।
৩. তথ্য সংগ্রহের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করুন:
প্রাসঙ্গিক এবং বিশ্বস্ত উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একাধিক search engine বা research database ব্যবহার করা উচিত যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা বাদ না পড়ে। বিষয়ভিত্তিক প্রাসঙ্গিক তথ্য খুঁজে বের করে তা বিশ্লেষণ করা এবং তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার, বৈজ্ঞানিক জার্নাল এবং প্রামাণ্য ডেটাবেস যেমন PubMed, Scopus, Web of Science ইত্যাদি থেকে তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। এছাড়া, প্রাসঙ্গিক বই, প্রতিবেদন এবং সরকারি ডেটা ব্যবহার করা উচিত।
৪. শিরোনাম, সারসংক্ষেপ এবং কীওয়ার্ড তৈরি করুন:
একটি আকর্ষণীয় এবং তথ্যবহুল শিরোনাম (title), সারসংক্ষেপ (abstract), এবং প্রাসঙ্গিক কীওয়ার্ড (keywords) তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যা পাঠকদের আকর্ষণ করে এবং অনলাইনে সহজে অনুসন্ধানযোগ্য হয়। শিরোনাম এবং সারসংক্ষেপ সংক্ষিপ্ত, স্পষ্ট এবং তথ্যপূর্ণ হওয়া উচিত, যাতে পাঠক সহজেই আর্টিকেলের মূল বিষয়টি বুঝতে পারে।
৫. বিষয়ের প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করুন:
আর্টিকেলের শুরুতেই একটি পরিপূর্ণ ভূমিকা (introduction) দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অংশে বিষয়টির প্রাসঙ্গিকতা এবং গবেষণার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করতে হবে। লেখাটি এমনভাবে লিখতে হবে যেন তা শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞদের জন্যই নয়, সাধারণ পাঠকদের কাছেও প্রাসঙ্গিক ও সহজবোধ্য হয়।
৬. সমালোচনামূলক আলোচনা (critical discussion) উপস্থাপন করুন:
রিভিউ আর্টিকেল কেবল একটি বর্ণনামূলক সারসংক্ষেপ নয়; বরং এটি হতে হবে একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ। বিভিন্ন গবেষণার মধ্যে যদি কোনো বিরোধ বা মতবিরোধ থাকে, তাহলে তা উপস্থাপন করতে হবে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তি তুলে ধরতে হবে এবং প্রয়োজন হলে পরস্পরবিরোধী তথ্যগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে।
৭. গ্রাফিক্যাল অ্যাবস্ট্রাক্ট, আকর্ষণীয় চিত্র এবং তথ্যপূর্ণ টেবিল অন্তর্ভুক্ত করুন:
আপনার রিভিউ আর্টিকেলে গ্রাফিক্যাল অ্যাবস্ট্রাক্ট (Graphical Abstract) অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি পাঠকদের জন্য আপনার আর্টিকেলের বিষয়বস্তু সহজে বোঝানোর একটি চমৎকার উপায়। এছাড়া, আকর্ষণীয় এবং তথ্যবহুল চিত্র (Figures) আপনার রিভিউ আর্টিকেলে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। চিত্রগুলি পাঠকদের জন্য গবেষণার মূল বিষয়গুলি বুঝতে সহজ করে তোলে এবং আর্টিকেলের তথ্য স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করতে সাহায্য করে। চিত্রগুলির মাধ্যমে আপনি আরও সুস্পষ্টভাবে বিভিন্ন তথ্য, ফলাফল এবং থিওরি উপস্থাপন করতে পারবেন, যা রিভিউটির পাঠযোগ্যতা ও আগ্রহ আরও বাড়াবে। তাছাড়া, তথ্যপূর্ণ টেবিল (Tables) যুক্ত করা আপনার রিভিউ আর্টিকেলের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। টেবিলগুলো গবেষণার উপাত্ত সহজভাবে তুলনা এবং বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করে। এতে আপনি বিভিন্ন স্টাডির ফলাফল, মেথডলজি বা গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান এক জায়গায় উপস্থাপন করতে পারবেন। আপনার রিভিউতে টেবিল ব্যবহার করলে পাঠকরা সবচেয়ে সাম্প্রতিক এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য সহজে বুঝতে পারবে।
৮. উপসংহার এবং ভবিষ্যৎ নির্দেশনা দিন:
আর্টিকেলের শেষে একটি উপসংহার (conclusion) থাকতে হবে, যেখানে সারসংক্ষেপের মাধ্যমে প্রধান বিশ্লেষণ তুলে ধরা হবে। এছাড়াও, ভবিষ্যতে কোন দিকগুলোতে গবেষণা করা যেতে পারে—সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এর মাধ্যমে আর্টিকেলটি কেবল একটি তথ্যবহুল রচনা নয়, বরং ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্য একটি দিকনির্দেশক হয়ে উঠবে।
৯. সম্পাদনা এবং সমালোচনার জন্য প্রাথমিক মূল্যায়ন করুন:
আর্টিকেল জমা দেওয়ার আগে সেটি কয়েকবার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বানান, ব্যাকরণ এবং তথ্যগত ত্রুটি সঠিকভাবে পরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে অভিজ্ঞ সহকর্মী বা বন্ধুদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারেন। যদি ইংরেজি আপনার প্রথম ভাষা না হয়, তবে একটি ভাষা-পলিশিং সার্ভিস ব্যবহার করা উপকারী হতে পারে। এটি আপনার আর্টিকেলের পেশাদারিত্ব এবং পাঠযোগ্যতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করবে।
বিদ্র: ফেসবুক থেকে সংগ্রহীত:——–
Leave a comment