কিছুদিন আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের এক শিক্ষার্থী, যে শীঘ্রই তার স্নাতক ডিগ্রি শেষ করতে চলেছে, উচ্চশিক্ষার বিষয়ে ভাবছে এবং আমার পরামর্শ চাচ্ছিল। তার সঙ্গে কথোপকথনের ভিত্তিতে এই প্রবন্ধটি লিখছি, কারণ আমি প্রায়শই একই ধরনের পরামর্শের অনুরোধ পাই।
আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর শিক্ষার্থীটি কিছুটা দ্বিধায় ছিল। সে বলল, “স্যার, আমার তো সিজিপিএ ভালো, কিন্তু মনে হচ্ছে উচ্চশিক্ষার জন্য এটা যথেষ্ট নয়। আপনি কী বলেন?“
আমি একটু হাসলাম, তারপর বললাম, “তুমি ঠিকই ধরেছো। শুধু ভালো রেজাল্ট থাকলেই হবে না। একটা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় যখন আবেদনকারীদের দেখে, তখন তাদের চোখে আরও অনেক কিছু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তুমি কি জানো কী কী ব্যাপার খেয়াল করে তারা?“
সে মাথা নেড়ে বলল, “তেমন ভালো করে জানি না। কিন্তু শুনেছি গবেষণা প্রকাশনা (Publication) খুব জরুরি।“
আমি বললাম, “ঠিক বলেছো! শুধু গবেষণা নয়, ইন্ডাস্ট্রি এক্সপোজার, লিডারশিপ স্কিল, এমনকি অনলাইন প্রোফাইলও সমান গুরুত্বপূর্ণ। চলো, একে একে দেখে নিই তুমি কোন কোন জায়গায় উন্নতি করতে পারো।“
প্রথমেই জানা যাক তার কিছু প্রাথমিক তথ্য, তাহলে তোমাদের বুঝতে সুবিধা হবে কেন আমি এই পরামর্শগুলো দিয়েছি।
তার লক্ষ্য অস্ট্রেলিয়ায় মাস্টার্স করা, কেননা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সে তেমন আকৃষ্ট নয়। বর্তমানে সে তার থিসিস লিখছে এবং এখনো কোনো গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেনি। ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের অভিজ্ঞতা বলতে মাত্র পাঁচ দিনের একটা ইন্টার্নশিপ করেছে ডেসকোতে। তার একটি লিংকডইন খুলেছে তবে বিশেষ কোনো তথ্য নেই। এছাড়া গবেষণাপ্রবন্ধ নেই বলে গুগল স্কলার কিংবা রিসার্চগেটেও তার কোনো প্রোফাইল নেই।
আমি তার প্রোফাইল পর্যালোচনা করে দেখলাম, সে অনলাইনের প্রোফেশনাল প্ল্যাটফর্মে বিশেষভাবে সক্রিয় নয়। ফেসবুক বা টিকটকের উপস্থিতি এখানে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে না। বিশেষত, তার লিংকডইন প্রোফাইল খুব দুর্বল, এবং কোনো উল্লেখযোগ্য অনলাইন উপস্থিতি নেই। আজকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে শুধুমাত্র ভালো ফলাফল থাকলেই উচ্চশিক্ষার দরজা খুলে যাবে না, বরং প্রয়োজন অন্যান্য দক্ষতারও। তাই, তাকে আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝিয়ে বললাম, যা কেবল তার উচ্চশিক্ষার যাত্রা সহজ করবে না, বরং ক্যারিয়ারের জন্যও কার্যকর হবে।
উচ্চশিক্ষার জন্য যা প্রয়োজন
আমি তাকে প্রথমেই বললাম, উচ্চশিক্ষার জন্য শুধু ভালো সিজিপিএ (CGPA) থাকাই যথেষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীর একাডেমিক ফলাফলের পাশাপাশি অন্যান্য কিছু বিষয়ও যাচাই করে। এই তালিকায় শীর্ষে থাকে—
১. গবেষণা প্রকাশনা (Publication)
বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে দেখা যায়, শীর্ষ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদনকারীদের ৭৫% এর বেশি কমপক্ষে একটি বা দুটি গবেষণা প্রকাশনা থাকে। যেকোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য অন্তত দুইটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু তার গবেষণার কাজ শেষ পর্যায়ে, তাই এখনই তার উচিত গবেষণা প্রকাশনার দিকে মনোযোগ দেওয়া। কিন্তু কীভাবে?
- সায়েন্টিফিক জার্নাল: গবেষণার ফলাফল কোনো আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করা গুরুত্বপূর্ণ।
- রিভিউ পেপার: ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষার জন্য নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৬৫% এর গবেষণা প্রকাশিত ছিল রিভিউ পেপার আকারে। যদি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করতে দেরি হয়, তাহলে তার গবেষণা সংক্রান্ত একটি ভালো রিভিউ পেপার লেখা যেতে পারে। এতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাম্প্রতিক গবেষণা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা তুলে ধরা যায়।
- বই অধ্যায় বা নিউজপেপার আর্টিকেল: শুধু জার্নালেই নয়, বইয়ের অধ্যায় (book chapter) বা গণমাধ্যমে গবেষণার সারমর্ম প্রকাশ করাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এতে গবেষণা সাধারণ পাঠকের কাছেও পৌঁছায় এবং একজন গবেষকের প্রভাব বাড়ে। বিজ্ঞানী অর্গ ( https://biggani.org ) তেমন একটি আকর্ষণীয় প্লাটফর্ম হতে পারে তাদের জন্য।
২. ইন্টার্নশিপ বা ইন্ডাস্ট্রি এক্সপোজার
বিশ্বব্যাপী ৮৫% উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইন্টার্নশিপকে আবেদনকারীদের মূল্যায়নের একটি প্রধান মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করে।
উচ্চশিক্ষার জন্য শুধু একাডেমিক দক্ষতা যথেষ্ট নয়, শিল্প-কারখানা বা বাস্তব বিশ্বের অভিজ্ঞতা থাকাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে স্নাতক পর্যায়ে সরাসরি ইন্ডাস্ট্রির অভিজ্ঞতা অর্জন করা কঠিন। সেক্ষেত্রে—
- ইন্টার্নশিপ: দুই-তিন মাসের ইন্টার্নশিপ উচ্চশিক্ষার আবেদনে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু শুধুমাত্র সার্টিফিকেটের জন্য নয়, প্রকৃত অর্থে কাজ শিখতে হবে। ইন্টার্নশিপ করা যেতে পারে:
- সরকারি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংস্থাগুলোতে (যেমন: DESCO, BPDB, PGCB)।
- প্রাইভেট টেক কোম্পানি বা স্টার্টআপে (যেখানে রিয়েল-ওয়ার্ল্ড প্রজেক্টের অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে)।
- গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে।
- প্রকল্প বা প্র্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা: গবেষণা থিসিস বা ব্যক্তিগত প্রজেক্টকে ইন্ডাস্ট্রির প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা উচিত।
৩. অনলাইন উপস্থিতির গুরুত্ব
আমার পর্যবেক্ষণে, বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর অনলাইনে উপস্থিতি দুর্বল। অথচ আজকের বিশ্বে লিংকডইন, গুগল স্কলার, রিসার্চগেট, এবং ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট শিক্ষার্থীর দক্ষতা প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭০% এর বেশি লিংকডইনে সক্রিয় নয়, যা তাদের চাকরি ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ কমিয়ে দেয়।
- লিংকডইন প্রোফাইল হালনাগাদ করা দরকার। সেখানে শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, গবেষণা ও দক্ষতা উল্লেখ করা উচিত।
- গুগল স্কলার ও রিসার্চগেটে প্রোফাইল তৈরি করা উচিত।
- নিজের ব্লগ বা ওয়েবসাইট থাকলে তা আরও কার্যকরী হতে পারে।
কীভাবে শুরু করবে?
তাকে আমি বললাম, এখন থেকেই পরিকল্পনা করা দরকার।
১. গবেষণা প্রকাশনার জন্য কাজ শুরু করা।
২. ইন্টার্নশিপ বা প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ খোঁজা।
৩. সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া।
৪. লিংকডইন প্রোফাইল হালনাগাদ করা।
৫. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে লেখালেখি করা।
শেষ কথা: ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়া
এই শিক্ষার্থীর জন্য আমার পরামর্শ ছিল— উচ্চশিক্ষার জন্য শুধু ভালো ফলাফল যথেষ্ট নয়, বরং সম্পূর্ণ প্রোফাইল তৈরি করা জরুরি।
আমি তাকে আমার বই “পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং” https://www.rokomari.com/book/author/32297/dr-mashiur-rahman পড়তে বললাম এবং তাকে biggani.org এর সঙ্গে যুক্ত হতে বললাম, যেখানে আমরা শিক্ষার্থীদের গবেষণা, লেখালেখি ও বিজ্ঞান যোগাযোগের দক্ষতা উন্নয়নে সাহায্য করি।
এই গল্পটি কেবল এক শিক্ষার্থীর নয়—এটি অসংখ্য বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর বাস্তবতা। তাই, এখনই প্রস্তুতি শুরু করুন, কারণ উচ্চশিক্ষার জন্য শুধু ডিগ্রি নয়, বহুমুখী দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মিশ্রণ প্রয়োজন।
Leave a comment