নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ | [email protected]
নাসার ইতিহাসে যখন আমরা চোখ রাখি, তখন প্রথমে চোখে পড়ে মহাকাশচারীদের সাহসিকতা, চাঁদের বুকে প্রথম মানুষের পা রাখা কিংবা রকেটের চমকপ্রদ প্রযুক্তি। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় চাপা পড়ে যায় সেই অসংখ্য মুখ, যাদের নিরব কাজ ছিল এই সাফল্যের মূল ভিত। “Hidden Figures” বইটিতে মারগট লি শেটারলি সেই নিঃশব্দ কণ্ঠগুলোকে তুলে এনেছেন সামনে—বিশেষ করে সেই আফ্রিকান-আমেরিকান নারীদের, যারা গণিত ও বিজ্ঞানের অদম্য জ্ঞান দিয়ে বদলে দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ কর্মসূচির গতি।
১৯৪০ ও ৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ছিল এক বিভাজিত দেশ—বর্ণবৈষম্য ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতা, নারীরা ছিলেন পারিবারিক সীমাবদ্ধতার ঘেরাটোপে বন্দি, আর বিজ্ঞান ছিল মূলত পুরুষদের অধিকারভুক্ত ক্ষেত্র। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে যেসব কৃষ্ণাঙ্গ নারী নাসার মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন, তা নিছক বিস্ময়েরই শামিল। অথচ তাঁদের অবদান এতদিন ছিল আড়ালে, যেন তাঁরা ছিলেন শুধুই “গণনার যন্ত্র”—মানব কম্পিউটার।
ক্যাথরিন জনসন, ডরোথি ভন, মেরি জ্যাকসন—এই নামগুলো এক সময় কেউ জানত না। অথচ এঁরাই ছিলেন সেই নারী গণিতবিদেরা, যাঁরা হাতে ধরে হিসাব কষে দিয়েছেন রকেট কোন কোণে যাবে, কত বেগে পৌঁছাবে পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে মহাশূন্যে। ক্যাথরিন জনসনের হাতে কষা হিসাবেই নির্ভর করেছিল জন গ্লেনের ঐতিহাসিক কক্ষপথ প্রদক্ষিণ। এক অদ্ভুত বৈজ্ঞানিক নির্ভুলতা, এক অদম্য মানসিক দৃঢ়তা—এই নারীরা যেন তাঁদের জাতি ও লিঙ্গের ওপরে উঠে গিয়ে শুধু গণিতের যুক্তিকেই শ্রদ্ধা জানিয়ে গেছেন।
তবে এই গল্প শুধু বিজ্ঞান বা গণিতের নয়, এটি এক সামাজিক বিপ্লবের ইতিহাস। যখন একজন আফ্রিকান-আমেরিকান নারীকে আলাদা বাথরুম ব্যবহার করতে হতো, পৃথক ক্যান্টিনে খেতে হতো, তখন তাঁর কাজের স্বীকৃতি পাওয়া ছিল দূরের স্বপ্ন। তবু তাঁরা কাজ করে গেছেন নিঃশব্দে, দিনের পর দিন, নিজের দক্ষতা দিয়ে প্রমাণ করেছেন—প্রতিভা কোনো জাতি, লিঙ্গ বা বর্ণের অধীন নয়। শেটারলির লেখায় উঠে এসেছে এই প্রতিটি নারীর ব্যক্তিগত সংগ্রাম, তাঁদের পারিবারিক পরিবেশ, সমাজের প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে—তাঁদের নিজের ওপর অটল বিশ্বাস।
বইটি পড়তে পড়তে এক সময় পাঠকের মনে হয়, ‘কেন এতদিন এই গল্পগুলো কেউ বলেনি?’ এর উত্তর সহজ—ইতিহাস লিখেছেন তাঁরা, যাঁরা ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছাকাছি ছিলেন। আর ক্ষমতার ইতিহাসে প্রান্তিকদের গল্প প্রায়ই হারিয়ে যায়। কিন্তু শেটারলি সেই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে তুলে এনেছেন নতুন করে, যেন এক দলিল তৈরির মতো। এটি শুধু নারী বা কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের নয়, এটি মানব ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বইটির সৌন্দর্য এখানেই যে, এটি নিছক একটি তথ্যভিত্তিক বিবরণ নয়। এটি একাধারে সাহিত্য, ইতিহাস এবং সমাজ বিশ্লেষণের সংমিশ্রণ। আমরা দেখি কিভাবে বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখা নারীরা সমাজের চাপ, বর্ণবাদের আঘাত, এবং পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর বাধা উপেক্ষা করে নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। ডরোথি ভন যেভাবে একজন ‘সুপারভাইজার’ হওয়া সত্ত্বেও কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি, অথচ নিজের হাতে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখে ভবিষ্যতের পথ খুলে দিয়েছিলেন অন্য নারীদের জন্য—এটি কেবল অনুপ্রেরণার গল্প নয়, এটি নেতৃত্বের এক নিদর্শন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই গল্পগুলোর গুরুত্ব কম নয়। এখানেও আমরা দেখি, কিভাবে সমাজের প্রান্তিক নারীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নিজের জায়গা করে নিতে লড়াই করছেন। বিজ্ঞানপড়ুয়া এক মেয়ে, যাকে পরিবার থেকে বলা হয় “তোমার এত পড়ালেখার দরকার কী,” সেই মেয়েই হয়তো একদিন দেশের জন্য আবিষ্কার করবে কোনো নতুন প্রযুক্তি। কিন্তু তার আগে দরকার সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, দরকার এমন গল্পগুলো জানার—যেগুলো দেখায়, কোথা থেকে উঠে আসা যায়, কীভাবে অন্ধকার থেকে আলোয় পৌঁছানো যায়।
“Hidden Figures” বইটি এই কারণেই শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস নয়, এটি হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক অনুপ্রেরণার উৎস। এমন একটি বই, যা পাঠকের হৃদয়ে প্রশ্ন তোলে—আমি নিজে কীভাবে নিজস্ব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে পারি? কীভাবে সমাজের গৃহীত রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়? কীভাবে নিঃশব্দে কাজ করে যাওয়া মানুষগুলোকেও সম্মান জানানো যায়?
একটি জাতির প্রযুক্তিগত অগ্রগতি শুধু বিজ্ঞানীদের গবেষণাগার নির্ভর করে না, নির্ভর করে সেই জাতির সামাজিক চেতনার ওপরও। যখন সমাজ তার সব নাগরিককে সমানভাবে সুযোগ দিতে শেখে, তখনই প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হয়। এই নারীরা যেমন নাসার অংশ ছিলেন, তেমনি সমাজের মনোজগৎ পরিবর্তনেরও কারিগর ছিলেন। তাঁরা আমাদের শেখান—কর্মের মাধ্যমে জায়গা তৈরি হয়, নিজের দক্ষতা দিয়েই ইতিহাস লেখা যায়।
আজ যখন আমরা নারীর ক্ষমতায়ন, বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন বা প্রযুক্তিতে বৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা করি, তখন মনে রাখা প্রয়োজন এই ইতিহাস। যে ইতিহাস বলে—বিজ্ঞান কেবল কিছু প্রতিভাবান মানুষের ক্ষেত্র নয়, এটি হতে পারে সমাজ বদলের এক হাতিয়ার, যদি আমরা চাই সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে। “Hidden Figures” যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—যারা আড়ালে থাকেন, তাঁরাও একদিন সামনে আসতে পারেন, যদি আমরা তাঁদের গল্প বলার সাহস করি।
এই বইটির বাংলা অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন, পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন, কারণ এটি শুধুই ইতিহাস নয়—এটি ভবিষ্যতের পথনির্দেশনা। তরুণ বিজ্ঞানীদের জন্য এটি এক অনুপ্রেরণা, নারী শিক্ষার্থীদের জন্য এটি এক আত্মবিশ্বাসের উৎস, এবং আমাদের সমাজের জন্য এটি এক দর্পণ—যেখানে আমরা দেখতে পাই নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার এক অসাধারণ উদাহরণ।
“Hidden Figures” আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, অদৃশ্য থাকলেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ, নিঃশব্দ হলেও তাঁদের কণ্ঠ আছে, এবং কখনো কখনো, ইতিহাসের সেরা গল্পগুলোই লেখা হয় নীরবতার আড়ালে। এখন সময় এসেছে সেই গল্পগুলো বলার, ছড়িয়ে দেওয়ার, এবং নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে দেওয়ার—তোমার স্বপ্নের পথ যতো কঠিনই হোক, তুমি একা নও।
Leave a comment