বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশ ভ্রমনে যাবার শখ আপনি মিটাতে পারেন স্পেস এক্স, ব্লু অরিজিন, ভার্জিন গ্যালাকটিকা, এক্সিওম স্পেস এর মতন প্রতিষ্ঠানগুলির কল্যাণে। এই পর্যন্ত প্রায় ১০০ জন সৌখিন নভোচারী এমন ভ্রমণ করে এসেছেন। তবে মানুষের জন্য মহাকাশে ভ্রমণে কিছুটা বিপদ রয়েছে।
মহাকাশ যাত্রা শুধু প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে নয়, মানব শরীরের জন্যও চ্যালেঞ্জিং। মহাকাশচারী ও বাণিজ্যিক মহাকাশ ভ্রমণকারীরা বিপজ্জনক বিকিরণ (radiation) এবং মাইক্রোগ্রাভিটি (microgravity)-এর মুখোমুখি হন, যা শরীরের বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। প্রযুক্তিগত উন্নতির মাধ্যমে আমরা মহাকাশ ভ্রমণকে আরও নিরাপদ করতে পারি, বিশেষত জেনেটিক টেস্টিং (genetic testing) এবং জিন সম্পাদনার (gene editing) মতো আধুনিক জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে।
মহাকাশে ঝুঁকির ধরন
মহাকাশ ভ্রমণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিকিরণ। পৃথিবীতে আমরা প্রকৃতিগতভাবে একটি প্রতিরক্ষামূলক চৌম্বকক্ষেত্র এবং বায়ুমণ্ডল দ্বারা রক্ষা পাই, কিন্তু মহাকাশে এই সুরক্ষা থাকে না। বিকিরণ শরীরে প্রবেশ করলে এটি ডিএনএ (DNA) ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যার ফলে ক্যান্সার (cancer) এবং স্নায়ু রোগ (neurological disorders)-এর মতো জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওশা (Occupational Safety and Health Administration) এবং নাসা (NASA) মহাকাশচারীদের বিকিরণ এক্সপোজারের একটি নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করেছে।
মাইক্রোগ্রাভিটি একটি আরেকটি গুরুতর সমস্যা। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়া, আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ তরল উপরের দিকে জমা হতে পারে, এবং মাংসপেশী ও হাড় দুর্বল হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, মহাকাশচারীরা মহাকাশে এক বছর কাটানোর পর মাংসপেশীর ক্ষয় এবং হাড়ের ঘনত্বের হ্রাসের শিকার হন। এছাড়াও, চোখের সমস্যাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো “স্পেসফ্লাইট-অ্যাসোসিয়েটেড নিউরো-অকুলার সিনড্রোম” (spaceflight-associated neuro-ocular syndrome)।
মহাকাশ ভ্রমণের সাথে অন্যান্য ঝুঁকিও রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ওজন হ্রাস, “স্পেসফ্লাইট-সংশ্লিষ্ট নিউরো-অকুলার সিন্ড্রোম” নামে পরিচিত একটি অবস্থার কারণে স্থায়ী চোখের ক্ষতি, এবং বন্ধু ও প্রিয়জনদের থেকে দূরে থাকার ফলে মানসিক চাপ।
জেনেটিক টেস্টিং এবং জিন সম্পাদনা: সম্ভাব্য সমাধান
এই ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলো থেকে রক্ষা পেতে, জেনেটিক টেস্টিং এবং জিন সম্পাদনা আমাদের সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, উচ্চ পর্বতে বসবাসরত মানুষদের শরীরে এমন কিছু জেনেটিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাদের কম অক্সিজেনের পরিবেশে বাঁচতে সাহায্য করে। যদি আমরা মহাকাশচারীদের মধ্যে এই ধরনের বৈশিষ্ট্য সম্পাদনা করতে পারি, তবে তারা মহাকাশের চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে আরও সফল হতে পারেন।
জিন সম্পাদনার মাধ্যমে মহাকাশচারীদের শরীরকে বিকিরণ ও মাইক্রোগ্রাভিটির বিরূপ প্রভাব থেকে সুরক্ষিত করা যেতে পারে। যদিও এটি বর্তমানে বিজ্ঞানের কল্পকাহিনীর মতো শোনাতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যতে এটি বাস্তবে পরিণত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, CRISPR প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জেনেটিক রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষকরা ভবিষ্যতে মহাকাশ অভিযানের জন্য নির্দিষ্ট জিন থেরাপি তৈরি করার দিকে এগোচ্ছেন।
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা
পাঁচ বছর আগে, নাসার সাথে কাজ করা বিজ্ঞানীরা দুই অভিন্ন যমজের তুলনা করে একটি যুগান্তকারী গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছিলেন – যাদের একজন একটি বছর মহাকাশে কাটিয়েছিলেন অন্যজন পৃথিবীতে থেকেছিলেন। যমজ ভাই মার্ক এবং স্কট কেলি উভয়েই প্রশিক্ষিত নভোচারী ছিলেন। এবং যেহেতু তাদের একই সেট জিন রয়েছে, গবেষকরা তাদের তুলনা করতে পেরেছিলেন জিনগুলি কীভাবে কাজ করে তার উপর দীর্ঘমেয়াদী মহাকাশ ভ্রমণের প্রভাব মূল্যায়ন করার জন্য।
গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে সেই সময়ের মধ্যে উভয় যমজের জিনগুলি কাজ করার পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন এসেছিল, তবে তারা ভিন্ন ভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল। মহাকাশচারী ভাইয়ের কিছু প্রভাব ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে স্থায়ী হয়েছিল। এই পরিবর্তনগুলি মহাকাশ ভ্রমণের চাপের প্রতিক্রিয়া এবং হয়তো মহাকাশ বিকিরণের কারণে DNA ক্ষতির প্রতিক্রিয়া বলে মনে করা হয়।
পরিসংখ্যান এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা
বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাকাশ সংস্থা যেমন নাসা, স্পেসএক্স (SpaceX), চীন, এবং ইউএই মহাকাশ ভ্রমণের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করছে। নাসার লক্ষ্য হলো ২০৩০-এর দশকে মঙ্গলে মানুষের পদচারণা ঘটানো, আর স্পেসএক্স দাবি করেছে যে তারা ২০২৪ সালের মধ্যে মঙ্গলে মানবহীন মিশন চালাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, মহাকাশে এক বছরের বেশি সময় কাটানো মহাকাশচারীদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদী জেনেটিক পরিবর্তন সৃষ্টি করে।
উপসংহার
মহাকাশ ভ্রমণ সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ হবে, তবে জেনেটিক টেস্টিং এবং জিন সম্পাদনার মাধ্যমে মহাকাশচারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। যদিও এখনো এটি পুরোপুরি বাস্তবসম্মত নয়, ভবিষ্যতে মহাকাশ ভ্রমণকারীদের জন্য এটি প্রয়োজনীয় শর্ত হতে পারে। মহাকাশ ভ্রমণের সাথে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকির সমাধানের জন্য নতুন জৈবপ্রযুক্তি উদ্ভাবনের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এবং একদিন হয়তো মহাকাশ অভিযানের জন্য নির্দিষ্ট জিন সম্পাদনা বাধ্যতামূলক হয়ে উঠতে পারে।
Leave a comment