পদার্থবিদ্যামহাকাশ

পৃথিবীর তাপ আর মহাকাশের শীতলতা—এই ব্যবধানেই তৈরি হচ্ছে ভবিষ্যতের শক্তি

Share
Share

নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ | [email protected]

ভাবুন তো, রাতে আকাশের দিকে তাকালে যে অসীম ঠান্ডা অন্ধকার আপনি দেখেন, সেটিই যদি একদিন বিদ্যুৎ বানানোর যন্ত্রে পরিণত হয়! শুনতে কল্পবিজ্ঞানের মতো হলেও, বিশ্বের বিজ্ঞানীরা সেই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে শুরু করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ডেভিস-এর বিজ্ঞানীরা এমন এক ছোট যন্ত্র তৈরি করেছেন, যা পৃথিবীর উষ্ণতা আর গভীর মহাকাশের প্রচণ্ড ঠান্ডা—এই দুইয়ের তাপমাত্রার পার্থক্য থেকে শক্তি উৎপাদন করতে পারে। এই অসাধারণ গবেষণাটি সম্প্রতি বিজ্ঞান জার্নাল Science Advances-এ প্রকাশিত হয়েছে।

আপনি জানেন, পৃথিবী সূর্যের আলোয় গরম থাকে। দিনের বেলায় মাটি, পানি আর বাতাস তাপ জমিয়ে রাখে। অন্যদিকে, গভীর মহাকাশের তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ২৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস—প্রায় সম্পূর্ণ শূন্যের কাছাকাছি। এই দুইয়ের মধ্যকার বিশাল তাপমাত্রার ব্যবধান থেকেই বিজ্ঞানীদের মাথায় আসে এক অভিনব ভাবনা—এই পার্থক্যকে যদি কাজে লাগানো যায়, তাহলে কি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব? সেই প্রশ্ন থেকেই জন্ম নেয় এই যুগান্তকারী গবেষণা।

গবেষণাটির মূল ভিত্তি একটি বিশেষ ইঞ্জিন, যার নাম স্টার্লিং ইঞ্জিন। এটি অন্য ইঞ্জিনের মতো জ্বালানি পুড়িয়ে চলে না। এখানে কোনো গ্যাস, ডিজেল বা তেল ব্যবহার হয় না। বরং, গরম আর ঠান্ডার পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করে যান্ত্রিক শক্তি তৈরি হয়। যেমন, একটি গরম কাপ কফির পাশে ঠান্ডা বাতাস থাকলেই তাপমাত্রার পার্থক্য তৈরি হয়। এই একই নীতিতে স্টার্লিং ইঞ্জিন কাজ করে। তবে এই গবেষণায় সবচেয়ে নতুন যে বিষয়টি যুক্ত হয়েছে, তা হলো—এখানে ঠান্ডা হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে গভীর মহাকাশের তাপমাত্রা।

স্বাভাবিকভাবেই আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, “মহাকাশ তো অনেক দূরে, আমরা তার ঠান্ডা ব্যবহার করব কীভাবে?” বিজ্ঞানীদের উত্তর অত্যন্ত সহজ—‘তাপ বিকিরণ’ (Thermal Radiation) ব্যবহার করে। সূর্য যেভাবে আলো ও তাপ পৃথিবীতে পাঠায়, ঠিক তেমনিভাবে পৃথিবী থেকেও তাপ আকাশের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই তাপ চোখে দেখা না গেলেও ইনফ্রারেড রশ্মির মাধ্যমে বিকিরণ হয়। বিজ্ঞানীরা এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকেই কাজে লাগিয়ে পৃথিবী ও মহাকাশের মধ্যে এক ধরনের অদৃশ্য সংযোগ তৈরি করেছেন।

এই যন্ত্রটির গঠন বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। একটি বর্গাকার প্যানেলের এক দিক মাটির সঙ্গে যুক্ত থাকে, যাতে পৃথিবীর তাপ সহজে শোষণ করা যায়। আর অন্য দিকটি মুখ করে থাকে রাতের আকাশের দিকে। সেই অংশটিতে ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ ধরনের রঙ, যা নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তাপ দ্রুত বিকিরণ করতে পারে। এই তরঙ্গগুলো এমন এক “বায়ুমণ্ডলীয় জানালা” দিয়ে বেরিয়ে যায়, যেখানে বাতাস খুব কম বাধা দেয়। ফলে পৃথিবীর তাপ সহজেই মহাকাশে পৌঁছে যায়, আর সেই শূন্য-তাপমাত্রার পরিবেশ যন্ত্রটির এক দিককে ঠান্ডা করে ফেলে। এই গরম–ঠান্ডার পার্থক্য থেকেই স্টার্লিং ইঞ্জিনটি সচল হয়।

বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাটি কোনো ল্যাবরেটরিতে নয়, বরং বাস্তব পরিবেশে চালিয়েছেন। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা যন্ত্রটি খোলা জায়গায় বসিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ফলাফল বিস্ময়কর। সূর্য ডোবার পর যন্ত্রটির দুই পাশে প্রায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পার্থক্য তৈরি হয়েছে। এই পার্থক্য থেকেই প্রতি বর্গমিটারে প্রায় ৪০০ মিলিওয়াট শক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব হয়েছে। শুনতে কম মনে হলেও এই শক্তি দিয়ে ছোট ফ্যান বা ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক মোটর চালানো যায়।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল একটি বিশেষ পরীক্ষা। বিজ্ঞানীরা একটি ছোট গ্রীনহাউসের মধ্যে এই ইঞ্জিন বসিয়ে দেখেন, এটি রাতের বেলা বাতাস চলাচল করাতে পারে কি না। ইঞ্জিনের ফ্লাইহুইলের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় একটি কাস্টমাইজড ফ্যানের পাখা। আশ্চর্যের বিষয়, এই ফ্যান গ্রীনহাউসের বাতাস যথেষ্ট পরিমাণে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এর ফলে ভেতরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ হয় এবং গাছের জন্য তৈরি হয় আরামদায়ক পরিবেশ।

গবেষকরা বলছেন, এটি কেবল প্রথম ধাপ। ভবিষ্যতে যন্ত্রটির উন্নয়ন ঘটানো হলে এটি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ছাড়াই ভবনের ভেতর স্বাস্থ্যসম্মত বাতাস সরবরাহ করতে পারবে। স্কুল, হাসপাতাল, পার্ক বা গ্রীনহাউসে এই প্রযুক্তি গাছের বৃদ্ধির জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারবে। তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে গাছের ফলন বাড়ানো সম্ভব হবে।

এই প্রযুক্তির গুরুত্ব বুঝেই ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ডেভিস ইতিমধ্যেই এর জন্য অস্থায়ী পেটেন্ট আবেদন করেছে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে শুধু শক্তি উৎপাদনের নতুন পথই দেখাবে না, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধেও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। কারণ এতে কোনো ধোঁয়া, বর্জ্য বা কার্বন গ্যাস নির্গত হয় না।

বর্তমানে এই যন্ত্রের শক্তি উৎপাদনের পরিমাণ সীমিত। ভবিষ্যতে উন্নয়ন হলে প্রতি বর্গমিটার থেকে সর্বোচ্চ ৬ ওয়াট শক্তি উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে গবেষকরা মনে করছেন। সৌর প্যানেলের মতো বড় উৎপাদন এখনো সম্ভব নয়, তবে এর একটি বড় সুবিধা হলো—এটি রাতে কাজ করে, যখন সৌরশক্তি থাকে না।

এই আবিষ্কার আমাদের একটি বড় শিক্ষা দেয়—শক্তির উৎস শুধু কয়লা, তেল বা গ্যাসেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃতির ভেতরেই লুকিয়ে আছে শক্তির বিশাল ভাণ্ডার, যা বিজ্ঞান ও কল্পনাশক্তির সম্মিলনে কাজে লাগানো সম্ভব। পৃথিবীর একটি ছোট যন্ত্র যখন মহাকাশের শীতলতাকে শক্তিতে রূপান্তর করতে পারে, তখন বুঝতে হয়—বিজ্ঞানের কোনো সীমা নেই।

আপনার কৌতূহলই হতে পারে ভবিষ্যতের পৃথিবী বদলে দেওয়ার মূল চাবিকাঠি। আজ যে প্রশ্নটি আপনার মনে জাগছে, হয়তো একদিন সেটিই হয়ে উঠবে নতুন কোনো আবিষ্কারের ভিত্তি। বিজ্ঞান মানে শুধু মুখস্থ নয়, বিজ্ঞান মানে বোঝা, অনুসন্ধান করা আর নতুন পথ খুঁজে বের করা। এই ছোট যন্ত্রটি দেখিয়ে দেয়—বড় পরিবর্তনের জন্য কখনো কখনো একটি ছোট ভাবনাই যথেষ্ট।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org