পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম শমসের আলী: এক বিজ্ঞানভিত্তিক জীবনের শেষ প্রহর
লিখেছেন: নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
যোগাযোগ: [email protected]
“তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের দীপ্ত শিখা—যে শিখা নিভলেও রেখে গেলো অসংখ্য দীপ্ত মন।”
বাংলাদেশের বিজ্ঞানভুবনে এক আলোকিত নাম—ড. এম শমসের আলী। তাঁর নাম শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে এক নির্লোভ, প্রজ্ঞাবান, যুক্তিনিষ্ঠ বিজ্ঞানীর মুখ, যিনি আজীবন কাজ করেছেন জ্ঞানচর্চা, বিজ্ঞানপ্রচারণা এবং নৈতিক শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে।
২০২৫ সালের ২ আগস্ট রাত ২টার দিকে ঢাকায় তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে, বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও শিক্ষাজগতে এক শোকের ছায়া নেমে আসে। সামাজিক মাধ্যমে তরুণ-প্রবীণ, শিক্ষক-গবেষক, সাধারণ পাঠক—সকলেই যে ভাষায় স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন, তাতে বোঝা যায়, তিনি কেবল একজন বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন এক অনুপ্রেরণা।
📖 এক শিক্ষক, এক চিন্তাবিদ
স্যারকে অনেকেই চেনেন তাঁর জনপ্রিয় বইয়ের মাধ্যমে—বিশেষ করে “Scientific Indications in the Holy Qur’an” এবং “Aladdin’s Real Lamp”। একজন পাঠক আমাদের বলেন,
“এই বই আমি বারবার কিনি, আমার প্রিয় মানুষদের উপহার দিই—এই বই যেন বিজ্ঞান আর আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব সেতু।”
যে মানুষটির লেখা এত পাঠকের হৃদয় ছুঁয়েছে, তাঁর জীবনের গল্পও তেমনই অনুপ্রেরণাদায়ক।
👨🔬 ছোট শহর থেকে আন্তর্জাতিক গবেষণা ল্যাব
ড. এম শমসের আলীর জন্ম কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় (১৯৩৭–১৯৪০), তবে পৈত্রিক নিবাস যশোর জেলার সিঙ্গিয়ায়। যশোর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, রাজশাহী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। এখানেই তিনি অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন (১৯৫৯ ও ১৯৬০)।
পরে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওরেটিক্যাল নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে পিএইচডি করেন (১৯৬৫)। তাঁর গবেষণার মূল ক্ষেত্র ছিল নিউক্লিয়াসের গঠন, থ্রি-বডি ইন্টারঅ্যাকশন এবং নন-লোকাল নিউক্লিয়ার মডেল।
🇧🇩 বাংলাদেশে ফেরা, দেশের জন্য কাজ
বিদেশ থেকে পিএইচডি নিয়ে ফেরার পর, তিনি কাজ শুরু করেন পাকিস্তান অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনে। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি কমিশনের পরিচালক ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, তিনি পরমাণু শক্তি কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান চর্চার নেতৃত্ব দেন।
১৯৮২ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর তাঁর এক যুগান্তকারী ভূমিকা ছিল বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসেবে (১৯৯২–৯৬)। পরে তিনি সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন (২০০২–২০১০)।
🧪 গবেষণার পাশাপাশি বিজ্ঞানপ্রচারণা
শুধু গবেষণায় সীমাবদ্ধ থাকেননি ড. শমসের আলী। তিনি চেয়েছিলেন—বিজ্ঞান শুধু ল্যাবের চার দেয়ালে না থেকে পৌঁছে যাক মানুষের চিন্তায়, চর্চায়, সংস্কৃতিতে।
তিনি টেলিভিশনে প্রচুর বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করেছেন—বিশেষ করে কোরআন ও বিজ্ঞানের সমন্বয়, নৈতিক শিক্ষা ও যুক্তি নির্ভর সমাজ গঠনে বিজ্ঞানের ভূমিকা নিয়ে। BTV‑তে তাঁর অনুষ্ঠানগুলো বহু শিক্ষার্থী ও সাধারণ দর্শকের মাঝে বিজ্ঞান সম্পর্কে কৌতূহল জাগিয়েছে।
🏅 সম্মাননা ও নেতৃত্ব
ড. আলী ছিলেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতি (২০০৪–২০১২)। তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স, ইসলামিক ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সেস ও TWAS Fellow ছিলেন।
তাঁর অর্জিত সম্মাননার তালিকাও দীর্ঘ:
- হরি প্রসন্ন রায় স্বর্ণপদক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
- বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি গোল্ড মেডেল
- TWNSO পুরস্কার
- খাঁন বাহাদুর আহসানউল্লাহ গোল্ড মেডেল
- গ্লোবাল ইনোভেশন ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ

🌟 বিজ্ঞানী, যিনি বিশ্বাসের কথাও বলেন
আমাদের সমাজে বিজ্ঞান ও ধর্ম যেন দুই বিপরীত মেরু—এমনই একটা ধারণা কাজ করে। কিন্তু ড. শমসের আলী ছিলেন সেই বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি দেখিয়েছেন বিজ্ঞান ও ধর্ম একে অপরের পরিপূরক হতে পারে।
তিনি বারবার বলেছেন:
“বিজ্ঞান আমাকে শেখায় যুক্তি, ধর্ম শেখায় নৈতিকতা। এই দুই মিলেই একটি আলোকিত সমাজ গড়ে ওঠে।”
💬 তরুণদের জন্য বার্তা
তিনি সবসময় তরুণদের বিজ্ঞান চর্চা করতে উৎসাহিত করতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল—বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ঘটবে তখনই, যখন তরুণরা গবেষণায় মনোযোগী হবে এবং প্রযুক্তি নির্ভর দেশ গড়বে।
আজ যাঁরা স্যারের মৃত্যুতে শোক জানাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই তাঁর প্রাক্তন ছাত্র বা অনুসারী—কারো কারো জীবনে স্যারের একটি কথাই জীবন বদলে দিয়েছে।
🕯️ আমরা কী হারালাম?
আমরা হারালাম এক শিক্ষক, এক পথপ্রদর্শক, এক জ্ঞানযোদ্ধা। তিনি ছিলেন সেই মানুষ, যিনি বই দিয়ে আলো ছড়াতেন, বক্তৃতা দিয়ে বিবেক জাগাতেন, আর গবেষণায় বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশের পরিচিতি তুলে ধরতেন।
তিনি যেমন বলেছিলেন:
“আলো ছড়ানোর জন্য নিজের মোমবাতিকে জ্বালাতে ভয় নেই।”
আমরা, তাঁর ছাত্র, অনুসারী, পাঠক—আজও সেই আলোর শিখায় উজ্জীবিত। তাঁর রেখে যাওয়া বইগুলো, বক্তৃতাগুলো, এবং শিক্ষাদর্শ আজও আমাদের পথ দেখায়।
🌹 শেষ শ্রদ্ধা
ড. এম শমসের আলী ছিলেন আমাদের সময়ের একজন মহামানব। তাঁকে স্মরণ করেই আমরা এই লেখাটি প্রকাশ করছি, শ্রদ্ধাভরে, ভালোবাসাভরে, দায়বদ্ধতার সঙ্গে।
স্যার, আপনি আলোর মতো ছিলেন—নিভে গেলেও আলোকছায়া রেখে গেলেন আমাদের হৃদয়ে।
বিজ্ঞানী অর্গ-এর পক্ষ থেকে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
প্রকাশিত: আগস্ট ২০২৫
প্রকাশনা: biggani.org
সম্পাদনা: নিউজ ডেস্ক
যোগাযোগ: [email protected]
Leave a comment