গবেষকদের যন্ত্রপাতি

ক্লিনিক্যাল স্টাডি: আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের আস্থার মেরুদণ্ড

Share
Share

ক্লিনিক্যাল স্টাডি—শব্দ দুটি আমরা মাঝেমধ্যেই শুনি। বিশেষ করে নতুন কোনো ওষুধের অনুমোদন বা চিকিৎসা পদ্ধতির নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনায় এ শব্দ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সাধারণ পাঠকের মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে, ক্লিনিক্যাল স্টাডি আসলে কী, কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ, আর আমাদের জীবনের সঙ্গে এর সম্পর্ক কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই বোঝা দরকার, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা শুধু ল্যাবরেটরিতে নয়, বরং বাস্তব মানুষের শরীর ও জীবনের ওপর নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই সম্পূর্ণ হয়।

যখন কোনো নতুন ওষুধ তৈরি হয়, তা প্রথমে পরীক্ষাগারে রাসায়নিক কিংবা জৈবিক স্তরে যাচাই করা হয়। এরপর প্রাণীর ওপর সীমিত পরীক্ষা চালানো হয়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি বা ওষুধকে কার্যকর ও নিরাপদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রয়োজন মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রিত, বৈজ্ঞানিক এবং বহুস্তরীয় পরীক্ষা। এই পর্যায়টিই ক্লিনিক্যাল স্টাডি বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। একে আপনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের “বাস্তব পরীক্ষাগার” বলতে পারেন, যেখানে মানুষের অংশগ্রহণই গবেষণার মূল ভিত্তি।

ক্লিনিক্যাল স্টাডি সাধারণত ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে খুব সীমিত সংখ্যক সুস্থ স্বেচ্ছাসেবকের শরীরে নতুন ওষুধ প্রয়োগ করে দেখা হয়, এটি নিরাপদ কি না। দ্বিতীয় ধাপে ছোট একটি রোগী গোষ্ঠীর ওপর পরীক্ষা চালিয়ে কার্যকারিতা যাচাই করা হয়। তৃতীয় ধাপে বড় আকারের গবেষণা হয়, যেখানে হাজার হাজার রোগী অংশগ্রহণ করেন। আর সবশেষে, অনুমোদন পাওয়ার পরও ওষুধটির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এবং বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হয়। প্রতিটি ধাপ কঠোর নিয়ম-কানুন ও নৈতিকতার আওতায় সম্পন্ন হয়, যাতে কোনো অংশগ্রহণকারীর ক্ষতি না হয় এবং গবেষণার ফলাফল বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ভরযোগ্য থাকে।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এত জটিল প্রক্রিয়া দরকার? উত্তর সহজ: মানুষের জীবন। যদি কোনো ওষুধ কার্যকর হলেও অপ্রত্যাশিত ক্ষতি ডেকে আনে, তবে তা চিকিৎসার বদলে মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করবে। ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। ১৯৫০-এর দশকে ইউরোপে থ্যালিডোমাইড নামের একটি ওষুধ গর্ভবতী নারীদের বমি কমাতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, এ ওষুধ ব্যবহার করা মায়েদের অসংখ্য শিশু জন্মগত বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্মাচ্ছে। এই বিপর্যয় চিকিৎসা জগতে নাড়া দিয়েছিল এবং সেখান থেকেই আধুনিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কঠোর মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত হয়।

আজকের দিনে আমরা যে ওষুধ খাই, তা সাধারণ ব্যথানাশক থেকে শুরু করে ক্যানসারের টার্গেটেড থেরাপি পর্যন্ত—সবকিছুই বহু বছরের ক্লিনিক্যাল স্টাডির ফল। আমরা যদি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে নতুন কোনো টিকা গ্রহণ করি, তবে নিশ্চিত থাকতে পারি যে এটি কেবল গবেষণাগারে নয়, বাস্তব মানুষের ওপর পর্যায়ক্রমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। তাই ক্লিনিক্যাল স্টাডি কেবল বিজ্ঞানীদের একাডেমিক কাজ নয়; এটি আমাদের প্রত্যেকের দৈনন্দিন স্বাস্থ্য নিরাপত্তার গ্যারান্টি।

তবে এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নৈতিকতা। ক্লিনিক্যাল স্টাডিতে অংশ নেওয়া মানে একজন মানুষ নিজের শরীরকে বিজ্ঞানের পরীক্ষার অংশ হিসেবে তুলে দিচ্ছেন। ফলে গবেষক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব হয় অংশগ্রহণকারীদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য জানানো, ঝুঁকির সম্ভাবনা খোলাখুলি ব্যাখ্যা করা এবং যেকোনো সময় গবেষণা থেকে সরে দাঁড়ানোর অধিকার নিশ্চিত করা। আন্তর্জাতিকভাবে ‘ইনফর্মড কনসেন্ট’ নামে পরিচিত এই প্রক্রিয়াটি প্রতিটি পরীক্ষার কেন্দ্রে রাখা হয়। নৈতিকতা উপেক্ষা করে করা গবেষণা যেমন অনৈতিক, তেমনি অবৈজ্ঞানিকও। কারণ, অংশগ্রহণকারীর অজান্তে ঝুঁকি নেওয়া হলে গবেষণার ফলাফল আস্থার জায়গা হারায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ আলোচনার গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। আমাদের দেশে চিকিৎসা গবেষণা এখনো সীমিত পরিসরে হলেও ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। টিকা উন্নয়ন, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগ চিকিৎসা নিয়ে কিছু ক্লিনিক্যাল স্টাডি ইতিমধ্যেই হয়েছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জও আছে যথেষ্ট—পর্যাপ্ত অর্থায়ন, প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ, এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নৈতিক পর্যালোচনার কাঠামো তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। কারণ, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য গবেষণায় বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকলে কেবল বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি নয়, আমাদের জনগণেরও ক্ষতি হবে।

কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, ক্লিনিক্যাল স্টাডি ছাড়া কোনো চিকিৎসা সমাধান বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। তখন গোটা পৃথিবী দ্রুত টিকা উদ্ভাবন করল, কিন্তু সেটি সম্ভব হলো কারণ একযোগে হাজারো গবেষণা দল অল্প সময়ে পর্যায়ক্রমিক ক্লিনিক্যাল স্টাডি সম্পন্ন করেছিল। যদিও সময়ের চাপ ছিল প্রবল, তবুও নৈতিকতা ও নিরাপত্তার মানদণ্ড বজায় রাখা হয়েছিল। এর ফলে মানুষ টিকার ওপর আস্থা রাখতে পেরেছিল, আর সেই আস্থাই মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে বড় ভূমিকা রাখে।

অতএব, ক্লিনিক্যাল স্টাডি কেবল চিকিৎসা গবেষণার একটি ধাপ নয়, বরং আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মেরুদণ্ড। এটি ছাড়া কোনো নতুন ওষুধ, টিকা বা চিকিৎসা প্রযুক্তি মানুষের কাছে পৌঁছানো উচিত নয়। একে আপনি বিজ্ঞানের ‘ফিল্টার’ বলতে পারেন—যা ভুয়া প্রতিশ্রুতি ও কুসংস্কারকে সরিয়ে দিয়ে কেবল কার্যকর সমাধানকে সামনে আনে। আমাদের সমাজে যখন ভেষজ বা বিকল্প চিকিৎসার নামে নানা প্রতারণা ঘটে, তখন ক্লিনিক্যাল স্টাডির গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বিজ্ঞান একাই যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে থাকতে হয় মানুষের আস্থা। আর সেই আস্থা গড়ে ওঠে প্রমাণভিত্তিক ফলাফলের ওপর, যা ক্লিনিক্যাল স্টাডির মাধ্যমে নিশ্চিত হয়। আজ আমরা যে ওষুধের দোকান থেকে নির্ভয়ে ওষুধ কিনে খাই, তা মূলত এই প্রমাণভিত্তিক বিজ্ঞানেরই জয়। তাই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও গবেষণা অবকাঠামো গড়ে তুলে ক্লিনিক্যাল স্টাডিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

একটি কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থার লক্ষ্য হওয়া উচিত কেবল রোগের চিকিৎসা নয়, বরং রোগ প্রতিরোধ ও মানসম্মত জীবন নিশ্চিত করা। আর সে লক্ষ্য অর্জনে ক্লিনিক্যাল স্টাডি হলো আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষা, নৈতিক দায়িত্ববোধ এবং সমাজের আস্থা—এই তিন স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েই ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নির্মিত হবে। ক্লিনিক্যাল স্টাডিকে গুরুত্ব দেওয়া মানে কেবল চিকিৎসা উন্নয়ন নয়, বরং মানুষের জীবনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org