ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুউচ্চ ফটক পেরিয়ে যখন প্রথম বর্ষের মনোবিজ্ঞানের এক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে পা রাখে, তখন তার মনে ছিল কেবল উত্তেজনা আর নতুন জীবনের স্বপ্ন। কিন্তু মাত্র দুই মাস পর, আশপাশের পরিবেশ, বন্ধুদের চিন্তাধারা আর ক্লাসের বৌদ্ধিক বিতর্কে সে অনুভব করতে থাকে, তার নিজের চিন্তাভাবনা বদলে যাচ্ছে। যেসব বিষয়ে আগে উৎসাহ ছিল না, এখন তা নিয়ে গভীর আগ্রহ জন্মেছে। যেসব অনুভব আগে খুব তীব্র ছিল, সেগুলোর জায়গায় এসেছে নির্লিপ্তি কিংবা গভীর পর্যবেক্ষণ। বন্ধুদের সাথে অনেক রাত জেগে আলোচনায় বসে সে হঠাৎই আবিষ্কার করে, একইরকম ভাবনাগুলো যেন তাদের সকলের মধ্যে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে, অথচ কেউ কাউকে শেখাচ্ছে না। যেন চিন্তারা বাতাসের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে, আর ব্রেইনগুলো সেগুলো শুষে নিচ্ছে।
এই ঘটনাকে আমরা দৈনন্দিন ভাষায় বলি “পরিবেশের প্রভাব”, কিন্তু আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান একে ব্যাখ্যা করে আরও গভীরভাবে, সামাজিক ব্রেইন ওয়েভ সিঙ্ক্রোনাইজেশন বা interpersonal neural synchrony নামে।
মানুষের মস্তিষ্ক কোনো একক দ্বীপ নয়। আমরা একেকটা সিগন্যাল সিস্টেমের অংশ, যা আশপাশের মানুষদের মস্তিষ্কের সাথে নিঃশব্দে কিন্তু নিরবিচারে যোগাযোগ করে চলে। এ যেন Wi-Fi সংযোগের মতোই দৃষ্টির সংস্পর্শ, শব্দের প্রতিধ্বনি, এমনকি নীরব উপস্থিতিতেও আপনার ব্রেইনের নিউরনগুলো অন্যের সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করে।
Neuroscientific গবেষণায় দেখা গেছে, যখন দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একসাথে একটি কাজ করেন, হোক তা মিউজিকের অনুশীলন, আলোচনা, বা শুধুই নীরবভাবে একসাথে বসে থাকা, তাদের মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট অংশ একে অপরের সাথে সিঙ্ক্রোনাইজ করতে থাকে। বিশেষ করে prefrontal cortex, temporoparietal junction এবং motor cortex-এ এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এগুলোর মধ্য দিয়ে গঠিত হয় এক অদৃশ্য অথচ বাস্তব “সামাজিক সুর”; যা আমাদের একে অপরের অনুভব ও আচরণে প্রভাব ফেলে।
এটাই সেই রহস্যময় ব্যাখ্যা যা বলে দেয় কেন আপনি বারবার খেয়াল করেন, একসাথে থাকা বন্ধুদের মাঝে ধীরে ধীরে কথা বলার ধরন, রসিকতা, এমনকি চিন্তার ধারা একরকম হয়ে যায়। এটি নিছক অনুকরণ নয়; এটি neural entrainment, যেখানে আপনার ব্রেইন ওয়েভ, অন্যের ব্রেইন ওয়েভের সাথে phase lock করতে শুরু করে।
এবার কল্পনা করুন, আপনি যদি প্রতিনিয়ত এমন মানুষের সংস্পর্শে থাকেন, যারা নেতিবাচক, হতাশ, কিংবা যাদের ব্রেইনে হতাশার রাশায় মোড়ানো চিন্তার ছায়া ঘোরে, তাহলে আপনি নিজেও কিছুদিন পর সেই ছায়ায় ঢেকে যাবেন। অথচ আপনি নিজের ব্রেইনে ঢুকে কাউকে ঢুকতে দেননি। কিন্তু তারা ঢুকেছে তাদের ব্রেইন ওয়েভ দিয়েই।
প্রথমে একটি বিষয় পরিষ্কার করা জরুরি: আপনার মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত বৈদ্যুতিক তরঙ্গ তৈরি করছে। এই তরঙ্গগুলোই আমরা বলি ব্রেইন ওয়েভ। এগুলো মূলত নিউরনগুলোর বিশাল সমন্বিত কার্যকলাপের ফলে উৎপন্ন হয়। আর এই তরঙ্গ পাঁচ ধরণের:
Delta, Theta, Alpha, Beta, Gamma প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থা বোঝায়।
কিন্তু যখন আপনি কারও খুব কাছাকাছি আসেন, শারীরিকভাবে বা আবেগগতভাবে তখন একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। আপনার ব্রেইন তার তরঙ্গের প্যাটার্ন পরিবর্তন করে, এবং ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে সেই মানুষটির তরঙ্গের সাথে। অর্থাৎ, আপনার Alpha যদি শান্ত ছিল, আর তার Beta ছিল উত্তেজিত, তাহলে হয়ত আপনার Alpha কমে আসবে আর Beta বাড়তে শুরু করবে, যেন আপনার ব্রেইন তার তরঙ্গে ‘phase lock’ করছে।
এই phenomenon কে বলে neural synchrony।
উদাহরণস্বরূপ:
গবেষণায় দেখা গেছে, যখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী একই আগ্রহ নিয়ে একটি বিষয় আলোচনা করেন, তখন তাদের prefrontal cortex ও temporoparietal junction-এর মধ্যে একরকম নিউরাল মিলন ঘটে তারা কার্যত “একই ফ্রিকোয়েন্সিতে” কাজ করছে। একইভাবে, যখন দুজন বন্ধু গভীর আলোচনায় বা হাসির মুহূর্তে যুক্ত হন, তখনও তাদের EEG স্ক্যানে একইরকম রিদম পাওয়া যায়।
জার্মানির Max Planck Institute-এর একটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারী যুগলদের একসাথে গান শোনার সময় ব্রেইন ওয়েভ একে অপরের সঙ্গে সিঙ্ক্রোনাইজড হয়ে যায়, বিশেষ করে আনন্দ ও বিষাদের মুহূর্তে।
এর চেয়েও অবাক করা বিষয়: দুই ব্যক্তি যদি কেবল চোখের দৃষ্টিতে যুক্ত থাকে, মানে কোনো কথা না বলেই কেবল eye contact রাখে, তবুও তাদের ব্রেইন ওয়েভ কিছু সময়ের মধ্যে একই rhythm-এ যেতে থাকে।
অর্থাৎ, আপনার মস্তিষ্ক আসলে কথাবার্তার আগেই আশপাশের মানুষের অনুভবকে শুষে নিচ্ছে।
কখন এই প্রতিধ্বনি সবচেয়ে বেশি হয়?
যখন—
১।আপনি শারীরিকভাবে খুব কাছাকাছি অবস্থানে থাকেন
২। গভীর আবেগ ভাগাভাগি করেন (যেমন- হাসি, কান্না, উত্তেজনা)
৩। একই লক্ষ্য বা লক্ষ্যভিত্তিক কাজে যুক্ত হন (যেমন- একসাথে প্রস্তুতি, প্রজেক্ট, তীর্থযাত্রা)
৪। নিরবতা ভেঙে একটি পারস্পরিক চুপচাপ অনুভব তৈরি হয়- যেখানে কথা নেই, কিন্তু বোঝাপড়া আছে
একটি রহস্যময় ঘটনা হলো, ঘন ঘন একসাথে সময় কাটানো মানুষদের মস্তিষ্ক এমনকি দূর থেকেও একে অপরের ব্রেইন ওয়েভে রেসপন্স করে। মানে আপনি যদি কারও সঙ্গে দীর্ঘদিন বন্ধুত্বে থাকেন, আপনার মস্তিষ্কের কিছু রিদম হয়তো তার সাথে এমনভাবে “ম্যাপড” হয়ে গেছে যে, অনেক দূরে থাকলেও কোনও কারণ ছাড়াই আপনার মুড তার পরিবর্তনের সাথে সাথেই বদলে যেতে পারে। অনেকেই বলেন, “আচমকা ওর কথা মনে পড়ছে”, বা “হঠাৎ মন খারাপ লাগছে, পরে দেখি ওরও তাই হয়েছিল”, এটা নিছক কাকতাল নয়, এটা সামাজিক স্নায়ুবিজ্ঞানের বাস্তবতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের এক ছোট্ট রুমে বসে পড়াশোনা করতেন এক ছাত্র, নাম আনিক। ছিল ভীষণ কৌতূহলী, একা একাই ভাবতে ভালোবাসত। তার বন্ধু ছিল সাদ, যাকে সবাই বলত ‘রিয়্যাক্টর’। কারণ সে সবকিছুর প্রতি তৎক্ষণাৎ রিঅ্যাক্ট করত, গল্প শুনলেই তুমুল হাসি, ঝামেলা হলেই মুহূর্তে রেগে যাওয়া, সবকিছুকে কন্ট্রোলে রাখতে চাওয়া।
আনিক আগে খুব স্থির স্বভাবের ছিল। কিন্তু সাদের সঙ্গে প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করতে করতে একসময় সে খেয়াল করল, সে নিজের অজান্তেই খুব রিঅ্যাক্টিভ হয়ে পড়েছে। টিচার একটু কিছু বললেই বুক ধড়ফড় করে, ক্লাসে কোনো প্রশ্ন উঠলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে উত্তর দিতে চায়। অথচ আগে এমন ছিল না।
একদিন রাতে, ডিপার্টমেন্টের ছাদে বসে আনিক হঠাৎ বলে ফেলল,
“তুই জানিস, আমি আমার মতো থাকতেই ভুলে গেছি। আজকাল তোকে দেখে যেমন রিঅ্যাক্ট করিস, আমিও তেমন হয়ে যাচ্ছি।”
সাদ কিছুটা চমকে গেল, বলল,
“তুই তো আগেও এমন ছিলি না। এখন দেখি একটু কিছু হলেই তোর ভিতরে আগুন ধরে যায়!”
আসলে, এই ‘আগুন’টা ছিল ব্রেইন ওয়েভের প্রতিধ্বনি।
তারা প্রতিদিন এতটা সময় একসাথে কাটাত যে, ধীরে ধীরে সাদের উত্তেজিত Beta Wave অনিকের Calm Alpha Wave-কে পেছনে ঠেলে দিচ্ছিল। তারা কেউ জানত না, তাদের মস্তিষ্ক আসলে একে অপরকে প্রোগ্রাম করছে।
এটা কি শুধু গল্প? একদম নয়।
নিউরোসায়েন্স বলছে, যখন আপনি ঘনিষ্ঠভাবে কারও সঙ্গে যুক্ত হন, তখন তাদের মুড, চিন্তার ধরণ, এমনকি মানসিক অবস্থা, আপনার ব্রেইনের সাথে সিঙ্ক্রোনাইজড হতে থাকে।
এটা এতটাই গভীর বিষয় যে, ২০১৭ সালে MIT এবং Princeton-এর এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়-
দুজন ব্যক্তি একসঙ্গে থাকলে তাদের ব্রেইনের Default Mode Network (DMN) একে অপরের সাথে Synchronize হয়ে যায়, even if they are not speaking.
যেমন-
১।একজন নার্ভাস থাকলে, কাছের বন্ধুটিও কয়েক মিনিটের মধ্যে অস্থির অনুভব করে
২। একজন দুঃখী থাকলে, সে যদি কাছের মানুষের সঙ্গে সময় কাটায়, তাহলে তার Amygdala ও Hippocampus-এ সেই দুঃখের ছায়া পড়ে যায়
অর্থাৎ, আপনি যার সঙ্গে আছেন, তার ব্রেইন ওয়েভ আস্তে আস্তে আপনার মস্তিষ্ককে রিডিজাইন করে।
এটা বিপজ্জনকও হতে পারে!
ভাবুন, আপনি যদি এমন মানুষের সঙ্গে থাকেন,
১. যে সবসময় নেতিবাচক ভাবে কথা বলে,
২. যে সর্বক্ষণ সন্দেহ করে, ভয় দেখায় বা উপহাস করে,
৩. যার কথায় কেবল দুঃখ, অসহায়ত্ব আর হাল ছেড়ে দেওয়া জিনিসগুলো আছে।
তাহলে আপনি চাইলেও কিছু করতে পারবেন না।
আপনার ব্রেইন তার মতোই চিন্তা করতে শিখে ফেলবে।
এই অবস্থাকে সাইকোলজি বলে:
1. Emotional Contagion
2. Neural Entrainment
আপনার মস্তিষ্ক আর নিজের মতো কাজ করছে না।
এখন সে অন্যের ‘mindset’ কপি করে কাজ করছে।
তাহলে করণীয় কী?
আপনি অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হবেন না, আপনি–ই হবেন প্রভাব
পৃথিবীতে খুব অল্প কিছু মানুষ আছে, যারা একা কোথাও ঢুকলেও চারপাশের পরিবেশ বদলে যায়। আপনি নিশ্চয়ই এমন কাউকে চিনেন, একটা ক্লাসে ঢুকেই যিনি সবাইকে নিরব করে ফেলেন, কোনো কথা না বলেও উপস্থিতি জানান দেন, বা যার চেহারাতেই এমন কিছু থাকে যা দেখে আপনি নিজেকে একটু গুছিয়ে বসেন।
তারা কী করে এটা?
তারা শুধু নিজের ব্রেইনের তরঙ্গ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে শিখেছে।
এবং দীর্ঘ সময় ধরে নিজের চিন্তা, ইমোশন, ফোকাস, সবকিছু একটা স্পষ্ট ওয়েভে ধরে রেখেছে। এই অবস্থা তৈরি হলে, তাদের ব্রেইন ওয়েভ আশেপাশের লোকজনকেও সিঙ্ক্রোনাইজ করে ফেলে। অর্থাৎ তখন আপনি আর ভিক্টিম নন; আপনি একজন “ওয়েভ-সেটার”।
এটাই মাস্টারমাইন্ডদের সিক্রেট
একজন মাস্টারমাইন্ড কখনো তার চারপাশের মানুষদের হঠাৎ বদলাতে চায় না। সে জানে, মস্তিষ্কের তরঙ্গই চুপচাপ পৃথিবীকে বদলায়। সে বুঝে যায়-
“যে নিজের মস্তিষ্ককে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে অন্যদের মস্তিষ্কেও ছায়া ফেলতে পারে।”
সে নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করে-
১। যাতে ভয়, সন্দেহ, বা ব্যর্থতা তার ওয়েভে ঢুকতে না পারে,
২। যাতে তার Calm Alpha Wave, অন্যের Anxiety-driven Beta Wave-কে হটিয়ে দেয়,
৩। যাতে তার চিন্তার গভীরতা চারপাশে ripple তৈরি করে, silent influence।
এটাই নেতৃত্ব, এটাই বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়ন্ত্রণ,
এবং এটাই সত্যিকারের মাস্টারমাইন্ড হওয়ার নিউরোসায়েন্টিফিক রাস্তাটা।
তাহলে এখন?
সরাসরি প্রশ্ন:
আপনার ব্রেইন ওয়েভ এখনো অন্য কারও দ্বারা প্রভাবিত? নাকি আপনি নিজেই আপনার চারপাশের ব্রেইন ওয়েভ প্রোগ্রাম করছেন?
এ প্রশ্নটা যতবার করবেন,
ততবারই আপনি একটু বেশি “মাস্টার” হয়ে উঠবেন-
নিজের উপর, নিজের তরঙ্গের উপর, এবং ধীরে ধীরে… পুরো পরিবেশের উপর।
শেষ নয়;এটা তো শুরু!
নিউরোসায়েন্স আজ প্রমাণ করছে,
“আপনি যাঁদের সঙ্গে থাকেন, আপনি ঠিক তাঁদের মতোই হয়ে যান, নিঃশব্দে, না বুঝেই।”
তাই সময় এসেছে, আপনি ঠিক করুন, আপনি একজন “mind follower” হবেন, না “mind architect”?
মো. ইফতেখার হোসেন
চিকিৎসা শিক্ষার্থী, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ | নিউরোসায়েন্স, অভ্যাস গঠন ও মানুষের মস্তিষ্কের আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে আগ্রহী।
Leave a comment