নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ |
বিজ্ঞান যখন প্রকৃতির গহীনে প্রবেশ করে, তার পথ হয়ে পড়ে শুষ্ক ও গাণিতিক। সূত্র, পরিমাপ, পর্যবেক্ষণ আর পরীক্ষার ভিতর দিয়ে আমরা প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করি—তাকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করি। কিন্তু প্রকৃতির আসল ভাষা কি কেবল সংখ্যায় প্রকাশযোগ্য? না কি আমাদের জ্ঞানের বাইরেও আছে একধরনের বোধ, অনুভব, এমনকি আত্মিকতা, যা বিজ্ঞানকে নতুন করে বোঝাতে পারে? রোবিন ওয়াল কিমেরার বই Braiding Sweetgrass এই প্রশ্নগুলোকেই সামনে আনে। একজন বিজ্ঞানী এবং একই সঙ্গে একজন আদিবাসী জ্ঞানপ্রেমী হিসেবে কিমেরার অবস্থান দুই জগতের ঠিক মাঝখানে। তাঁর লেখা আমাদের দেখায়, কীভাবে আধুনিক পরিবেশবিজ্ঞান ও আদিবাসী জ্ঞানের একত্রে বেঁধে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা সম্ভব।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোটাওয়াতোমি জাতির একজন সদস্য হিসেবে কিমেরা প্রথাগত পশ্চিমা বিজ্ঞানের ভিতরেই তাঁর অধ্যয়ন শুরু করেছিলেন। একজন উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে তাঁর গবেষণার ধারা ছিল ক্লাসিকাল — কীভাবে উদ্ভিদ কাজ করে, কেমন করে তারা পরিবেশের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝলেন, তাঁর আদিবাসী সংস্কৃতির ভিতরেও রয়েছে গভীর প্রাকৃতিক অন্তর্দৃষ্টি, যা বিজ্ঞানী হিসেবেও তাঁর চিন্তাভাবনাকে সমৃদ্ধ করতে পারে। এই দুই জগতের মেলবন্ধন ঘটিয়েই জন্ম নেয় Braiding Sweetgrass, যেখানে “সুইটগ্রাস” নামক এক ধরনের সুগন্ধি ঘাস হয়ে ওঠে প্রতীক — বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও কৃতজ্ঞতার এক জৈবিক বিন্যাসের।
এই বইয়ের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো এর দৃষ্টিভঙ্গি। সাধারণত আমরা বিজ্ঞানের ভাষা বললেই বুঝি নিরাসক্ত, বস্তুনিষ্ঠ একধরনের বিশ্লেষণ। সেখানে আবেগের, কল্পনার বা সম্পর্কের জায়গা নেই বললেই চলে। কিন্তু কিমেরা বিজ্ঞানকে দেখেন ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের চোখে। তিনি বলেন, প্রকৃতিকে জানা মানে কেবল তাকে বিশ্লেষণ করা নয়, বরং তাকে শ্রদ্ধা করা, তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা। উদ্ভিদের জীববিজ্ঞান যেমন আমাদের বলে কোন গাছ কখন ফুল ফোটায়, তেমনি আদিবাসী জ্ঞান আমাদের শেখায়, কীভাবে সেই ফুলের প্রতীক্ষায় থাকা যায় কৃতজ্ঞতা নিয়ে।
এই ধারণা অনেক পাঠকের কাছে নতুন মনে হতে পারে, বিশেষত যাঁরা বিজ্ঞানে “সত্য” খোঁজেন যুক্তি ও প্রমাণের ভিতর দিয়ে। কিন্তু কিমেরা যেটা বোঝাতে চান, তা হলো — বিজ্ঞান যতই নিরপেক্ষ হবার দাবি করুক, বাস্তবে তা এক সংস্কৃতি-প্রসূত প্রক্রিয়া। আমরা যা পরিমাপ করি, যেভাবে প্রশ্ন তুলি, যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করি — সবকিছুই নির্ধারিত হয় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ দিয়ে। আদিবাসী জ্ঞান, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মৌখিক ঐতিহ্য ও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সংযোগের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে, সেটিও এক ধরনের ‘বিজ্ঞান’, যদিও তা প্রথাগত সংজ্ঞার বাইরে। এই কথাটি আজকের পরিবেশ সংকটের সময়ে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কেবল যান্ত্রিক বিশ্লেষণ দিয়ে নয়, প্রকৃতিকে ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে দেখার মাধ্যমেই আমরা টেকসই সমাধানের দিকে এগোতে পারি।
বইটির ভাষা সাহিত্যিক, কখনো কবিতার মতো। প্রতিটি অধ্যায় যেন এক একটি ছোট গল্প, যেখানে কিমেরার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আদিবাসী রীতি, ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের তথ্য একত্রে বোনা হয়েছে। কখনো তিনি বর্ণনা করছেন কীভাবে তাঁর ছাত্ররা একটি মাটির উপর পরীক্ষা চালিয়ে উদ্ভিদের আন্তঃসম্পর্ক বুঝতে চেষ্টা করছে, আবার কখনো তিনি ফিরছেন তাঁর শৈশবের স্মৃতিতে—সুইটগ্রাস তোলার সময় দাদীর শেখানো আচরণ মনে করছেন। এই বর্ণনাগুলোর মাধ্যমে তিনি যেন পাঠকদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন এক বিকল্প বাস্তবতা, যেখানে বিজ্ঞান কেবল “জানার” নয়, বরং “সংযোগের” একটি পথ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বইয়ের গুরুত্ব অন্যরকমভাবে ধরা দেয়। আমাদের দেশেও রয়েছে আদিবাসী গোষ্ঠী, কৃষিভিত্তিক জ্ঞান, এবং বহু শতাব্দীর জমে থাকা প্রকৃতি-সংলগ্ন সংস্কৃতি। অথচ এই জ্ঞানগুলো আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে—শিক্ষাব্যবস্থা, উন্নয়ননীতি এবং নগরায়নের একচেটিয়া দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। Braiding Sweetgrass আমাদের মনে করিয়ে দেয়, টেকসই উন্নয়ন মানে কেবল প্রযুক্তির ব্যবহার নয়, বরং ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সম্মিলিত দৃষ্টিতে পথ খোঁজা।
আধুনিক শিক্ষায় বিজ্ঞানকে আমরা শেখাই পরীক্ষাগারে—শুষ্ক, পরিষ্কার, গাণিতিক। কিন্তু যদি পাঠ্যপুস্তকে এই বইয়ের মতো কিছু অধ্যায় যুক্ত করা যেত, যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে একটি সম্পর্ক তৈরির কথা বলা হয়, তাহলে হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানীরা আরও মানবিক, আরও দায়িত্ববান হয়ে উঠত। কারণ একটি বিজ্ঞান-সচেতন জাতি গড়ে তোলার মানে কেবল গবেষণা ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়া নয়, বরং প্রাকৃতিক ভারসাম্য, পরিবেশনীতি ও সমাজবোধে উন্নত হওয়াও বটে।
সবশেষে, কিমেরার মূল বার্তাটি একটাই — প্রকৃতি আমাদের শিক্ষক। আমরা যতই আধুনিক হই, প্রযুক্তির চূড়ায় পৌঁছাই, তবুও প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা পড়ে থাকি। তাই বিজ্ঞানকে শেখার মানে কেবল তার নিয়ম জানার চেয়ে বড় কিছু — তা হলো সম্পর্কের এক নতুন ভাষা শেখা, যেখানে কৃতজ্ঞতা, সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা মিলেমিশে এক নতুন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। Braiding Sweetgrass শুধু একটি বই নয়, এটি এক আহ্বান — বিজ্ঞানকে নতুন চোখে দেখার, হৃদয় দিয়ে বোঝার, এবং জ্ঞানের জাল বুনে নেওয়ার এক আন্তরিক আমন্ত্রণ।
Leave a comment